প্রতিদিনই চিকিৎসকদের নিয়ে এতো নেগেটিভ খবর হয়, যে আর প্রতিবাদ করে কিছু লিখতে ইচ্ছে করে না। সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যক্তি চিকিৎসককে একেবারে নাম করে সাধারণ মানুষ যেভাবে তাকে হেয় করতে মেতে ওঠেন, তাতে অবসাদে ঢুবে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করে উঠতে পারি না।
কিন্তু আজ আনন্দবাজার পত্রিকায় সম্পাদকীয় পড়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। যেখানে শিশুকন্যার অনুপাত কমার জন্য অধিকাংশ দোষই চিকিৎসক সমাজের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। হতবাক হয়ে আরেকবার পড়ে দেখলাম সম্পাদকীয়র কোথাও লেখা হয়নি, কিছু নীতি ভ্রষ্ট চিকিৎসকের কথা। বরঞ্চ লেখা হয়েছে সামগ্রিক চিকিৎসক সমাজ এবং চিকিৎসক সংগঠন গুলির কথা। অর্থাৎ আমি সহ সব চিকিৎসকই দায়ী কন্যা ভ্রূণ হত্যার জন্য।
আমি দুই কন্যা সন্তানের বাবা। লেখাটা পড়ার পর থেকে মনে হচ্ছে, যদি এটা আমার মেয়েরা পড়ে? অথবা অন্য চিকিৎসকদের মেয়ে বা স্ত্রী বা আত্মীয়া যারা এটা পড়ছে তারা আমাদের সম্পর্কে কী ভাবছে? হাজার হাজার কন্যা ভ্রূণের রক্তে তাদের প্রিয়জনের হাত রাঙা হয়ে আছে ভেবে আমাদের ঘেন্না করছে?
আমার স্ত্রীর গর্ভাবস্থায় একাধিক বার আল্ট্রাসোনোগ্রাফি হয়েছে। যারা করেছেন, প্রত্যেকেই আমার ঘনিষ্ঠ পরিচিত। কিন্তু ফিটাল আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করার সময় কেউই আমাকে ঘরে থাকতে দেননি, আমিও থাকতে চাইনি। ওই টুকু সময় বাইরে ঘুরে এসেছি। হয়ে যাওয়ার পরে রেডিওলজিস্ট বন্ধুর সাথে আড্ডা মেরেছি অনেকক্ষণ ধরে। হ্যাঁ, অধিকাংশ চিকিৎসক এব্যাপারে এতোটাই প্রিন্সিপাল মেনে চলেন। যেখানে ঘনিষ্ঠ চিকিৎসক বন্ধুকেও তার স্ত্রীর আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করার সময় ঘরে থাকতে দেওয়া হয়না, যাতে সে ভ্রূণের লিঙ্গ বুঝতে না পারে। অথচ সেই পুরো চিকিৎসক সমাজকে দায়ী করা হলো শিশু কন্যার অনুপাত কমার জন্য!!
আসলে দোষ তো কারোর উপর চাপাতেই হবে। চিকিৎসকরাই সবচেয়ে সফট টার্গেট। আর এতে সাধারণ মানুষও বিলক্ষণ খুশি হবে। আর কন্যাসন্তানের সংখ্যা দিন দিন আরও কমে যাবে।
অথচ সত্যিকারের কারণ খোঁজার চেষ্টা করলে অনেক প্রশ্ন উঠে আসতো। কেন সমাজে আজও অনেক বাবা-মা মেয়েদের বোঝা মনে করেন? কেন নিম্নবিত্ত পরিবারে ভালো খাবারটুকু ছেলেদের পাতে তুলে দেওয়া হয়? কেন মেয়েদের রাস্তা ঘাটে চলতে গিয়ে নানা বিপদের সম্মুখীন হতে হয়? কেন চরিত্র রক্ষার দায় একা মেয়েদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়? কেন বিজ্ঞাপন সিনেমায় সর্বত্র মেয়েদের কেবল মাত্র পণ্য হিসাবেই উপস্থাপন করা হয়? কেন রাষ্ট্র মেয়েদেরকে একজন মানুষের মর্যাদা দিতে পারে না? কেন যে মেয়েটা প্রাণপণে একজন সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠতে চাইছে, সকলে তার নারীত্ব প্রমাণের চেষ্টায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে?
চিকিৎকদের দিকে আঙুল তোলার আগে নিজের দিকে আঙুল তুলুন। এই পচাগলা সমাজব্যবস্থার দিকে আঙুল তুলুন। আনন্দবাজার পড়ে, চিকিৎসকদের গালাগালি দিয়ে মনের ঝাল মিটতে পারে, কন্যা সন্তানের অনুপাত বাড়বে না।
আর আমার কথা অবিশ্বাস হলে একবার আল্টাসোনোগ্রাফি করার সময় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে ভ্রূণের লিঙ্গ জানার জন্য চাপাচাপি করে দেখতে পারেন। তবে আপনার ভালোমন্দ কিছু হয়ে গেলে তার দায় আমার নয়। তার দায় আনন্দবাজার পত্রিকার।