সকালে টিপটিপ বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম। খুব সকালে একবার একটু বৃষ্টি থেমেছিল। সামনে অনেক দূর পর্যন্ত নীল সবুজ পাহাড়ের ঢেউ খেলানো সুন্দর দৃশ্য। কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাই নি। জুল্যুক আসলে একটা মিলিটারী ক্যাম্প। একটা মাঠে কয়েক ডজন মিলিটারী ট্রাক দেখলাম, তাদের পাশে রেখে রাস্তা ক্রমশ উপরে উঠে চলল। ঘন্টা খানেক চলার পর এল আপার জিগজ্যাগ। একটা ভিউ পয়েন্টে দাঁড়ানো হল। ওপর থেকে জিগজ্যাগের অনেক ছবি তোলা হল। মাঝে মাঝে সাদা মেঘ এসে পাহাড় ঢেকে দিচ্ছিল। আমরা থাকতে থাকতেই পরে আরও দু-তিনটি দল এল। তারা মেঘের জন্য জিগজ্যাগ দেখতে পায় নি। ওখানে গোটা দুই চায়ের দোকান আছে। আমরা একটা দোকানে বসে কফি খেলাম। আবার গাড়ী পাকদন্ডি বেয়ে উঠে চলল। এবার এল থাম্বি ভিউ পয়েন্ট। এখানে থেমে অনেক ছবি তোলা হল।
মেঘ না থাকলে এখান থেকে কাঞ্চজঙ্ঘা খুব ভালো দেখা যায়। এরপর যেখানে থামলাম, সেখান থেকে নিচে সুন্দর একটা উপত্যকা। কিছু ঘরবাড়ী আছে। বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠে অনেক চমরী গরু চরে বেড়াচ্ছে দেখলাম। কয়েক মিনিট পর সাদা মেঘ এসে গোটা উপত্যকা ঢেকে দিল।
পাহাড়ী পথে আরও আধ ঘণ্টা চলে পৌঁছলাম বাবা মন্দির। এটা পুরনো বাবা মন্দির। ১৯৬২ সালের চিনা আক্রমণের সময় হরভজন সিং শহীদ হন। তাঁকে নিয়ে অনেক অলৌকিক ঘটনার কথা প্রচারিত আছে।
জুতো খুলে, কিছু সিঁড়ি বেয়ে উঠে মন্দির দেখা হল। কালো মেঘ এসে গোটা এলাকা ঢেকে দিলেও বৃষ্টি হচ্ছিল না। ওখান থেকে আবার আধ ঘণ্টা মত চলে পৌঁছলাম কূপুক এলিফ্যান্ট লেক। লেকের কাছে যাওয়ার অনুমতি নেই। ওপরের রাস্তা থেকেই দেখতে হয়। রাস্তায় মেঘ না থাকলেও, লেকের উপর মেঘ থাকায় ভালো দেখা যাচ্ছিল না। মিনিট দশেক পর মেঘ সরে গেল। ওখানেও কয়েকটা চমরী গরু চরে বেড়াচ্ছে দেখলাম। কয়েকটা ছবি তোলার পর ফেরার রাস্তা ধরলাম। ওই রাস্তা ছাঙ্গু লেক হয়ে গাংটক চলে যায়। আমরা জুল্যুক্ ফিরে এলাম। ফেরার সময় প্রায় গোটা রাস্তাই মেঘে ঢাকা পেলাম। হোটেলে ঢুকলাম ছাতা মাথায়।
সেই যে বৃষ্টি হচ্ছিল আমরা পরদিন ফেরা পর্যন্ত আর থামলই না। রাত্রে প্রচণ্ড গোঁ গোঁ করে বৃষ্টি পড়েই গেল। সকালে আটটায় ড্রাইভার এসে খবর দিল, ফেরার পথে পাহাড়ে ধ্বস নেমেছে, রাস্তা বন্ধ। রাস্তা খুব তাড়াতাড়ি পরিষ্কার করে দেওয়া হয় সাধারণত। প্রায় এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের সামনে আর একটা গাড়ী অন্য কোন হোটেল থেকে বেরিয়ে আগে আগে চলল। পাঁচ কিমি মত নেমে একটা জায়গায় দেখি ধ্বসে রাস্তা বন্ধ। দুই গাড়ীর ড্রাইভার নেমে দেখতে গেল। পরে আরও একটা গাড়ী পিছনে এসে দাঁড়াল। ওরা মিনিট দশেক পর জানালো এই ধ্বস পেরোনোর কোন উপায় নেই। সোজা নিচে জিগজ্যাগের তিন জায়গায় রাস্তা বন্ধ। একটু পিছিয়ে, পাহাড় জঙ্গল হেঁটে এক মাইল মত নামতে পারলে ধ্বস পেরোনোর উপায় হয়। আমরা এক কথায় রাজী হয়ে গেলাম।
