শুভাই যেদিন প্রথম ভদ্রলোককে দেখেছিল, সেদিন যদি জানত কী হতে চলেছে তাহলে কখনোই ঝামেলায় জড়াত না। এমনিতে শুভাই মাথা গরম ছেলে নয়, কিন্তু বয়সেরও তো একটা ধর্ম আছে, সে যাবে কোথায়! আর বয়স্ক একজন লোকের তুলনায় তিনিও যেটা করেছিলেন সেটা কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
প্রথম থেকে না বললে ব্যাপারটা বোঝা যাবে না। দিনটা ছিল মহালয়ার আগের দিন। তার আগে কয়েক দিন প্রবল বৃষ্টির পরে সবে রোদ উঠেছে। ফলে পুজোর বাজারের থেমে থাকা ভীড় আরও ছাপিয়ে উঠে দোকান থেকে ফুটপাথ, ফুটপাথ থেকে রাস্তায় নেমেছে। শুভাইও সেই ভীড়েই সামিল, কিন্তু আর পাঁচজনের পুজোর বাজারের মতো বাজার করা ওর উদ্দেশ্য ছিল না। শুভাই গেছিল একজোড়া জুতো কিনতে। সাটা ফুটওয়্যার কম্পানি প্রতি বছর পুজোয় নানা নতুন ডিজাইনের জুতো বের করে, তার মধ্যে একটা ডিজাইন ওরা নিজেরাই বলে সে বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ — সেটা ওরা ওই পুজোর সময়েই মাত্র কয়েকটা আনে, বিক্রি হয়ে গেলে আর সে জুতো পাওয়া যায় না। কোনও দিনই না। শুভাইয়ের বহু বছরের সাধ অমন একটা জুতো কেনে। ওর ক্লাসের শরদিন্দু প্রত্যেক বছর ওই জুতো পরে আসত পুজোর পরেই। বলত, এমন আরামের জুতো নাকি হয় না। একবার, শুভাইয়ের জুতোর মাপ আর ওর জুতোর মাপ এক জেনে বলেছিল — পরে দেখবি? বেশ, আজ স্কুলের পরে মাস্টারদা পার্কে…
স্কুলের পরে দুজনে হেঁটে হেঁটে গেছিল পার্কে। জুতো পায়ে দিয়ে শুভাইয়ের মনে হয়েছিল জীবন বুঝি ধন্য হয়ে গেল। এতদিন শরদিন্দুর কথা শুনে ভাবত, বাড়াবাড়ি। কী এমন আহামরি জুতো হতে পারে, যার জন্য এত আহা-উহু করতে হবে? কিন্তু পায়ে দিয়ে বুঝেছিল এ জুতো পায়ে হাঁটার অনুভূতিই আলাদা হবে। এর তুলনা নেই।
শরদিন্দুর বাবা বড়ো ব্যবসায়ী, শুভাইয়ের বাবা সরকারি কেরানি। সংসার অসচ্ছল নয়, কিন্তু ওই জুতো আবদার করেও বাবার কাছে চাওয়া যাবে না। আহ্লাদ করেও না। গত বছরই বাবা মাধ্যমিকের রেজাল্ট দেখে বলেছিল — কী নিবি? উত্তরটা জিভের আগায় এসে গেছিল প্রায়। কোনও রকমে নিজেকে সামলে শুভাই বলেছিল — কিছু না, বাবা। বাবা অবশ্য শুভাইকে চমকে দিয়েছিল অফিসের কোনও বড়সাহেবের ছেলের পুরোনো ল্যাপটপ-টা কিনে এনে। কিন্তু সে আনন্দও কতদিন টিঁকল? পরের মাসেই পিসির অপারেশনটা করাতেই হলো…
তাই এবছর যখন বড়োমামা নিউ জার্সি থেকে ফোন করে বলেছিল — শুভাই, এবার কিন্তু দুবছর পরে যাচ্ছি। একটা জম্পেশ গিফট নিয়ে যাব, কী চাই বল? তখন শুভাই লজ্জার মাথা খেয়ে বলেছিল — এখন না। এসো, তখন বলব।
তা মামা এসেছে চার দিন হলো। বাড়িতে হইচইয়ের বন্যার মধ্যেই আকাশ ভেঙে নামল প্রলয়ের বৃষ্টি। তিন দিন কেউ বাড়ি থেকেই বেরোতে পারল না। মামা অবশ্য প্রথম দিনই সুটকেস খুলে বলেছিল — দেখ সবার জন্য কিছু না কিছু আছে, একমাত্র তোর জন্যই কিছু আনতে পারিনি। কী চাইছিলি বলবি?
