পুজোর হইহই শেষ। সারারাত্তির ধরে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে প্রতিমাদর্শন, বুর্জ খলিফার বিস্ময় চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করার শেষে গা-ম্যাজম্যাজ জ্বরজ্বর ভাব – সিজন চেঞ্জ নাকি কোভিড, বলা মুশকিল। কিন্তু সকলেই সহমত, দুদিন দেখা যাক না। এই দেখার দিনগুলোর ফলাফল যে বাকিদের পক্ষে ঝুঁকির হতে পারে, সে নিয়ে ভাবার অভ্যেস আজকাল আর নেই।
আনন্দোৎসবে ঢালাও ছাড়পত্র দেওয়ার পর সরকারবাহাদুরও তার ফলাফল নিয়ে দুশ্চিন্তায়। কোভিড ওয়ার্ড খোলার তোড়জোড় পুরোদমে। কোয়ার্যান্টাইন সেন্টারের ধূলো ঝেড়ে চালু করার উদ্যোগ। পুরসভা চিকিৎসকদের ছুটি বাতিল করার কথা বলছেন। উৎসব রেশ ফুরোতে না ফুরোতেই এমন চটজলদি উদ্যোগ! সন্দেহ গভীর হয়, ঢালাও মোচ্ছবের এমন পরিণতি যে অনিবার্য, একথা সরকারবাহাদুর তো আগেই জানতেন। তাহলে?
সামান্যতম কাণ্ডজ্ঞান থাকলে তো পরিণতির অনুমান কঠিন ছিল না। তবে যে সরকারের মন্ত্রী স্বয়ং তাঁর প্যান্ডেলে জলপ্লাবন দেখে উচ্ছ্বসিত হন আর তারপর অসুখ ছড়ানোর সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে অবিচল বলতে পারেন, আনন্দ-উৎসব নিয়ে এমন প্রশ্ন তোলাটা দুর্ভাগ্যজনক – সেই সরকারের কার্যাকার্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা-ই, সম্ভবত, অবান্তর।
তাছাড়া কে যেন কবে বলে গিয়েছেন, জনগণ তেমন সরকারই পেয়ে থাকেন যেমনটি তাঁদের প্রাপ্য। আদালত প্যান্ডেলে ঢোকার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করলে যে জনসাধারণ প্যান্ডেলের ঠিক বাইরে ধাক্কাধাক্কি করতে থাকেন – মিডিয়ার প্রশ্নের সামনে একগাল হাসি নিয়ে বলেন, অসুখবিসুখ তো থাকবেই কিন্তু পুজো তো রোজ আসবে না – তাঁদের অসুখ-বিসুখের দায়টা সরকারের ঘাড়ে ঠেলে দেওয়া অনৈতিক। কেননা, সরকার জনগণের দ্বারা নির্বাচিত এবং জনগণের স্বার্থ যথাসাধ্য রক্ষাই সরকারের দায়, পুরোনো সিনেমার কমল মিত্র সুলভ দাপুটে অভিভাবক হয়ে থাকার গুরুদায়িত্ব পালন সরকারের পক্ষে মুশকিল – আর গণতন্ত্রে সত্যিই তেমনটি হলে, মুশকিল বাকিদেরও।
তাহলে এ অবস্থার জন্যে দায়ি কে?
কেন, চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা!!
ধূমপান-মদ্যপান-অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের শেষে ঘোরতর অসুস্থ হয়ে, শেষমুহূর্তে হাসপাতালে পৌঁছে যদি চিকিৎসকের অমানবিকতা, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আর হাসপাতালের বিল-ই একমাত্র আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে, তাহলে এ তো একেবারেই নস্যি!!
