আমার যেসব রুগিদের স্ত্রীরা সিজোফ্রেনিয়ায় ভুগছেন তাদের দুর্গতির আর শেষ নেই। বেশিরভাগ হতভাগ্যের বউরাই ‘ডিলিউশন অফ ইনফিডালিটি’-তে ভোগেন। ঠিক যে অসুখে ভুগতেন ডেসডিমোনার স্বামী ওথেলো। তারা সকলেই সন্দেহ করে তাদের স্বামীরা পরকীয়ার সাথে যুক্ত। আপনি বলতে পারেন সে তো সব মেয়েরাই তাদের স্বামীকে সন্দেহ করে। আমি এমন ছেলেদের চিনি যারা আলতোভাবে অন্য মেয়েদের দিকে তাকালেই তাদের স্ত্রীরা হিল দিয়ে তাদের পা মাড়িয়ে দেয়। আমি যে বউকে বাড়িতে রেখে এত পাহাড়ে-পাহাড়ে ঘুরে বেড়াই আমার বউ, বউদিরা এবং আমার মা বিশ্বাস করেন যে প্রতিবার আমি হিমালয়ের বিভিন্ন জায়গায় একটি করে পরকীয়া করে আসছি। তবে এদের সন্দেহ কিন্তু এমন নয়। এ তীব্র সন্দেহ। সেই ধাক্কায় তাদের বিবাহিত জীবন আন্ডাবাচ্চা নিয়ে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
সন্দেহের কথা বললাম বটে কিন্তু পরকীয়ার ঘটনা আমার ডাক্তারি জীবনে কম কিছু দেখি না। আমারই ছোটবেলার বন্ধু। চিরকালই একটু ডেঁপো টাইপের। কলকাতায় দোকান। হঠাৎ বিয়ের আগে মুখ কাঁচুমাচু করে দেখাতে এল। চেন খুলতেই দেখি তিন ইঞ্চির মুখ দিয়ে পুঁজ বের হচ্ছে। কলকাতা মেডিকেল কলেজের পাশের বিখ্যাত বস্তিতে ঢুকেছিল বিয়ের আগে সড়গড় হতে। আমি আমার বিয়ের প্রথম একমাস যেমন নির্জলা উপবাসে কাটিয়েছিলাম সে তা করতে চায় নি। তার ফলশ্রুতি এই। কপাল ভাল এখন ভালো ভালো ওষুধ বেরিয়ে গেছে। তাই সুস্থ হয়ে দু-হপ্তা পরে বিয়ের পিঁড়িতেও বসে পড়েছিল। আজ যখন বৌ আর মেয়েকে নিয়ে আমাকে দেখাতে আসে তখন দশ বছর আগের কথা মনে পড়ে। ওর বউ নিশ্চিতভাবে সেসব কিছু জানে না। সত্যি কত লোকের কত কথা আমরা জানি যা তারা তাদের খুব কাছের লোককেও জানাতে পারে না। ভাবলে মাঝে মাঝে সত্যিই আমার অবাক লাগে।
এই পরকীয়ার কত যে ভয়ঙ্কর নমুনা দেখেছি তা কত বলব। আমাদের বাড়ির পাশের তিনটি বাড়িতেই এক মহিলা কাজ করতেন। অল্প বয়স, সঙ্গে বছর তিনেকের বাচ্চা। একদিন দেখাতে এল। মা বলল, ওকে দেখে দিস রে। মেয়েটার একমাস ধরে জ্বর কমছে না। দেখাতে এলে লক্ষ্য করলাম চেহারা এই ক’দিনেই খুব ভেঙে গেছে। দেখালো পায়ের আঙ্গুলের মাথাগুলো সব লাল হয়ে ফুলে গেছে। কতগুলোতে ঘাও হয়ে গেছে। সর্বনাশ, ক্যাপোসিস সারকোমা। বুঝলাম এইডস হয়েছে। টেস্ট করাতে দিলাম। পজিটিভ। ওর বর মুম্বাইয়ে কাজ করে। বছরে দুবার বাড়ি আসে। ওই দুবার এসেই ওর সর্বনাশ করে দিয়ে গেছে। ঠিকভাবে চিকিৎসাও করাতে পারে নি। দু-মাসের মধ্যেই মারা যায়। বাচ্চাটার কী হয়েছিল আর জানি না। ওই মেয়েটাকে দেখে আমার মণীন্দ্র গুপ্তের অক্ষয় মালবেরীর কার্তিককাকার বউ-এর কথা মনে হল। ‘শহরের আদাড় থেকে এসে হুলো বেড়ালটা তার মধ্যে বিষ ছড়িয়ে দিয়ে গেছে’।