নিচের থেকে গাড়ী এসে আমাদের ঋষিখোলা পৌঁছে দেবে। তার জন্য যে ফোনাফুনি করতে হল তাতেই সমস্যা। মোবাইলের সিগনাল খুব সামান্য একটু পাওয়া যাচ্ছিল। খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েই কিছুটা পিছনে ফিরে এলাম। রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলের দিকে নামার জায়গাটা ড্রাইভার নিমা খুঁজে বের করল। গাছের ডাল ভেঙ্গে লাঠি বানানো হল। পায়ের মোজা খুলে নিতে বলল নিমা। আমাদের সবথেকে বড় ট্রলি ব্যাগটি কাঁধে নিয়ে নিমা আগে আগে চলল। ঘাস ঝোপ জঙ্গলে সাবধানে পা ফেলে এগোতে থাকলাম। এক জায়গায় কিছু পাইন গাছ কেটে ফেলে রাখা ছিল। খুব সাবধানে পেরোতে হল। আমার স্ত্রীর পক্ষে বেশ কঠিন ছিল জায়গাটা। একটা পায়ে চলার রাস্তা মত মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু সেই পাথুরে রাস্তা দিয়ে একটা ঝর্ণা মত বয়ে যাচ্ছিল, তাই পাথরে পা না ফেলে পাশের ঘাসে ঘাসে পা দিয়ে চলতে হচ্ছিল। অনেকটা নেমে এস এস বি ক্যাম্পের গেটে পৌঁছলাম। ওদের পোষা কুকুর আছে, নিমা তাই নিয়ে বেশ টেনশনে ছিল। জওয়ানরা গেট খুলে দিল। নিমা বারবার কুকুর সামলে রাখতে বলল। দুটি নিরীহ কুকুর দেখতে পেলাম। ওরাই আমাদের মিছিল দেখে দূরে সরে গেল। ক্যাম্প থেকে নিচে বড় রাস্তায় নেমে এলাম। ঐ রাস্তা থেকে আবার একটা সুন্দর পাইনের জঙ্গলে নামলাম। নিচ থেকে কয়েকজন লোক কাঁধে মোটা মোটা কেবল নিয়ে উঠে আসছে দেখে আমরাও ঐ রাস্তা দিয়ে হেঁটে নামতে শুরু করলাম।
প্রথম কিছুটা সুন্দর একটা পার্কের মত। ওখানে বসার জন্য লোহার বেঞ্চও আছে কয়েকটা। পার্কের থেকে নামার সময়ই পায়ে শেকড় জড়িয়ে আমার স্ত্রী দুবার আছাড় খেয়ে পড়ল। আরও একশ গজ ঝোপ ঝাড় পেরিয়ে নামার পর আসল বিপদের জায়গায় পৌঁছলাম। নিচে রাস্তা তৈরীর কাজ চলছে। সোজা জঙ্গল থেকে দশ ফুট নিচে কাদা পাথরের ওপর নামতে হবে। আমি ওপরের ডাল পালা ধরে ঝুলে নেমে গেলাম। নিমা এক এক করে বড় বোঝা আমার হাতে নামিয়ে দিল। বেশ বোঝা যাচ্ছিল, ওখান থেকে আমার স্ত্রী নামতে পারবে না। নিমা তাকে পিঠে নিয়ে নামিয়ে দিল। নিচের রাস্তায় নামার পর আবার বৃষ্টি নামল, ছাতা মাথায় নিয়ে দাঁড়াতে হল। যারা রাস্তার কাজ করছিল জানাল যে কিছুটা নিচে হেঁটে নামলে একটা দাঁড়ানোর জায়গা আছে। গাড়ী আসতে সময় লাগবে, তাই নিচের দিকে নামতে শুরু করলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর একটা টিনের ছাউনি পেলাম। নিচের গাড়ীর ড্রাইভারের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করা মুশকিল হয়ে গেল। তার ভেতর নতুন সমস্যা হল, এই নতুন ড্রাইভারের কাছে পারমিটের কপি নেই। অনেক কসরত করে গাড়ীর এজেন্ট ওকে পারমিট পাঠাল।
