পাঁচ বছরের বেশি কেটে গেছে। এর মধ্যে শুভাইয়ের স্কুল শেষ হয়ে কলেজও শেষ হবার মুখে। চাকরির চেষ্টাও শুরু করেছে, এমন সময় একটা ভয়ানক ঘটনা ঘটল।
বাবার রক্তের রিপোর্ট ইত্যাদি দেখে ডাক্তার বললেন, হিরুবাবু, আমি বলি কী, আপনি একজন স্পেশালিস্ট দেখান। আমার এইটা… বলে আঙুল দিয়ে একটা সংখ্যা দেখিয়ে বললেন, ভালো ঠেকছে না।
শুকনো গলায় মা জানতে চেয়েছিল, স্পেশালিস্ট বলতে আপনি কীরকম ডাক্তারের কথা বলছেন?
ডাক্তার বলেছেন, আপনারা এদিক ওদিক ডাক্তার না খুঁজে চলে যান নবাঙ্গন মেডিক্যাল সেন্টারে। সবরকম স্পেশালিস্ট ওখানে মজুদ, ঠিক ঠিক চিকিৎসা ওখানেই হবে।
মা ওখানেই প্রায় অজ্ঞান হয়ে যায়। নবাঙ্গন তো ক্যানসার হসপিটাল।
সন্ধেবেলা সব শুনে শুভাই দেরি করল না, পরদিনই দৌড়ল শহর উজিয়ে নবাঙ্গন মেডিক্যাল সেন্টারে। বাবার কাগজপত্র দেখিয়ে কাউন্সিলর মেয়েটির সঙ্গে অনেক কথা বলে বাবার জন্য তিনদিন পরের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েই বাড়ি ফিরল। ইউএসএ-তে ফোন করা হলো। মামা শুনে বলল, একদম ভাববে না, হিরু। আমরা সবাই আছি। আমি রিসার্চ করেছি। নবাঙ্গনের সাকসেস রেকর্ড ভালো। আর, বুবলি, সাহস রাখ। শুভাই কী ডাক্তার ধরেছে দেখেছিস? মৃত্যুঞ্জয় মিত্র! নামেই বন্ধু! তার ওপর কি না মৃত্যুঞ্জয়! আর চিন্তা কী!
তিন দিন পরে দুপুর বারোটায় হাসপাতালের বহির্বিভাগের ওয়েটিং রুমে পৌঁছে জানা গেল ডাক্তার এখনও হাসপাতালের অভ্যন্তর থেকে আসেননি, দেরি হবে। কোনও রোগীর পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। অপেক্ষমাণ অন্য রোগীদের পক্ষে সে খবরটা স্বস্তির বাহক হয়ে এল না।
শেষ পর্যন্ত যখন ওদের ডাক পড়ল তখন ঘড়িতে প্রায় আড়াইটে। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন নার্স, জানতে চাইলেন রোগী কে? বাবাকে ডাক্তারর টেবিলের পাশের একটা টুল দেখিয়ে বললেন — ওখানে গিয়ে বসুন। তারপর মা আর শুভাইকে ডাক্তারর মুখোমুখি দুটো চেয়ার দেখিয়ে বললেন — আপনারা ওখানে।
দরজায় দাঁড়িয়ে শুভাই হঠাৎ একটা ধাক্কা খেয়ে যেন থমকে গেল।
পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে, ভদ্রলোকের চেহারার আপেলোচিত আভা আর আগের মতো নেই, কিন্তু সেই টাক, সেই গাল, সেইরকম একটা সাদা শার্ট, তার সঙ্গে আজ গাঢ় লাল, প্রায় মেরুন, টাই। নতুনের মধ্যে আজ চোখে একটা চশমা। সোনালী রং তারও।