লিঙ্গপুরাণ নিয়ে যে কত কথা বলার আছে তা বলতে গেলে আরব্যরজনী হয়ে যাবে। শেষে একটি মর্মন্তুদ ঘটনা না বললেই নয়। রাত প্রায় দেড়টা হবে। প্রবল শীত পড়েছে সেবার। বিছানায় শুয়ে সবে চোখ লেগেছে। হঠাৎ ঘনঘন কলিং বেল বাজতে লাগল। বাইরে বেরিয়ে দেখি উৎকন্ঠিত জনাছয়েক লোক। তার মধ্যে একজন আবার আমার খুব পরিচিত। ‘খুব সিরিয়াস ডাক্তারবাবু। শিগগির চলুন’। প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেতে হল।
গিয়ে দেখি নববিবাহিত বর চোরের মত শোবার ঘরে বিছানায় বসে আছে। চারিদিকে রক্তে ছড়াছড়ি। বিছানার ধবধবে চাদর, বালিশের ওয়্যার, পরিষ্কার টাওয়েল, বৌয়ের ওড়না, ম্যাক্সি মায় শাশুড়ির গামছা কোথাও আর রক্ত লাগতে বাকি নেই। কমন কেস। বুঝতে অসুবিধে হল না। বিয়ের আগে ‘নিজস্ব অভ্যাস’ করতে গিয়ে কোনো কারণে তিন ইঞ্চিতে চোট লেগেছিল। তা শুকিয়ে অতদিনে চামড়া শক্ত হয়ে গেছে। বিয়ের পর তিন ইঞ্চি সময়কালে তো আর তিন ইঞ্চি ছিল না, তা জোয়ারের জলে ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। তাতেই সেই কাঁচা জায়গা ফেটে গিয়ে রক্তারক্তি ব্যাপার। অনেকেই হয়ত জানেন যে সঙ্গমকালে তিন ইঞ্চি যে পাঁচ ইঞ্চি হয়ে যায় তার প্রধান কারণ তাতে রক্তসঞ্চালন বহুগুণ বেড়ে যায়। তাই রক্ত সহজে বন্ধ হতে চায় না।
বেচারার অবস্থা দেখে হাসিও পেল, মায়াও হল। জীবনে লোক এমন কেসও খায়? নতুন বিয়ের পর এমন অনেকেরই হয়। তবে ওর হল কিনা শ্বশুরবাড়িতে? সারা জীবন এই নিয়ে কম খিল্লি খাবে? তার মধ্যে পাড়ার লোকজনও জড়িয়ে গেছে। হায়!হায়!হায়! বেচারাকে অভয় দিয়ে সামান্য মলম লিখে দিয়ে চলে এলাম। বিয়ের আগে ওই যে ‘নিজস্ব অভ্যাসের’ কথা বললাম- তাতে একজন তিন ইঞ্চিকে সরু মুখের বোতলে ঢুকিয়ে চেষ্টা করতে গেছিলেন। পরে তার আকার আয়তন বেড়ে তা এমনভাবে আটকে যায় যে বোতল ভেঙে তাকে উদ্ধার করতে হয়েছিল।
এমন কত গল্প আর করব আপনাদের সাথে। এ গল্পের কোনো শেষ নেই। আমাদের ইন্টার্নশিপে এমারজেন্সিতে ঝাঁকে ঝাঁকে এই শীতকালে স্ট্রোকের পেশেন্ট ভর্তি হত। নর্থ বেঙ্গলের ওই ঠান্ডায় মেঝেতে বেকায়দায় বসে তাদের তিন ইঞ্চিতে ফলিস ক্যাথেটার পরাতে হত। হাতে জল (স্যালাইন), নাকে নল (রাইলস টিউব), আর তিন ইঞ্চিতে কল (ক্যাথেটার)- এই ছিল প্রোটোকল। আমরা সব ক্যাথেটারেই অ্যানেস্থেটিক জেল লাগিয়ে ফট করে ঢুকিয়ে দিতাম। আমাদের সার্জারির আর এম ও সোমপ্রকাশদা যাকে আমরা দশাসই চেহারার জন্য ‘যমপ্রকাশ’ বলতাম, উনি বলতেন, ‘ওরে ওতে ক্যাথেটারটার অ্যানেস্থেসিয়া হয়। পেনিসের হয় না’। এই ক্যাথেটার পরানো নিয়েই এক মজার গল্প বলে লিঙ্গপুরাণ শেষ করব।