তারপর শুভাইয়ের চাহিদা শুনে, কাগজের বিজ্ঞাপনটা দেখে বলেছিল — এই জুতো? এই দাম? আগে বলবি তো! ওখান থেকে আরও দামী, আরও সুন্দর নিয়ে আসতাম। পকেট থেকে কড়কড়ে নতুন নোট বের করে বলেছিল — যা, বিষ্টি থামলেই গিয়ে নিয়ে আসবি।
তা সে বৃষ্টি থামল তিন দিন পরে… এই তিন দিন শুভাই ভলো করে খেতে পর্যন্ত পারেনি। বৃষ্টির তোড় একটু কমলেই জানলায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ভরসার ব্যাপার এই, যে এমন প্রলয়ঙ্কর বৃষ্টিতে দোকান নিশ্চয়ই খোলেনি, তাই জুতো দোকানে এসে থাকলেও সে নিশ্চয়ই বিক্রি হয়ে যায়নি।
চার দিনের দিন সকালে বৃষ্টি থেমে রোদ বেরোল। তখুনি জুতো কিনতে যাবার ইচ্ছে শুভাইয়ের, কিন্তু আজ আবার ক্লাস টেস্ট। স্কুল যাবার পথে চলন্ত বাস থেকে উঁকি দিয়ে দেখল দোকান খুলছে। শাটার টেনে তুলছে কর্মচারীরা।
মন দিয়ে পরীক্ষাও দেওয়া হলো না। খালি মনে হচ্ছে, যদি শেষ হয়ে যায়? স্কুল ছুটি হওয়ামাত্র ছুটল বাড়ির দিকে। মনে মনে ঠাকুর-ঠাকুর আওড়াতে আওড়াতে। মা সকালবেলা অতগুলো টাকা পকেটে নিয়ে স্কুল যেতে দেয়নি। বিকেলের মধ্যেই সাটা ফুটওয়্যার কম্পানির দোকানে বেশ ভীড়। এক ছুটে বাড়িতে ঢুকে ব্যাগপত্তর নামিয়ে, মায়ের — পরীক্ষা কেমন হলো?-র উত্তরে — ভালো! বলে ড্রয়ার থেকে মামার দেওয়া টাকা বের করে নিয়ে — এসে খাব, বলে দৌড়ল জুতো কিনতে।
দোকানে তখন আরও বেশি লোক। সেলসম্যানেরা ভীড় সামলাতে হিমসিম। শুভাই কোনও রকমে একজন কমবয়সী সেলসম্যানকে ধরে জানতে চাইল জুতোটা পাওয়া যাবে? ছেলেটা ওকে আপাদমস্তক দেখল। বোধহয় বিশ্বাসই করতে পারছিল না শুভাইয়ের মতো কেউ ওই জুতো কিনতে এসেছে। শেষে জানতে চাইল — সাইজ? শুভাই বলল, ছেলেটা ভুরু কুঁচকে পা মাপার স্কেলটা নিয়ে এসে বলল — আপনার? দেখি?
জুতোর মাপ শুভাই ঠিক বলেছে দেখে সেলসম্যান ছেলেটা — এই সাইজ পাওয়া মুশকিল… বলে ভেতরে ঢুকল। ওর ফিরে আসার পথ চেয়ে চাতকের মতো বসে রইল শুভাই।
আসে না, আর আসে না। শুভাই একটু ভয় পাচ্ছে… খুঁজে পেতে যত সময় যায়, ততই পাওয়ার সম্ভাবনা কমে আসে। শেষে, যখন শুভাই ভাবছে অন্য কোনও সেলসম্যানকে জুতোর কথা বলবে কি? তখনই ছেলেটা বেরিয়ে এল, বীরদর্পে, হাতে একটা জুতোর বাক্স। কাছে এসে বলল — বাপরে! যা গেল! একে ওখানে এসি নেই, তায় কাস্টমারের চাপে সেলসম্যানরা খালি ভীড় করছে, তার ওপর কে আবার এই লাস্ট জোড়াটা ভুল জায়গায় রেখেছে এসেছে!