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে গান্ধীজির অভিযোগ ছিল – অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন সঞ্জাত অসুখ-বিসুখের চিকিৎসা করার মাধ্যমে চিকিৎসাবিজ্ঞান পরোক্ষে তেমন জীবনযাত্রাকে প্রশ্রয় দেয়, কাজেই আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানও অনৈতিক। অনভিজ্ঞ ঔদ্ধত্যে এই অভিযোগ হেসে উড়িয়ে দিতাম। কোভিডকাল কথাটা নিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখালো।
পুরসভা নিজ দায়িত্ব খুবই মনোযোগের সঙ্গে পালন করছেন। নিয়মিত কতজন পজিটিভ, সে খবর প্রকাশিত হচ্ছে। সঙ্গে জানানো হচ্ছে, সংক্রামিতের মধ্যে কতজন টিকাপ্রাপ্ত। দেখা যাচ্ছে, সংক্রামিতের বড় অংশই টিকাপ্রাপ্ত। এই তথ্য থেকে অনেকরকম ধারণাই করা যেতে পারে। যেমন, যাঁরা টিকা নিয়েছেন, তাঁরা বেশি সচেতন, সুতরাং জ্বর-সর্দিকাশিতে তাঁরা তাড়াতাড়ি পরীক্ষা করিয়েছেন। অথবা, টিকা নেওয়ার আত্মবিশ্বাসের চোটে তাঁরাই বেশি হইহই করে বেড়িয়েছেন। অথচ সংক্রামিত মানেই অসুস্থ নয়। গুরুতর অসুস্থের মধ্যে টিকাপ্রাপ্তর হার কেমন, সেটা কদিন বাদেই বোঝা যাবে। সারা বিশ্বের ধারা অক্ষুণ্ণ থাকলে (তেমনটিই প্রত্যাশিত) এখানেও দেখা যাবে, আইসিউ-এ ভর্তি যাঁরা, তাঁদের অধিকাংশই টিকা নেননি। কিন্তু সেই তথ্য পাওয়ার জন্যে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে, কোভিড আরেকটু জাঁকিয়ে বসা অব্দি সেই তথ্য পাওয়া মুশকিল। ততদিন অব্দি পুরসভার তথ্য থেকে একটা বিভ্রান্তি প্রায় অবাধে ছড়াচ্ছে, টিকা নিয়েও কিছুই লাভ নেই, এমনকি টিকা নিলে সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়ছে। অবশ্য নিজেদের ক্রিয়াকলাপ থেকে পাব্লিকের কাছে কী বার্তা পৌঁছাচ্ছে, সে নিয়ে সরকারপক্ষ কবেই বা বিচলিত হয়েছেন!!
অথচ, এই তৃতীয় ঢেউয়ের মোকাবিলায় বর্তমানের রাজ্যসরকার বেশ আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। এই ঢেউয়ে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, এমন খবর শুনে পেডিয়াট্রিক আইসিউ বেড বাড়ানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। সরকারি মেডিকেল অফিসারদের বিশেষ কোভিড ম্যানেজমেন্ট প্রশিক্ষণের কাজও হয়েছিল। কিন্তু ভিড় বাড়তে না দেওয়ার মতো আনুষঙ্গিক পদক্ষেপের অভাবে পুরোটাই মাঠে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা।
আপাতত উপায়? চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের একজন হয়ে বলি, খুব খুউব হতাশ লাগছে। কোভিডে মারা গিয়েছেন যাঁরা, পেশার হিসেবে ভাগ করলে দেখা যাবে, চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরাই সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় মারা গিয়েছেন। আমাদের এতজন সহকর্মীর মৃত্যুও সামান্যতম বার্তা দিতে পারল না সমাজের বাকিদের!! ছেলেবেলায় বইয়ে সমাজবন্ধু বলে কিছু পেশার কথা থাকত। খাটা পায়খানা সাফাই করেন যাঁরা, তেমন পেশা মানবতার অসম্মান বলে বিলুপ্ত। কিন্তু আপনাদের অবাধ আমোদ-আহ্লাদের মলমূত্র সাফাই করতে হবে যাঁদের, সেই আমাদের কথা কে ভাববেন? কবে ভাববেন?
যাক গে সেসব হাহুতাশের কথা।
পুজোশেষে কাশফুলে ঢাকা পথ বেয়ে ঢাকিরা ফিরে গিয়েছেন। সঙ্গে কাঁসর বাজানো ঢাকির ছেলেটি। বাবুদের পুজোয় গিয়ে তার নতুন জামা জুটেছে। বাবুর ছেলের বাতিল করা প্রায় নতুনের মতো জুতোও। পুজোর পর তার ইশকুল খোলার কথা। অসুখের বাড়বাড়ন্ত হয়ে আবারও লকডাউন হলে তাকে আবার চাষের কাজেই যোগ দিতে হবে। বাবুর ছেলেটিও জুম ক্লাসের চোটে ক্লান্ত। ঠাকুর দেখে ক’দিন হুল্লোড় শেষ – আবারও সেই বোরিং রুটিন, তারও।
এরই মাঝে কয়েকটা মুখ ভাসানের প্রতিমার মতো মুছে যাবে। তা হোক, উৎসব কি আর রোজ রোজ আসে…