শুভাই কতক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে ছিল জানে না। তবে ডাক্তারর খেয়াল হবার পক্ষে যথেষ্ট। সামনে রাখা ফাইল থেকে মুখ তুলে দরজার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন — আসুন, আসুন… বসুন…
অপ্রস্তুত শুভাই মাথা নিচু করে বসল। মাথা নিচু থাকলে মুখ দেখতে পাবেন না সহজে। এ কী জ্বালা হলো! ওই বদ এবং বদমাশ আপেলচন্দর যে শহরের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রস্টেট সার্জন আর আজ এ ঘরে এভাবে ঢুকতে হবে তা জানলে কি সেদিন তার মাথায় মুখে কাদা মাখাতে যেত শুভাই? বরং জুতোটা দিয়েই আসত।
ডাক্তার বাবা মাকে কত কী বোঝালো, শুভাই কিছু বুঝল না। শোনেইনি ভালো করে। শুনবে কী? মাথায় কোনও চিন্তাই আর বাকি নেই। ডাক্তার খানিক বাদে জানতে চাইল, আপনারা কেউ কিছু জিজ্ঞেস করবেন? বাবা কী জিজ্ঞেস করল, মা-ও। শুভাইয়ের কত প্রশ্ন ছিল, কিছুই জিজ্ঞেস করা হলো না। ডাক্তার বলল — তাহলে আমি একটা প্রশ্ন করি… আপনার যা মেডিক্লেইম দেখছি, তাতে এই অপারেশনের খরচ উঠবে না। বাকি টাকার ব্যবস্থা করতে পারবেন?
বাবা একবার শুভাইয়ের দিকে তাকাল। এসব কথা ওরই আলোচনা করার কথা ছিল। এই সেদিনও কাউন্সেলিং বিভাগের মেয়েটাকে বলে গেছে। কিন্তু এখন সে ছেলে মাথা নিচু করে বসে রয়েছে। বাধ্য হয়ে বাবা বলল — আমার শালা থাকে অ্যামেরিকায়। ও সাহায্য করবে বলেছে। ডাক্তার একটা অস্ফুট হুঁ, বলে অন্য আলোচনায় চলে গেল।
ফেরার পথে ট্যাক্সিতে মা রাগে ফেটে পড়ল।— তুই কী করছিলি ডাক্তারর সামনে বসে? বোবা হয়ে গেছিলি কেন?
ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে ঘুরে শুভাই বলল — মা, ওই ডাক্তারই আপেলবাবু।
এক লহমা সময় লাগল মা-বাবার, তারপরে দুজনের মুখই ফ্যাকাশে বিবর্ণ হয়ে গেল।
রাতে ফোনে সব কথা শুনে মামা গম্ভীর হয়ে গেল। বলল — কী মনে হয়? চিনতে পেরেছে?
মা বলল — কী জানি, কিছু তো বললেন না।
মামা বলল — নাঃ, না চেনার সম্ভাবনাই বেশি। পাঁচ বছর আগে শুভাইয়ের বয়স পনেরো-ষোলো। আজ কুড়ি পেরিয়েছে। অ্যাডাল্ট। দাড়ি রেখেছে একমুখ, তার ওপর আজকাল সবার মুখ ঢাকা মাস্কে। শুধু বেশি কথা না বললেই হলো। কিন্তু যা বুঝছি, হাসপাতাল, আর ডাক্তার, দুই-ই একনম্বর। অন্য কারও কাছে যাবার কথা ভাববি না।
শুভাই বলল — সেই জন্যই আমি মাথা নিচু করে বসেছিলাম, কথা প্রায় বলিইনি। ভাবছি এর পরে খুব প্রয়োজন না হলে ডাক্তারর মুখোমুখিই হব না।
অপারেশন হলো। জ্ঞান ফিরল যথানিয়মে। কয়েক ঘণ্টা পরে ডাক্তার এল, বাবা কেমন বোধ করছে জেনে নিয়ে মাকে বলে দিল কী কী করনীয়। বেরোবার আগে জানতে চাইল — ছেলেকে দেখছি না? আসেনি?