শুভাই নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। লাস্ট জোড়া! বলল — এই শেষ? আর নেই! খুব কপাল ভালো আমার।
ছেলেটা বলল — সে আর বলতে! এই মাপের জুতো এসেছিলই মাত্র তিন জোড়া। নেহাত আমি একটু আগে ওখানে গিয়ে এর আগের জোড়াটা নিয়ে এসেছি! এমনিতে এ মাপের জুতো সপ্তাহে একটা বিক্রি হয় কি না সন্দেহ। তা এর মধ্যেই দুটো বিক্রি হয়ে গেল? তাই খুঁজে দেখি ভীড়ের চাপে অন্যদিকে সরে গেছে।
দস্তুরমতো জুতো পায়ে দিয়ে শুভাইকে সন্তুষ্ট করে ছেলেটা আবার বলল — এই সাইজের জুতোর খদ্দের কম, তাই দোকানে থাকে কম। এই তো, দেখুন না, এটাই, মাত্র তিন জোড়া এসেছিল।
বিল বানিয়ে শুভাইকে বলল — পেমেন্ট করে ডেলিভারি কাউন্টারে যান…
শুভাই গিয়ে লাইনে দাঁড়াল। ভীড় থাকলে কী হবে, সাটা কম্পানির কর্মচারীরা খুব হাত চালিয়ে কাজ করছে। এখন আর কিছু করার নেই বলে এদিকে ওদিকে চেয়ে দেখছিল অন্যান্য খদ্দেরদের হাবভাব, সেই জন্যই ভদ্রলোকের হন্তদন্ত আগমন চোখে পড়েছিল। অন্যান্য খদ্দেরদের তুলনায় ওঁর চেহারাতেই এত বিশেষত্ব ছিল, যে চট করে চোখ সরাতে পারেনি।
সাধারণ হাইট, কিন্তু মাথাজোড়া চকচকে টাক, শুধু টাক নয়, এই বিকেলবেলাতেও একেবারে মসৃন করে কামানো গালও একই রকম চকচকে। মোটের ওপর চেহারাটা দেখলেই দোকানে সাজানো আপেলের কথা মনে হয়। পরণে একেবারে বরফের মতো সাদা শার্ট, তার বোতামগুলো কেমন চকচকে। গলায় গাঢ় নীলরঙা টাই। সাটা কম্পানি সস্তা থেকে দামী জুতো সবই বানায়, তাই নানা বর্গের লোক রয়েছে দোকানে, কিন্তু শুভাই আর একজনও টাই-পরিহিত খদ্দের দেখতে পেল না। টাই-ক্লিপ আর কাফ-লিঙ্কের হলদে রঙটা কি সোনা, না কেবল সোনালী? কে জানে!
কেবল চেহারা নয়, ভদ্রলোকের হাবভাবও নজরকাড়া। প্রথমত দোকানে ঢুকলেন কেমন দিশাহারা উদভ্রান্তের মতো। চকিতে নিজেকে সংযত করে চারিদিকে চেয়ে দেখলেন। জুতোর দিকে নয়, মানুষের দিকে। যেন কাউকে খুঁজছেন। ততক্ষণে আচরণে উদভ্রান্ত ভাবটা কেটে একটা আত্মসচেতনতা আর আত্মম্ভরিতা প্রকাশ পেতে আরম্ভ করেছে।
লাইন এগোচ্ছে, শুভাই এখনও চারজনের পরে, এমন সময় ভদ্রলোক তাঁর কাঙ্খিত বস্তু, না… ব্যক্তিকে দেখতে পেলেন। একজন মাঝবয়েসী সেলসম্যান। দূর থেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে বিফল হয়ে কাছে গিয়ে কিছু বললেন। সেলসম্যান তখন অন্য কাউকে জুতো দেখাচ্ছিল, কিন্তু এঁকে দেখেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে খদ্দেরকে বসিয়ে রেখেই এমন তড়িঘড়ি ভেতরে চলে গেলেন, যে শুভাই অবাক না হয়ে পারল না। কে এই কেউকেটা ব্যক্তি, যে একজন খদ্দেরকে বসিয়ে রেখে সেলসম্যান এঁর কাজ করতে ছোটে?
