শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিচালক ডা. পুণ্যব্রত গুণের কথা শুনতে শুনতে মনে হল যেন এক রূপকথা শুনছি। ইচ্ছে থাকলেই নাকি নিতান্ত কম খরচে গরীব মানুষের কাছে অত্যাধুনিক চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া যায়। চিকিৎসার কোনও ধাপে এতটুকু কার্পণ্য না করেই!
হ্যাঁ, গত ২৩ বছর ধরে লড়াই করে করে এটা তিনি হাতে-কলমে প্রমাণ করে ছেড়েছেন। সেই জয়ের গল্পই আজ আপনাদের শোনাব।
১৯৯৫ সালের মার্চ মাসে হাওড়ার চেঙ্গাইলে পরিত্যক্ত এক মুরগির চালায় শ্রমজীবি মানুষের সহযোগিতায় এক ডাক্তার ও সাতজন স্বাস্থ্যকর্মী মিলে এক বিপ্লবের সূচনা করেন। গড়ে তোলেন এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র। উদ্দেশ্য প্রায় বিনা চিকিৎসায় মরতে থাকা গরীব মানুষগুলিকে ন্যূনতম খরচে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া, পাশাপাশি প্রমাণ করা যে চাইলে কম খরচে চিকিৎসা করা যায়, সরকার নিতে পারে সব নাগরিকের স্বাস্থ্যরক্ষার ভার। তারপর সেখান থেকে টাকা বাঁচিয়ে আরেকটু বড় কিছু গড়ে তোলা। প্রায় ১৫ বছর পর স্বপ্ন সাকার হয় তাঁদের। তিল তিল করে জমানো টাকা ও কিছু অনুদানের সাহায্যে ২০১০ সালে তৈরি হয়ে যায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের তিনতলা বাড়ি। ২৩ জন ডাক্তার, ৩৬ জন স্বাস্থ্যকর্মী নিয়ে সেই কেন্দ্র এখন রম রম করে চলছে। সঙ্গে চলছে প্যাথোলজি, এক্সরে, ইসিজি, সোনোগ্রাফি, ওষুধের দোকান।
বুঝতেই পারছেন, এখানে সবই হয় অত্যন্ত কম খরচে। কারণ এখানকার ডাক্তাররা মনে করেন রোগ ধরতে বেশি পরীক্ষা লাগে না, চিকিৎসার জন্য লাগে না বেশি ওষুধ। আর দামি ওষুধের তো দরকারই নেই। ডা. গুণের কথায়, ‘ডাক্তারি পড়ানোর সময় শুধুমাত্র পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে রোগ নির্ণয় করতে শেখানো হয় না। শেখানো হয় কীভাবে রোগীর কাছ থেকে তাঁর কষ্ট ও আনুষঙ্গিক তথ্য জানতে হয়, কীভাবে শারীরিক পরীক্ষা করতে হয়। এবং সে সবের মাধ্যমে সম্ভাব্য রোগের তালিকা ক্রমে ছোট করে করে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হয়, যাতে প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে পরীক্ষা ছাড়াই রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হয়। তবে এভাবে ধাপে ধাপে এগোনো বেশ সময়সাপেক্ষ। রোগীর চাপ থাকলে এত সময় দেওয়া সব সময় সম্ভব হয় না। কখনও আবার সময় থাকলেও ডাক্তার অতিরিক্ত দু-পয়সা রোজগারের আশায় তা করেন না। কেউ ভয় পান, কম পরীক্ষা করানোর ফলে যদি কোনও গোলমাল হয় আর রোগী পরে দোষ দেন বা কেস করেন। এ রকম যে হয় না তা নয়। ভাল করতে গিয়ে পরে বিপদে পড়তে হয়েছে, এমন নজির আছে। তবে রোগীর যদি ডাক্তারের উপর আস্থা থাকে ও ডাক্তারের ট্রাক রেকর্ড ভাল হয় সচরাচর এ সব হয় না বা হলেও তা ধোপে টেঁকে না। কাজেই আগেই ভয় পাওয়ার কিছু নেই’।
‘ডাক্তারের উপর আস্থা’, ‘ভয় না পেয়ে চিকিৎসা করা’ ইত্যাদি শব্দগুলির সঠিক অর্থ যে কী, তা এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রে খানিকক্ষণ কাটিয়ে কিছুটা বুঝে গেলাম। ঠিক কী অভিজ্ঞতা হল আমার, তা বলি।
