ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি, পাশাপাশি বাড়িতে কারও স্বজনবিয়োগ বা বিপদ-আপদ হ’লে উৎসব অনুষ্ঠানের মাইকের শব্দ কমিয়ে দেওয়া হ’ত। নিজেদের মধ্যে হাসি-মস্করাও কমে যেত স্বাভাবিকভাবেই। চিরাচরিত ভাবেই এটা হয়ে যেত। কাউকে শিখিয়ে দেওয়ার দরকার পড়তো না।
এরকম একটা ভয়াবহ মৃত্যুমিছিলের খবর দেখে শিউরে উঠছি। বারবার দুঃস্বপ্নে ছবিগুলো ফিরে আসছে। পারতপক্ষে খবরের চ্যানেল খুলছি না। কত আর যন্ত্রণার ছবি সহ্য করা যায়? এতগুলো তরতাজা জীবন এক লহমায় শেষ হয়ে গেল। এতগুলো স্বপ্ন, এতগুলো ভবিষ্যতের সুখের বীজ বোনার গল্প, এতগুলো চুড়ির রিনরিন, এতগুলো ঘামে ভেজা জামার ভেতর শিখর ছোঁয়ার স্পর্ধা… সব মুহূর্তে শেষ। জীবন এতটাই অনিশ্চিত!
ক’দিন বাদেই আমরা সব ভুলে যাবো। সময়ের অমোঘ নিয়ম মেনে পৃথিবী কারও জন্য থেমে যাবে না। হাসি, গান, আনন্দ সব আগের মতোই থাকবে। শুধু যে জলজ্যান্ত মানুষ বাড়ির চারদিক মাতিয়ে রাখতেন, তিনি ফটোফ্রেমে বন্দী হয়ে যাবেন। বছরে একবার সাদা ফুলের মালা। ক’দিন বাদেই ফুল শুকিয়ে যায়। বেদনার তীব্রতা কমে আসে। ফটোফ্রেমে ঝুল জমে। বছরে একবার ঝাড়পোঁছ হয়। ঘামে ভেজা গামছা, স্পর্শের উষ্ণতা, চুলের গন্ধ… সবকিছুর ওপরে বিস্মৃতির পুরু চাদর নেমে আসে।
সব সত্যি। এই নির্মম ভুলে যাওয়া সত্যি। শুকিয়ে যাওয়া চোখের জল মুছে রোজনামচায় ডুবে যাওয়া সত্যি। ‘শো মাস্ট গো অন’। ‘সময়’ নামের অদৃশ্য রিং-মাস্টারের অঙ্গুলীহেলনে বিষাদগ্রস্ত মানুষ আবার উঠে দাঁড়ায়। মুখ ধুয়ে, দাঁত মেজে, লোকাল বাসে ওঠে। কাঁধে ব্যাগ, দু-পায়ে ক্লান্তি। তবু হেঁটে যেতে হয়। তবু হেঁটে নিতে হয় জীবনের অন্তহীন পথ। বেদনার থেকেও খিদের জ্বালা অনেক তীব্র। তাই ভুলে যেতে হয়।
তবু এখনই, এক্ষুনি যাবতীয় হাসি-মস্করার অন্তত সর্বসমক্ষে প্রদর্শন অশ্লীল। আমরা বেশিরভাগই কিছুই করে উঠতে পারবো না। কিন্তু অন্তত কিছু সময়ের জন্য নীরবতাটুকু বজায় রাখা যায় না? এই চূড়ান্ত দুঃখের দিনেও ফেসবুক জুড়ে হাসি-মস্করার মিম, ভিডিও শেয়ার করা যায়? অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে গেছেন। তাঁরা একটু নিজেদের মতো আনন্দ করে, কিছুদিন পরে ছবিগুলো পোস্ট করতে পারেন না? এই যন্ত্রণার সময়ে অসামান্য সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কিংবা হাসিমুখও অসহ্য লাগছে। সহমর্মিতা না হোক, পাশে দাঁড়ানো না হোক, অন্তত নীরবতা? স্রেফ চুপ করে থাকা যায় না ক’দিন?
এর মধ্যেই পাথর ধারণের অসারতা নিয়ে অসংখ্য পোস্ট। ঠাকুর-দেবতা এসে বাঁচালেন না কেন, সেসব চর্বিতচর্বণ। কোনও অলৌকিক শক্তি এসে দুর্ঘটনা থেকে বাঁচিয়ে দেবে, এরকম বিশ্বাস নেহাতই হেসে উড়িয়ে দেওয়ার মতোই ব্যাপার। কিন্তু সেগুলো নিয়ে আপনার ফেনা তোলা গল্প শোনানোর এই কি সময়? মানুষের আবেগের জায়গা এবং বলার মতো সঠিক সময় নির্বাচন করতে না জানলে আপনার ওরকম ফেসবুকীয় বকবকানির কানাকড়িও মূল্য নেই। যাঁরা কাছের মানুষ হারালেন কিংবা যাঁরা এই যন্ত্রণার অভিঘাতে বিপর্যস্ত, তাঁরা আপনার এই সব জ্ঞানগর্ভ ভাষণ শোনার মতো মানসিক অবস্থায় আছেন বলে মনে হয় আপনার?
বাকি রইলো দোষারোপ পর্ব। কার দোষ, কোথায় দুর্বলতা সব কিছুর চুলচেরা বিশ্লেষণ হওয়া দরকার। কীসের জন্য বারবার মানুষকে এইভাবে ঝরে যেতে হয় সেগুলোর হিসেব নিশ্চয়ই দরকার। তবু সেটা এক্ষুনি না হওয়াই ভালো বোধহয়। বছরের এতগুলো দিন, ফেসবুকের ওয়াল, ভোটবাক্স… সব তো আপনার হাতে রইলোই। অন্তত ক’টা দিন।
একটু নিস্তব্ধতা, প্লিজ!
প্রতিবার এরকম দুর্ঘটনা হ’লে বহুদিন মন ভারী হয়ে থাকে। বড়বাজারে উড়ালপুল ভেঙে পড়ার পরেও অনেকদিন দুঃস্বপ্নে জেগে উঠতাম। আমি নির্মোহ মহাপুরুষ নই। নেহাতই আলগাপাতলা, ভিতু মানুষ। মানুষের সাধারণ আবেগগুলোয় ভেসে যাই। দোষ, ভুল, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ খুঁজতে চাওয়ার তীব্র আওয়াজে আমার কষ্ট হচ্ছে। এরকম কান্নার দিনে এত শব্দ কেন?