সেই প্রথম দিনের পরে ডাক্তার আর শুভাইকে দেখেনি। বাথরুমের প্রায় বন্ধ দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে শুভাই ভাবল, হয়ত ভাক্তারবাবু ওকে ক্যালাস দায়িত্বজ্ঞানহীন সন্তান মনে করছে, কিন্তু কিছু করার নেই।
বাবা সুস্থ হয়ে উঠছিল কোনও সমস্যা ছাড়াই। রোজ আসে ডাক্তার, মায়ের সঙ্গেই কেবল দেখা হয়।
নির্দিষ্ট দিনেই ডাক্তার জানাল পরদিন ছুটি।
সকাল থেকে তোড়জোড়। এ ক’দিন শুভাই রাতে পেশেন্টের বাড়ির লোকের অপেক্ষা করার হলে রাত কাটিয়েছে। বড়োমামার কল্যাণে বাবা কেবিনে ভর্তি থাকলেও হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী সঙ্গে কেবল একজনই থাকতে পারে। মা এটা সেটা ভাঁজ করে ব্যাগে ঢোকাচ্ছে, শুভাই যা যা দরকার এগিয়ে দিচ্ছে, এমন সময় দরজায় টোকা দিয়ে ঢুকল নার্স। শুভাইয়ের দিকে চেয়ে জানতে চাইল — আপনি তো পেশেন্টের ছেলে, তাই না?
তাই। ঘাড় হেলাল শুভাই। হঠাৎ ওর একটু ভয় ভয় করে উঠল।
— আসুন, বলে নার্স ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
কোনও প্রশ্ন না করে হাসপাতালে নানা হুকুম মানায় ওরা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তা-ও ঘর ছেড়ে বেরোনোর আগে চট করে একবার মা-বাবার দিকে চাইল শুভাই। মা-র মুখ ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে।
শুভাইয়ের বুকও দুরদুর করতে শুরু করেছে। ছুটে গিয়ে নার্সের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বলল — কী হয়েছে?
নার্স কিছু-তো-হয়নি ভাব করে বলল — স্যার ডেকেছেন।
স্যার! মানে, আপেল-ডাক্…
— ডাঃ মিত্র? কেন?
নার্স জানে না। ডাঃ মিত্র আজ তাড়াতাড়ি হাসপাতালে এসে বলেছেন রোগীর ছেলেকে ডেকে দাও, ব্যাস।
শুভাই ভাবছে ডাক্তার জানল কী করে শুভাই রয়েছে হাসপাতালে বাবার কাছে? নিজের চোখে তো একদিনও দেখেনি? তারপরেই চিন্তাটা ঘুরে গেল। কী এমন খবর দেবে ডাক্তার, যে ছেলেকে আলাদা করে ডাকতে হলো?
হাসপাতালটা বিশাল। ইনডোর থেকে বেরোনোর দরজার কাছে পৌঁছাতেই দু মিনিট হাঁটতে হয়। নার্সিং স্টেশনে পৌঁছে নার্স বলল — স্যারের ঘরটা চেনেন তো?
আউটডোরে? হ্যাঁ। ও ঘরেই আগের দিন ডাক্তার বাবাকে দেখেছিল। শুভাই ইনডোর থেকে বেরিয়ে এসে আউটডোরে পৌঁছে ডাক্তারের ঘরের দরজায় দাঁড়াল। বহির্বিভাগেরর পক্ষে সকাল আটটা খুব সকাল। বাইরে রোগী সমাগম অবশ্য শুরু হয়েছে, কিন্তু ভেতরে, যেখানে ডাক্তারদের ঘর, সেটা জনশূন্য। আজ আগের দিনের মতো ঘরের সামনে নার্স নেই। দরজায় লাগানো কাচের ফোকর দিয়ে চট করে উঁকি দিয়ে দেখল ডাক্তার বসে কম্পিউটারে কী করছে। দরজায় টোকা দিয়ে কান খাড়া করে রইল, ডাক্তার ডাকলে পুরু দরজা ভেদ করে শুনতে পাবে তো?