আধঘণ্টা পর গাড়ী এসে গেল। নিমা কি করবে ঠিক করতে পারছিল না। এজেন্টের কাছ থেকে কোন নির্দেশ আসে কিনা তার জন্য অপেক্ষা করছিল। নতুন ড্রাইভার ওকে কোন খবর দিতে পারল না। ওরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে গাড়ী নিয়ে উপরের দিকে উঠে গেল। মিনিট দশেক পর গাড়ী নেমে এলে আমরা উঠলাম। নতুন ড্রাইভার জানাল, নিমাকে যতোটা সম্ভব এগিয়ে দিয়ে এসেছে। শেষে নিমাকে একটা ধন্যবাদও দেওয়া হল না। ওখান থেকে ঋষিখোলা ৫৩কিলো মিটার। ড্রাইভার বলল, এক ঘন্টা মত লাগবে। ওঠার সময় কয়েক জায়গায় থেমে গেছলাম, প্রায় ঘন্টা তিনেক লেগেছিল। ফেরার সময় গোটা রাস্তায় প্রায় কোন গাড়ী দেখিনি। ঘণ্টা খানেকে ঋষিখোলা পৌঁছে গেলাম। সাড়ে তিনটার পর দুপুরের খাবার খেলাম। নদীর পাড়ে ছোট্ট হোটেল, সারা সময় গোঁ গোঁ করে নদীর শব্দ শুনলাম। হোটেলটি সুন্দর হলেও ব্যবস্থা খুব বাজে। টিভি আছে, কিন্তু চলে না। এদিকে কলকাতায় বসে আমার বন্ধুরা টিভি দেখে আমাদের জন্য খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। কয়েকজন ফোন করল। গুগলে দেখলাম, লাভা গরুবাথান হয়ে ফেরার রাস্তা আছে। আমার ছেলে এজেন্টের সাথে কথা বলে ঠিক করল, ভোর সাড়ে চারটায় রওনা দিয়ে বাগডোগরা ফেরার চেষ্টা হবে।
ঋষিখোলা পৌঁছে মনে হচ্ছিল, বিপদটা পেরিয়ে এসেছি। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে নামতে গিয়ে আমাদের তিনজনকে জোঁক ধরেছিল। আমার বাম হাতের পাতায় একটা জোঁক বসেছিল, রক্ত বের করার আগেই দেখতে পাই, আমার মেয়ে টেনে তুলে নেয়। হোটেলে পৌঁছে জুতো খোলার পর মেয়ে দেখল তার পায়ের গোড়ালির কাছে রক্ত বের হচ্ছে। জোঁক খুঁজে পাওয়া গেল না। প্রায় এক ঘন্টা পর আমার স্ত্রীর একটা পায়ে, হাঁটুর নিচে রক্ত বের হচ্ছে দেখা গেল। এখানেও জোঁক খুঁজে পাওয়া গেল না।
ভোরে উঠে বেরতে হবে, সেই চিন্তায় রাত্রে ভাল ঘুম হল না। আমরা সাড়ে চারটার আগেই তৈরী হয়ে গেলাম। পাঁচটার আগে গাড়ী এসে গেল। মিনিট দশেকের মধ্যে চেক পোস্টের পৌঁছে গেলাম। ড্রাইভার নেমে অফিসে গেল। ভাবলাম গেট খুলে দেবে। কিন্তু ড্রাইভার দেখলাম অন্ধকারের মধ্যে নদীর সেতুর দিকে চলে গেল। এক এক করে আমরা দুজন নামলাম। এবার দেখি সামনের রাস্তায় পনের ফুট উঁচু পাথর পড়ে আছে। এবার চেক পোস্টের পুলিশ এগিয়ে এসে বলল, ওপারে আরও দু জায়গায় রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। আগামী দু দিন লাগবে রাস্তা খুলতে। এবার সত্যিই চাপে পড়ে গেলাম। ড্রাইভার এসে বলল, উঠুন, রংপো ঘুরে যেতে হবে। কোথায় রংপো, কত ঘুরতে হবে কিছুই জানিনা।
ক্রমশ…