এখানে রোগীর চাপ প্রচুর। কিন্তু তা নিয়ে সমস্যা নেই। কারণ সে চাপ প্রাথমিকভাবে সামলান স্বাস্থ্যকর্মীরা। একটি ছাপানো ফর্ম, হাসি মুখ ও সহৃদয় ব্যবহারকে সঙ্গে নিয়ে। রোগীর নাম-ধাম, বয়স, কষ্ট, ক্রনিক অসুখ আছে কিনা, কী ওষুধ খাচ্ছেন, পরিবারে কার কী অসুখ আছে, মহিলা হলে কটা ছেলে-মেয়ে আছে সব জেনে, রোগীর ওজন, উচ্চতা, নাড়ির গতি, তাপমাত্রা, রক্তচাপ মেপে ফর্ম ফিলআপ করে তাঁরা প্রথমে তা পাঠিয়ে দেন সাধারণ চিকিৎসকের কাছে। তিনি কিছু প্রশ্ন করে, রোগীকে পরীক্ষা করে দেখে তবে প্রেসক্রিপশন লেখেন বা প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠান। এ কাজে ৫-৬ মিনিটের বেশি না লাগলেও আগে থেকে যেহেতু রোগীর সঙ্গে কথা বলা হয়, তাঁরা সন্তুষ্টই থাকেন। আবার রোগের ইতিহাস জানা থাকে বলে কখনও পরীক্ষা না করিয়ে বা সামান্য দু-একটা করিয়েই অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় হয়ে যায়। ‘আজকাল সাধারণ সমস্যা নিয়ে এলেও যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার লম্বা ফর্দ ধরিয়ে দেন কিছু ডাক্তার, আমরা তার বিপক্ষে। কারণ এমন বহু অসুখ আছে যেখানে দু-একটা ওষুধ দিয়ে রোগের গতিপ্রকৃতির দিকে নজর রাখলেই দেখা যায় দু-একদিনে তার প্রকোপ কমতে শুরু করে এক সময় নিজে থেকে ঠিক হয়ে যায়’। জানালেন ডা. গুণ।
স্তম্ভিত হয়ে শুনি, এখানে বাজারের প্রায় অর্ধেক দামে পরীক্ষা হয়। এবং তাতেও লাভ থাকে। কারণ এখানে কমিশন দেওয়ার চল নেই। কিছু পরীক্ষা কলকাতা থেকে করিয়ে আনা হয়। সেই একই কারণে, অর্দ্ধেক দামে। ৩৩ শতাংশ ছাড়ে সিটি বা এমআরআই স্ক্যানের ব্যবস্থা করে দেন তাঁরা। তাছাড়া, রক্ত বা অন্য স্যাম্পল দেওয়ার দেড়-দুঘন্টার মধ্যে রিপোর্ট দেওয়া হয়। ফলে রোগী সে দিনই রিপোর্ট দেখিয়ে ওষুধপত্রের পরিবর্তন করে নিয়ে যেতে পারেন। আরেক দিন ফি দিয়ে ডাক্তার দেখাতে হয় না। সময় ও খরচ বাঁচে।
ওষুধপত্রের ব্যাপারেও তাঁরা সদা-সতর্ক। খুব কম দামের জেনেরিক ওষুধ দেন, যতটুকু না দিলে নয়, ঠিক ততটুকু। ডা. গুণ জানালেন, ‘যে ডাক্তাররা দামি ব্রান্ডের ওষুধ ছাড়া ব্যবহার করেন না, তাঁরা ওষুধের মোড়কের ছোট অক্ষরগুলি পড়ে দেখুন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওষুধ তৈরি হয় অনামী কোম্পানীতে, তাকে বাজারে আনে বড় কোম্পানী। কাজেই কম দামি ওষুধ মানেই খারাপ এ ধারণা ঠিক নয়। জেনেরিক ওষুধেও যে বিরাট সমস্যা আছে এমন নয়’।
যে রোগীকে একাধিক বিশেষজ্ঞ দেখাতে হয়, দিনের শেষে তাঁর সব প্রেসক্রিপশন আসে সাধারণ চিকিৎসকের কাছে। অত ওষুধ একসঙ্গে খেলে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে কিনা তা তিনি দেখেন। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে ওষুধ পাল্টে দেন।
সম্ভাব্য ক্ষেত্রে ওষুধের বদলে চলে ঘরোয়া নিদান। লুজ মোশনে ঘন্টায় ঘন্টায় নুন-চিনি-লেবুর জল, কাশিতে গরম জলের ভাপ, অপুষ্টিতে টনিকের বদলে ঘরোয়া সুষম খাবার, কোষ্ঠকাঠিন্যে শাক-সবজি-ফল-আটার রুটি ও বেশি করে জল খাওয়ার বিধান, সঙ্গে কায়িক পরিশ্রম। এবং তাতেই দিব্যি থাকেন অধিকাংশ রোগী।
হ্যাঁ, দিব্যি থাকেন। কারণ না থাকার স্বপক্ষে কোনও যুক্তি নেই। ডাক্তারি জ্ঞানের সঙ্গে যখন ভালবাসার মিশেল হয়, খরচ কম হয়, ওষুধ-পথ্য তো তখন বলে বলে রোগ সারায়! একেই তো বলে হোলিস্টিক চিকিৎসা।