ভেতর থেকে দরজাটা খুলে ডাক্তার নিজেই বলল — এসো।
ডাক্তার আর শুভাই। আর কেউ নেই। ডাক্তার ওকে বসতে বলে বলল — একেবারে ঘেমে নেয়ে গেছ।
প্রশ্ন নয়, কিন্তু ডাক্তার মাস্কের ওপর দিয়ে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন, তাই বাধ্য হয়ে বলল — না, মানে অনেকটা দূর তো, আর করিডোরগুলো তো এ-সি নয়…
ডাক্তার একটা কাগজের ছোটো গ্লাসে একটা বোতল থেকে জল ভরে বাড়িয়ে দিয়ে বলল — তা ছাড়া খুব টেনশনও হয়েছে… হঠাৎ আমি ডাকলাম… জল খাও।
শুভাই আগুপিছু না ভেবে মুখ থেকে মাস্কটা নামিয়ে জল খেতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল করল, ডাক্তার ওর দিকে নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে আছে। এই যা! খেয়াল না করে মাস্কটা নামিয়ে ফেলেছে। তাড়াতাড়ি জল খাওয়া শেষ করেই মাস্কটা টেনে তুলল আবার। ডাক্তার বলল — তোমরা তিনজনই মাস্ক-এটিকেটের ব্যাপারে খুব সচেতন। আমি দেখেছি। আমরা ডাক্তাররাও এতটা নই… কোভিড পেরিয়ে যাবার এতদিন পরেও – খুব ভালো।
শুভাই বলল — আসলে বাবার অসুখটার পরে আরও…
ডাক্তার বলল — তোমার বাবার ফাইলে দেখেছি ২০২০-র এপ্রিল-মে মাসেই কোভিড হয়েছিল। তোমাদের…?
শুভাই বলল — বাবার ফার্স্ট ওয়েভেই হয়েছিল। কপাল করে আমাদের হয়নি। তখন তো একজনের হলে বাড়িসুদ্ধু সবার টেস্ট হত…
ডাক্তার ফাইল দেখতে দেখতে বলল — মাইল্ড ইনফেকশন ছিল। কম্পলিকেশন কিছু হয়নি, আর পোস্ট কোভিড সিমটম বা ইনভেস্টিগেশন ফাইন্ডিংও কিছু ছিল না। কপাল খুব ভালো।
কপাল ভালো? এই ক্যানসার হসপিটালে আসতে হত কপাল ভালো হলে?
ডাক্তার এবার কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে বলল — তোমার বাবার কপাল শুধু যে কোভিডের ক্ষেত্রেই ভালো, তা নয়। প্রস্টেটের ক্ষেত্রেও ভালো।
এক মুহূর্ত লাগল শুভাইয়ের কথাটা বুঝতে। তারপর বলল — তার মানে ক্যানসার নয়?
— না। মাথা নাড়ল ডাক্তার। — ক্যানসার নয়। বায়পসি হয়েছে, কিন্তু আমাদের ডিরেক্টর বলেছেন আবার রিপিট করতে… আমি তো ক্যানসার প্রস্টেট ছাড়া অপারেশন করি না, তাই ভেবেছেন যদি ভুল হয়ে থাকে… তবে আমার ধারণা ক্লিয়ারই আসবে। তবু, সাবধানের মার নেই। রিপোর্টটা আসতে কিন্তু এর ফলে দেরি হবে।
হোক দেরি… কিন্তু আর একটা সমস্যা যে রয়ে গেল!