গল্পটা এক সিনিয়র দাদার মুখে শোনা। তিনি শুনেছেন কলকাতার এক বিখ্যাত সার্জেনের মুখে। পিজির উডবার্ন ওয়ার্ডে সবসময় আমাদের রাজ্যের ভি আই পি-রা ভর্তি থাকেন। বেশিরভাগই হয় রাজনৈতিক নেতা বা তাদের আত্মীয়রা। আমাদের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর মাও তার শেষ সময়ে ভর্তি ছিলেন। আরেক আগরপাড়ার মহামহিম নেতা তো সারদাকালে ওই ওয়ার্ডকে তার ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলেছিলেন।
আগে পিজিতে কেরালিয়ান নার্সদের পোস্টিং হত। তারা যেমন দক্ষ নার্স ছিলেন তেমনই চোস্ত ইংরিজি বলতেন ও লিখতেন। পরে তাদের আগ্রহ কমে আসায় তারা বাংলায় আর কাজে আসতেন না। তখন বাঙালি সিস্টারদেরকেই কেবল উডবার্ন ওয়ার্ডে ডিউটি দেয়া হত। এদের অনেকেরই ইংরিজিতে জ্ঞান ছিল প্রশ্নাতীত।
উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছেন উৎপল দত্ত। বাম জমানা চলছে। তার প্রায় শেষ অবস্থা। কিডনির সমস্যায় ভুগছেন। রাতে ভর্তি হবার পর তাকে ক্যাথেটার পরানো হয়েছে, তবে ইউরিন আসছে না। হয়ত কোনো অল্পবয়েসি ইন্টার্ন ক্যাথেটার পরিয়ে সেটা লক্ষ্য না করেই চলে গেছে। কিংবা কোনো কারণে ফলিস ক্যাথেটার হয়ত ব্লক হয়ে গেছে। তার ওপর স্যালাইন চলেছে। পেচ্ছাপ জমে তলপেট ফুলে গেছে। গভীর রাতে সিনিয়র অন-ডিউটি সিস্টার অন-কল ডাক্তারবাবুকে কল-বুক পাঠাচ্ছেন। তার যেহেতু অসুবিধে আছে তিনি বাংলাতেই লিখতে পারতেন। কিন্তু তিনি উৎপল দত্তের নার্স। কানে সেই সময় তার হয়ত ‘সপ্তপদী’র সেই উৎপল দত্তের গলায় ওথেলোর ‘পুট আউট দ্য লাইট! পুট আউট!’- সেই বজ্রনির্ঘোষ বাজছিল, তাই তিনি খসখস করে ইংরিজিতেই কল-বুক লিখলেনঃ “ Patient has very pain abdomen. He try to micturate but fail. I try to micturate but fail. You please come and micturate.”- On duty sister.
পিজি হাসপাতালের তিনশ বছরের ইতিহাসে সেই কল-বুক অমরত্ব পেয়ে গেছে।
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম
যে বিজাতীয় ভাষায় লিখে পিজির সিস্টার ইতিহাসে চলে গেলেন , ঐ ভাষার কিন্তু কিছু সুবিধেও আছে। যেমন কাউকে গাড়ল বা আহাম্মক বললে চটেমটে যাবে ; অথচ ইডিয়েট বললে তেমন চটবেন না। সে যাই হোক , একবার কোর্টে , ” Penitrating injury in the precordium” বলে জজসাহেব থেকে উকিলবাবু সকলকে এমন হকচকিয়ে দিয়েছিলাম যে , আমাকে আর ঘাটাতে চেষ্টা করেননি।