ক্যাশ কাউন্টারে শুভাইয়ের আগের জন টাকা দিচ্ছে। এরপর ওর পালা। বিলটা দিল শুভাই, ক্যাশিয়ার হাত বাড়ালেন, শুভাই টাকা দিল। টাকা গুনে ড্রয়ারে ঠিক জায়গায় ঠিক নোট রেখে শুভাইকে খুচরো ফেরত দিলেন ক্ষিপ্র গতিতে। তারপর বিলের কাগজে রবার স্ট্যাম্প দিয়ে ছেপে দিলেন: পেইড। বিলটা শুভাইকে ফেরত দিয়ে ক্যাশমেমো ছিঁড়ে পাশে দাঁড়ানো প্যাকিং করার ছেলেটাকে দিয়ে শুভাইকে বললেন — ওখানে যান। ওই এক নিশ্বাসেই পরের খদ্দেরকে বললেন — আসুন।
শুভাই পাশের কাউন্টারে গিয়ে পেইড ছাপ দেওয়া বিলটা দিল। ডেলিভারির ছেলেটা কাগজ নিয়ে নম্বর মিলিয়ে বাক্স বের করে ঢাকনা খুলে শুভাইকে দেখাল। শুভাই জুতো চিনল, এটাই সে চেয়েছিল বটে। আবার বাক্সবন্দি হলো জুতো। এবার বাক্সটা একটা ব্যাগে ভরে ক্যাশমেমো সহ শুভাইকে দেওয়াটুকু বাকি, এমন সময় দোকানের খদ্দের বিক্রেতার সম্মিলিত কোলাহল ছাপিয়ে একটা গলা শোনা গেল— আমি স্পেশাল জুতোর একটা বারো নম্বরের জোড়া দাগ দিয়ে রেখে গেছিলাম, কে সরিয়েছে?
দোকানটা কেমন এক লহমায় স্তব্ধ হয়ে গেল যেন। শুভাই তাকিয়ে দেখল, ওকে যে ছেলেটা জুতো বিক্রি করেছিল, সে বসে অন্য কারও পায়ে জুতো পরাতে পরাতে হাত তুলে বলল — আমি…
অন্য সেলসম্যান বললেন — কোথায় রেখেছিস?
ছেলেটা উঠে দাঁড়িয়ে ক্যাশ কাউন্টারের দিকে হাত দেখিয়ে বলল — ওই তো, বিক্রি করে দিয়েছি।
ততক্ষণে শুভাই, আর ওর জুতো প্যাক করছিল যে ছেলেটা, দুজনেরই নজর গেছে ওর জুতোর বাক্সের দিকে। বাক্সের ওপর মোটা বেগনে ফেল্ট কলমের কালিতে মস্তো একটা ক্রস-চিহ্ন আঁকা। শুভাইয়ের কী মনে হলো, খপ করে প্যাকিঙের ছেলেটার হাত থেকে জুতো সুদ্ধ বাক্সটা কেড়ে নিয়ে বগলদাবা করে নিল। আর প্রায় একই সঙ্গে, দোকানের ভীড় ঠেলে এসে হাজির হলেন অন্য সেলসম্যান। বললেন — ও জুতো আপনি পাবেন না। ওটা বিক্কিরি হয়ে গেছে।
শুভাই বলল — আমি কিনেছি।
সেলসম্যান বলল — না, ওটা আপনি কিনতে পারবেন না। ওটা আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। এই… ততক্ষণে আপেল-আপেল ভদ্রলোক কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন… ইনি কিনেছেন।
শুভাই বলল — কী করে? আমি জুতো কিনে টাকা দেবার লাইনে দাঁড়ানোর পরে উনি দোকানে ঢুকলেন। আমি দেখেছি।
ভদ্রলোক বললেন — আমি ফোন করে বলে দিয়েছিলাম, উনি রেখে দিয়েছিলেন।
শুভাই বলল — আমি কিনেছি। টাকা দিয়েছি। ওই ওনার হাতে আমার ক্যাশমেমো আছে।
সেলসম্যান বললেন — ওটা ভুল হয়েছে। এটা এনার। আপনি জুতোজোড়া দিন, আমি ক্যাশমেমো ক্যানসেল করে আপনার টাকা ফেরত দিচ্ছি। আপনি অন্য জুতো নিতে পারেন।
— কেন আমি অন্য জুতো নেব? আপনি আপনার আপেলবাবুকে বলুন, উনি অন্য জুতো নেবেন।
অসম্মানজনক শব্দটা কেমন নিজে থেকেই বেরিয়ে এল মুখ থেকে।
এবারে একটা হট্টগোলের সৃষ্টি হলো। শুভাইকে জুতো বিক্রি করেছে যে সেলসম্যান আর এই সেলসম্যানে লেগে গেল তুমুল ঝগড়া। কেন ছোকরা সেলসম্যান একজন সিনিয়রের দেওয়া দাগ অগ্রাহ্য করে জুতো বিক্রি করে দিয়েছে? ছোকরার বক্তব্য, এরকম কোনও দস্তুর এই দোকানে আছে বলে সে কখনও শোনেনি। শুনলে হয়ত… এর মধ্যে আপেলবাবুও যোগ দিলেন। শুভাইকে অনুরোধ করলেন — জুতোজোড়া আমাকে দিয়ে দাও। আমি তোমাকে দামের চেয়ে পাঁচশো টাকা বেশি দিচ্ছি। কিন্তু এই জুতো আমারই চাই! অ্যাট এনি কস্ট!