— তাহলে… ওই পিএসএ…
ডাক্তার বলল — প্রস্টেট ক্যানসার হলে পিএসএ বেশি হয়, কিন্তু পিএসএ বেশি মানেই প্রস্টেট ক্যানসার নয়।
এটা গুগ্ল্ করে আগেই জানতে পেরেছিল শুভাই। বলল, তাহলে…
ডাক্তার বলল — তাহলেই যে তোমরা একেবারে চিরদিনের মতো নিশ্চিন্ত তা কিন্তু নয়। নিয়মিত ফলো আপ-এ থাকতে হবে। কিন্তু আপাতত ভয় পাবার কিছু নেই।
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল যেন। গায়ে ঘামটা শুকোচ্ছে, এয়ারকন্ডিশনে শীত শীত করছে শুভাইয়ের। বলল — আর কী কী সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে?
এর পর সাধারণ কথাবার্তাই হলো। আবার নতুন করে শুভাই উপলব্ধি করল কেন এই ডাক্তার সম্পর্কে ইন্টারনেটে কেবল ভালো কথাই লেখা। ভাবতেও অবাক লাগে, এই লোকটাই ছোঁ মেরে ওর জুতোজোড়া চুরি করতে চেয়েছিল!
শেষে ডাক্তার বলল — বায়পসি রিপোর্ট রেডি হলে হাসপাতাল থেকে ফোন করবে।
ঘাড় নেড়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে মনের মধ্যে ঘুরতে থাকা প্রশ্নটা করেই ফেলল শুভাই।
— কিছু যদি মনে না করেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।
ডাঃ মিত্র কলিং বেলের সুইচের দিকে হাত বাড়াচ্ছিল। থমকে তাকিয়ে বলল — কী?
— আমি শুনেছিলাম আপনি প্রস্টেট ক্যান্সার প্রমাণিত না হলে অপারেশন করেন না। ডাঃ ফার্নানডেজকে রেফার করেন। আপনিও এক্ষুনি সে কথাই বললেন। তাহলে বাবার ক্ষেত্রে ফাইন নিডল অ্যাস্পিরেশন বায়োপসি না করে সরাসরি অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নিলেন কেন?
ডাঃ মৃত্যুঞ্জয় মিত্র আস্তে আস্তে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বলল — তোমার প্রশ্নটার জবাব… তারপর হঠাৎ পায়ের দিকে আঙুল তুলে বলল — ওটাই কি ওই জুতোজোড়া?
শুভাইয়ের হাত থেকে মোবাইল ফোনটা পড়ে গেল। ভাগ্যিস, জুতোর ওপরেই পড়েছিল।
আপেল ডাক্তার মৃত্যুঞ্জয় মিত্রর সামনে শুভাই কখনোই স্বচ্ছন্দ বোধ করেনি, কিন্তু এতক্ষণ নানা কথার ফলে ও একটু যেন স্বাভাবিক হয়েছিল। কিন্তু ঠিক বেরোবার মুখে ডাক্তার এমন একটা বোমা ফাটাবে কে জানত!
কী বলবে শুভাই? কী করবে?
যেটা করল এবং বলল, সে কাজটা করার কথা ও গত পাঁচ বছরে একবারের জন্যও ভাবেনি। হঠাৎ হাঁটু গেড়ে ডাক্তারর সামনে বসে পড়ে বলল — আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি অত্যন্ত অভদ্রতা করেছিলাম আপনার সঙ্গে।
শুভাইয়ের এই প্রতিক্রিয়ায় শুভাই নিজে যতটা বিস্মিত হয়েছিল, ডাঃ মিত্রও ততটাই। হতবিহ্বল স্বরে বলল — তুমি? তুমি ক্ষমা চাইছ আমার কাছে! কেন?
কেন? ডাক্তার কি শুভাইয়ের সঙ্গে তামাশা করছে? সেদিন শুভাই কী করেছিল, তা কি লোকটা ভুলে গেছে, না ইচ্ছে করে শুভাইকে দিয়ে কবুল করাতে চাইছে? কেনই বা?
শুভাই উঠে দাঁড়াল। বলল — আপনাকে অভদ্রের মতো আক্রমণ করা আমার উচিত হয়নি… হাজার হলেও আপনি…
শুভাইয়ের কথা কেটে ভদ্রলোক বলল — হাজার হলেও আমি তোমার সঙ্গে অত্যন্ত অভদ্র আচরণ করেছি, তোমাকে অপমান করেছি, মায় তোমার কেনা জুতোজোড়া চুরি করার চেষ্টা করেছি। অথচ আজ তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাইছ, যদিও চাওয়ার কথা তোমার কাছে আমার।
ঠিক কথা। তা সে ক্ষমা চাইবে কি ভদ্রলোক? না কি এটাকেই ক্ষমা চাওয়া বলে ধরে নিতে হবে শুভাইয়ের? বড়োরা তো অনেক সময়েই ক্ষমা চাওয়ার ঊর্ধ্বে বলে মনে করেন নিজেদের। তার ওপরে এ কেবল ডাক্তার নয়, বিখ্যাত ডাক্তার, আর শুভাইয়ের বাবার জীবন উনিই একরকম ফিরিয়ে দিয়েছে বলে আত্মীয়স্বজন মনে করছে এর মধ্যেই।
শুভাই এসব কথা ভাবছিল বলে কিছু বলেনি। ডাক্তার মিত্র আবার বলল — আমি সেদিনের পরে বহুবার সে দোকানে গিয়েছি। খোঁজ করেছি তোমার। দোকানে তোমার নামে একটা অ্যাকাউন্ট করে দিতে চেয়েছিলাম, যাতে পরে তুমি যদি যাও, ওরা আমার সে অ্যাকাউন্ট থেকে তোমাকে জুতো দেবে… ওরা করেনি। ওদের কাছে খদ্দেরের নাম-ঠিকানা থাকে না। আমার পরিচিত সেই সেলসম্যানকে বলেছিলাম… ওর বাবার চিকিৎসা করেছিলাম একসময়, তাই… বলেছিলাম, যদি তোমাকে দেখতে পায়, তোমার কাছ থেকে ঠিকানা, ফোন নম্বর চেয়ে নিতে — যাতে আমি নিজে তোমার কাছে যেতে পারি…
এখনও শুভাই কিছু বলতে পারছে না। এত বছর পরে হঠাৎ সেই বয়ঃসন্ধির অভিমান আর রাগটা উঠে আসছে। কোথায় ছিল এই অভিমান আর রাগ? দোকান থেকে কোনও রকমে ম্যানেজ দেওয়া জুতোটা… যার রঙটা আর আগের মতো উজ্জ্বল হরিণের চামড়ার মতো নয়, বরং কেমন কেমন কালচে মেরে যাওয়া… দেখে যে রকম শোক উথলে উঠত, কান্না পেত, হাত মুঠো হয়ে আসত… সেরকম কেন লাগছে আবার?
খানিকটা নিজেকে সামলাতেই আবার দরজার দিকে ফিরল শুভাই। বলল — আসি… আর কিছু বলতে পারল না, ভেতর থেকে উঠে আসা একটা অনুভূতি গলার কাছে দলা পাকিয়ে গেল।
ডাক্তার একটু অবাক হয়েই বলল — আসবে? সেদিন আমি যা করেছিলাম, কেন করেছিলাম, তা জানতে চাইবে না?
জানতে চাইবে? কৈফিয়ত? এর আগে যদি দেখা হত, অন্য পরিস্থিতিতে যদি দেখা হত, অবশ্যই জানতে চাইত শুভাই। হয়ত কলার ধরেই জানতে চাইত। কিন্তু… এখন… এই অবস্থায়… শুভাই কী কৈফিয়ত চাইবে? কী ভাষায় চাইবে?