দোকানের অন্য ক্রেতা বিক্রেতারাও ভীড় করে এসেছেন। নানা মুনির নানা মত। কিন্তু আপেলবাবুর অ্যাট এনি কস্ট মন্তব্যে জনমত — যা মোটামুটি শুভাইয়েরই পক্ষে ছিল, তা পুরোপুরি ওর কোলে চলে এল।
— কে রে মালটা? জুতো রিজার্ভ করেছে?
— মিনিস্টার ফিনিস্টার নাকি? নইলে জনগণের জুতো চায় কেন?
— ও মশাই, জুতো বিক্কিরি হয়ে গেছে। আর নেই। অন্য জুতো দেখুন, নয়ত কাটুন তো…
— হ্যাঁ, মেলা কাস্টমার। এখন লেট করাবেন না…
ইত্যাদি মন্তব্যে বাতাস ভারি হয়ে উঠল। কিন্তু অত সহজে হাল ছাড়তে তিনি নারাজ। সেলসম্যান দুজনেরও বচসা তুঙ্গে, এমন সময় অকুস্থলে হাজির হলেন দোকানের ম্যানেজার। ওঁর বক্তব্য, সাটা ফুটওয়্যার কম্পানির দোকানে বিক্রির আগে জুতো রিজার্ভ করার ব্যবস্থা নেই। তবু, কখনও, পরিচিত কাস্টমার বললে সেলসম্যান জুতো সরিয়ে রাখে বটে, কিন্তু সেটা তো অফিশিয়াল প্রসিডিওর নয়, তাই এ অবস্থায় জেনুইন খদ্দেরকে বঞ্চিত করে অন্যকে জুতো দিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। এখানে বয়স্ক সেলসম্যান ম্যানেজারের কানে কানে কী বললেন, সম্ভবত আপেলবাবুর পরিচয় দিলেন। ম্যানেজার খুব বিচলিত না হয়েই বললেন — উনি নবাব খাঞ্জা খাঁ বা ভ্লাদিমির পুতিন হলেও তো নিয়ম বদলাবে না। তাহলে দোকানের বদনাম হবে। খদ্দেররা বলবে, ওদের দোকানে যাব না।
আপেলবাবু মুখ কঠিন করে বললেন — আমি যে আর আসব না, তার বেলা? আমি আপনাদের দোকান থেকে বছরে ক’টাকার জুতো কিনি আপনি জানেন? সেলসম্যানকে দেখিয়ে বললেন — উনি জানেন। আর এই… বলে শুভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন — তুমি আসো এই দোকানে? সাটা কম্পানির জুতো পরো?