— আমি জানতে চাই না কিছু। আপনি আমার বাবার জন্য যা করেছেন, তারপরে আমার আর কিছু জানার অধিকার আছে বলে আমি মনে করি না… কথাগুলো মনে মনে একবার আউড়ে নিয়ে শুভাই ডাক্তারর দিকে ফিরতেই থমকে গেল। একটা কথাও বলা হলো না। ডাক্তার উঠে দাঁড়িয়েছে। দু-চোখের ভাষায় এমন এক অসহায় আকুতি, যে শুভাই চুপ করে চেয়ে রইল কেবল।
ডাক্তার হাত দিয়ে চেয়ারটা দেখাল। যন্ত্রচালিতের মতো শুভাই বসে পড়ল আবার। ডাক্তার ঘরের দূরের দেওয়াল অবধি হেঁটে গিয়ে বেসিনের কল খুলে হাত ধুল, চোখেমুখে জল দিল, তোয়ালে দিয়ে হাত মুছে আবার ফিরে এল নিজের চেয়ার।— তোমার বয়স কত এখন?
— কুড়ি পূর্ণ করেছি। একুশ হবে আর কিছুদিন পরে।
— রুকুর জন্ম তোমার এক বছর পরে।
রুকু কে আবার? ডাক্তার শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে আছে নিজের টেবিলের দিকে। তারপর মুখ তুলে তাকাল ওর দিকে। বলল — আমার ছেলের নাম রুকু। তোমার চেয়ে এক বছরের ছোটো।
তারপরে আবার চুপ। একটু পরে বলল — আমার একমাত্র ছেলে। বড়ো আদরের। ওর সব চাওয়া আমি পূর্ণ করতাম। ওকে না দেবার মতো কিছুই ছিল না আমার।
করতাম…? ছিল…? তাহলে কি…
ডাক্তার বলল — তা বলে ভেবো না, বড়োলোক বাবার লাই-পাওয়া বখা ছেলে ছিল। খুব সমঝদার, ঠাণ্ডা মাথা, বুদ্ধিমান ছেলে ছিল। একবার শুভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল — আমার ধারণা তোমার মতো। তোমাকে দেখেও ওরকমই মনে হয়। হি ওয়াজ আ জেম অফ আ বয়।
ওয়াজ… এবারে শুভাইয়ের মুখটা শুকনো লাগতে শুরু করেছে।
জানো, কত লোকের ক্যানসার সারিয়েছি। কত লোককে মৃত্যুর মুখ থেকে ছিনিয়ে এনেছি। আমার নাম মৃত্যুঞ্জয়। রোগীরা বলে, সার্থকনামা। তোমরা খেয়াল করোনি, আমার নাম মৃত্যুঞ্জয়? করেছ? সবাই করে। মৃত্যুও করেছিল। আমার কর্মফল, আমার অহঙ্কারের ওপর তাই কালি মাখিয়ে গেল। যে রোগ নিয়ে আমি সারা জীবন লড়াই করেছি, সেই ক্যানসার-ই হলো রুকুর। ভয়ানক একরকমের বোন ক্যানসার।
পাথরের মতো বসে আছে শুভাই। ওর কানের ভেতর হালকা রি-রি-রি-রি শব্দ হচ্ছে।
— অল্প বয়সের ক্যানসার, সাধারণত মারাত্মকই হয়। রুকুর ক্ষেত্রেও অন্যথা হলো না। এই হাসপাতালেই দিন গুনছিলাম আমরা। হঠাৎ একদিন বলল, জানো বাবা, তুমি আমার সারা জীবনের সব সাধ আহ্লাদ মিটিয়েছ। শুধু একটা বাদে।
সাটা কম্পানির ওই জুতোর লোভ ছিল রুকুর বহুদিন। যখন বড়ো হচ্ছে, তখন দিইনি। বলেছি, তোর পা যে হারে বাড়ে, বছরে দুটো, কখনও তিনজোড়া জুতো লাগে। অত দামী জুতো কিনবি যখন পা আর বাড়বে না, তখন। সেদিন কিন্তু জুতোর কথা কেবল বলেছিল। চায়নি। ঠাট্টা করছিল বাবার সঙ্গে। তখন রুকুর শেষ অবস্থা। জুতো কিনে দিলেও পরার উপায় নেই। কাগজে বিজ্ঞাপন দেখেই বলেছিল। সেদিন ছিল আমার আউটডোর। হাসপাতাল থেকে বেরোনোর উপায় নেই। ড্রাইভারকে বলেছিলাম, জুতোর দোকানে গিয়ে নিয়ে আসতে। ড্রাইভারটা খুব ওস্তাদ। সাটা কম্পানির যে দোকানে যেতে বলেছিলাম, সেখানে যায়নি। গিয়েছিল অন্যটায়। সেখানে তখনও এসে পৌঁছয়নি সে জুতো। এমন সময় বৃষ্টি শুরু হয়, বৃষ্টির ধারা দেখে ও আর অপেক্ষা করেনি। ভেবেছিল, জুতো তো, পরে কিনলেই চলবে। তার পরের তিন দিন তো শহরই অচল হয়ে গেছিল বৃষ্টিতে।
তিন দিন পরে, সেদিন রুকুর অবস্থা ভালো নয়। ব্যথার ওষুধের ইনজেকশনের প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে, আমার হঠাৎ মনে পড়ল। কী মনে হলো, ওই জুতোজোড়া আমার রুকুর জন্য কিনে আনতেই হবে। বাবা হয়ে ছেলের শেষ ইচ্ছেটা পূর্ণ করতে পারব না! এইটুকুই ভেবেছিলাম। যেটা ভাবিনি, তা হলো সে জুতো কিনতে পারলেও রুকু তো পরবে না। পারবেই না। ভাবিনি, যে আমি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেলে রুকুকে আর দেখতে পাব না। এবারে অসহায়ের মতো কাঁদতে আরম্ভ করলেন মৃত্যুঞ্জয় মিত্র। বললেন — আর দেখতে পাইনি। হাসপাতালে ফিরবার আগেই রুকু চলে গিয়েছিল। আমি ওকে শেষ দেখা-ও দেখতে পাইনি।
কোনও রকমে আত্মসম্বরণ করে টেবিলের পাশে রাখা টিশ্যুর বাক্স থেকে একটা টিশ্যু নিয়ে চোখ মুছলেন। শুভাইয়ের চোখে চোখ রাখলেন। বললেন, আমাকে ক্ষমা কোরো।
দুজনে কতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল শুভাই বলতে পারবে না। হঠাৎ দরজায় টোকা দিয়ে নার্স ঢুকে এল। তার স্বরে বিস্ময়ের সুর।— দু’জন পেশেন্ট এসে গেছে, স্যার।
শুভাই উঠে টেবিলটা বেড় দিয়ে মৃত্যুঞ্জয় মিত্রর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। অনুভব করল, এক লহমার জন্য ডাক্তার ওর মাথায় হাত রাখলেন।
ঘর থেকে বেরিয়ে খেয়াল হলো, মা বাবা নিশ্চয়ই উৎকণ্ঠিত হয়ে রয়েছে। পা চালাল ইনডোরের দিকে।
হাসপাতালের ফাইনাল বিলটা পেয়েই মামা ফোন করল। কী ব্যাপার? এ তো অনেক কম বিল করেছে! ওরা যে এস্টিমেট দিয়েছিল, তার চেয়েও কম। পেমেন্ট করে দিয়েছি, এখন না বলে আরও দিতে হবে।
মা বলল — না, না। সে হবে না। ডাক্তার কমিয়ে দিয়েছেন। এখন না, আগে বাড়ি যাই… সন্ধেবেলা ফোন করিস, সব বলব।
~শেষ~