অ্যাট এনি কস্ট… কথাটার পরে ভদ্রলোকের এই দ্বিতীয় ভুল। টাকার গরম দেখাচ্ছে রে… থেকে শুরু করে, ব্যাটাকে মার তো, মার… টাই পরা হয়েছে… দে পেঁচিয়ে গলায়… জাতীয় রাগী কথা ছুটে আসতে লাগল চারপাশ থেকে।
বেগতিক দেখে ম্যানেজার তাড়াতাড়ি ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে ভেতরের দিকে চলে গেলেন, সম্ভবত নিজের ঘরেই। ভদ্রলোকও ততক্ষণে বোধহয় বুঝতে পেরেছেন বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন। আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেন। অন্য ক্রেতা, সেলসম্যানরাও, তখনও উত্তেজিত, যে যার কেনা-বেচার কাজে গেলেন, শুভাই প্যাকিঙের ছেলেটার হাতের দিকে দেখিয়ে বলল — আমার রসিদটা দিন।
ছেলেটা এতক্ষণ কাজ থামিয়ে ঝগড়া দেখছিল। ওর একহাতে শুভাইয়ের জুতোর রসিদ আর অন্য হাতে প্লাস্টিকের ব্যাগ, তাতে জুতোর বাক্স ভরে দেবার কথা। শুভাইয়ের কথা সম্বিৎ ফিরল। একবার রসিদটার দিকে তাকিয়ে বলল — আরে, জুতোটা দিন, ভরে দিই।
শুভাই আর জুতো হাতছাড়া করে! জুতো দিলে যদি বলে, আপনার ক্যাশমেমো ক্যানসেল হলো, এই নিন টাকা… বলা যায় না, যেমন সব লোক!
বলল — দরকার নেই। এমনিই নেব। ব্যাগ চাই না। প্যাকিঙের ছেলেটার মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা গেল ব্যাগ ছাড়া জুতো নেবার খদ্দের সে এর আগে দেখেনি, কিন্তু শুভাইয়ের সেলসম্যান ছেলেটাও কাছে ছিল। সে এগিয়ে এসে — আরে, ঠিক আছে, ঠিক আছে, বলে শুভাইকে আগলে নিয়ে দরজা অবধি নিয়ে এল। নিজেই হাত বাড়িয়ে প্যাকিঙের ছেলেটার হাত থেকে ক্যাশমেমোটা নিয়ে শুভাইকে দিয়ে বলল — আবার আসবেন।
শুভাই নিয়মমতো গেটের দারোয়ানকে রসিদটা দিল। ওর কাজ রসিদে লেখা তালিকা খদ্দেরের হাতের মালপত্রের সঙ্গে মিলিয়ে রসিদে একটা যন্ত্র দিয়ে ফুটো করে দেওয়া। শুভাইয়ের জুতো চেক করার কিছু নেই, তবু আড়চোখে বগলে ধরা বাক্সটা দেখে নিয়ে দারোয়ান সবে বলেছে — ব্যাগ ছাড়া নিয়ে যেতে অসুবিধা হবে না? তখনই পরের ঘটনাটা ঘটল, আর সেটা এই এতক্ষণ যা যা ঘটেছে তার চেয়ে বহুলাংশে খারাপ।
দোকানের বাইরের ফুটপাথে অনেক লোকের ভীড়, তারা সবাই ঠেলাঠেলি ধাক্কাধাক্কি করে চলছে, যারা একাধিক, তারা আস্তে ধীরে কথা বলতে বলতে, যারা একলা তারা একটু পা-চালিয়ে, তারই ভেতর থেকে কে যেন ছিটকে বেরিয়ে এসে ছোঁ মেরে শুভাইয়ের হাত থেকে বাক্সটা কেড়ে নিল।
এক লহমার বিহ্বলতা কাটিয়ে শুভাই একটা গগনবিদারী চিৎকার করে ঝাঁপ মারতে গেছিল, কিন্তু তার আগেই গেটের উর্দিপরা দারোয়ান স্প্রিঙের মতো লাফ দিয়েছে। ও শুভাইয়ের চেয়ে অন্তত দেড়ফুট লম্বা এবং তাগড়াও। ওর বাড়িয়ে দেওয়া পায়ে পা বেধে ছিটকে গিয়ে আপেলবাবু গিয়ে পড়লেন সামনের স্টলের গায়ে, হাত থেকে জুতোর বাক্স পড়ে খুলে গেল, এক পাটি জুতো গিয়ে পড়ল ফুটপাথ আর রাস্তার সংযোগস্থলে, যেখানে এখনও নোংরা কাদা-জল ভর্তি। শুভাইয়ের রাগের গর্জনটা হাহাকারের আর্তনাদে পরিবর্তিত হয়েছে, ছুটে গিয়ে জল-কাদা থেকে জুতোটা তুলে নিল ও, জুতোর সঙ্গে উঠে এল এক খাবলা কালো, নোংরা কাদামাটি। মুখ তুলে দেখল আপেলবাবু একেবারে সামনেই একটা পার্ক করা গাড়ির পেছনের দরজা খুলছে… পালাবে।
অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনার সময় ছিল না, শুভাই লাফিয়ে গিয়ে আপেলবাবুর সামনে দাঁড়িয়ে গাড়ির দরজাটা টেনে ধরল। ভদ্রলোক তখন সিটে বসতে বসতে প্রাণপণে চেঁচাচ্ছেন — চলো, চলো, জলদি…
হাতের কাছেই ভদ্রলোকের মাথা। একটা যন্ত্র যেন ওকে চালাচ্ছে, শুভাইয়ের হাতটা ভেতরে ঢুকে আপেলের টাকে, মুখে, গালে, গলায়, জামায়… যেখানে পারল সেখানেই নোংরা কাদা মাখিয়ে দিল।
কয়েক মুহূর্তেরই ব্যাপার, পরক্ষণেই ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে দিল, শুভাই শেষ লহমায় নিজেকে সরিয়ে নিল, গাড়িটা পেছনের দরজা খোলা অবস্থাতেই ট্র্যাফিকের ভীড়ে মিশে গেল, পেছনে পেছনে পার্কিং-এর ছেলেটা তাড়া করল — আ বে ও-ও-ও-ও-ও-ই বলে… শুভাই বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল রাস্তার ধারে।
দোকানে ফিরে গিয়ে দেখল সেলসম্যান ছেলেটা জুতোর বাক্সটা উদ্ধার করে তুলে নিয়ে গেছে দোকানে। অন্য পাটি-টার বেশি কিছু হয়নি। বাক্সের মধ্যেই রয়ে গেছিল, দু-চার ফোঁটা জল লেগেছে কি লাগেনি… কিন্তু শুভাইয়ের হাতে ধরা পাটি-টা দেখে ম্যানেজার-সেলসম্যানদের মুখ শুকিয়ে গেল। ভিজে ক্যাতক্যাত করছে, কাদা-জল ঝরঝর করে পড়ছে, কালো আর নোংরা কাদায় মাখামাখি।
এর ফল অবশ্য হলো যে দোকানের সব কর্মচারীরই সহানুভূতি পেল শুভায়ু। ম্যানেজার কড়া গলায় বয়স্ক সেলসম্যানকে বললেন — কী রকম খদ্দেরদের আপনারা মাথায় তোলেন, বুঝি না। উনিও লজ্জায় অধোবদন, বার বার শুভাইকে সরি, সরি বলছেন। ম্যানেজার বললেন — জুতোজোড়া রেখে দাও। যে করে হোক, যতটা সম্ভব স্যালভেজ করো। শুকিয়ে, রঙ করে ডেলিভারি দেবে… শুভাইয়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে বললেন — এক সপ্তাহ সময় দিন আমাদের।
বাড়ি ফিরে জুতো ছাড়া ফেরার গল্প বলতে হলো। বড়োমামা বলল, সে কী রে! অ্যাট এনি কস্ট বলেছিল, আমি তো পাঁচ ছ’ গুণ দাম নিয়ে দিয়ে দিতাম! একসপ্তাহ পরে কোনও রকমে তড়িঘড়ি শুকিয়ে রঙ-করা জুতো হাতে নিয়ে বলল — ধরে দেখ, তখন যে ধরেছিলি, আর এখন… ওজনের তফাত হয়েছে? হয়ত হিল-এর মধ্যে সোনা লুকোনো ছিল, বা কোনও মাদকদ্রব্য… এর মধ্যে বের করে নিয়েছে। তোর আপেলবাবু হয়ত স্মাগলার! এখন থেকে জুতোটা পরলেই তোর আপেলবাবুর কথা মনে পড়বে।
মামার সবসময় ঠাট্টা। তবে জুতোটা পেয়ে শুভাইয়ের খুব আনন্দের মধ্যেও একটা চোনা রয়েই গেল। সত্যিই জুতোটা পায়ে দিতে গেলেই ওর সেই ঘটনাটা মনে পড়ে। আগে, যখন নতুন ছিল তখন ঘনঘন পরত না, তখন তো পায়ে দিতে গেলেই মনে পড়ত, এখন, গত বছর আড়াই তিন প্রায় সারাক্ষণই পরে, তাই আর অত মনে পড়ে না।
(পরের রবিবার শেষ)