আজকের দিনে দাঁড়িয়ে শ্রমিক শ্রেণীর বিকলত্ব এবং অকালমৃত্যুর জন্য দায়ী সমস্ত পেশাগত রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হল সিলিকোসিস। এটি একধরণের দীর্ঘস্থায়ী মারণরোগ যা মূলত ফুসফুসকে অকেজো করে দেয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী আজকের ভারতবর্ষে প্রায় ১ কোটিরও বেশি শ্রমিক এই রোগে আক্রান্ত।
সচরাচর বাতাসে ভাসমান বৃহদাকৃতির ধূলিকণা আমাদের ফুসফুসের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারে না। কিন্তু ভাসমান ধূলিকণার আকার যত ছোট হয়, শ্বাসনালীর ঝাঁটা সেগুলোকে আটকাতে পারে না, অনায়াসে ফুসফুসের হাওয়া থলিতে ঢুকে পড়ে। ৩ মাইক্রনের থেকে ছোট আকৃতির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ধূলিকণা ফুসফুসের মধ্যে ঢুকে যে সমস্ত দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসের রোগ সৃষ্টি করে, তাদের একত্রে বলা হয় নিউমোকোনিওসিস (Pneumoconiosis)। এইরকম ধূলিকণা হতে পারে পাথরের গুঁড়ো, কয়লার ডাস্ট, অ্যাসবেসটস এর গুঁড়ো, আয়রন ডাস্ট, কটন ডাস্ট বা তামাকের গুঁড়ো। ডাস্টের প্রকৃতি অনুযায়ী রকম-রকমের নাম রয়েছে। যেমন পাথরের গুঁড়ো বা ক্রিস্টালাইন সিলিকার ক্ষেত্রে সিলিকোসিস (silicosis), কয়লার গুঁড়োর ক্ষেত্রে অ্যানথ্রাকোসিস (anthracosis), আয়রন ডাস্টের ক্ষেত্রে সিডেরোসিস (siderosis), কটন ডাস্টের ক্ষেত্রে বাইসিনোসিস (byssinosis) ইত্যাদি।
পাথর খাদান, খনি শিল্প, সেরামিক শিল্প, ক্রাশিং এবং নির্মাণ কাজের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকরাই মূলত সিলিকোসিসের শিকার হন। সব কর্মীরা সমান ঝুঁকির মধ্যে থাকলেও একই সময় ধরে দু’জন মানুষ একই খাদানে কাজ করলে দু’জনের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা সমান নয়। এটা যেমন কত সময় ধরে একজন শ্রমিক শ্বাসের সঙ্গে ধূলিকণা গ্রহণ করছেন তার ওপর নির্ভর করে, তেমনই ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তির শারীরিক সক্ষমতা বা রোগ তৈরির প্রবণতার ওপরেও নির্ভর করে। মোটামুটিভাবে কয়েকমাস থেকে ছয় বছর পর্যন্ত টানা ক্রিস্টালাইন সিলিকা শ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করার পর সিলিকোসিসে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
শ্বাসের সঙ্গে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সিলিকার গুঁড়ো ফুসফুসের হাওয়া থলিতে প্রবেশ করলে সেখানের ম্যাক্রোফাজ জাতীয় ফ্যাগোসাইট কোষ এগুলোকে গিলে নেয়। এই কোষ সক্রিয় হলে নানান কেমিক্যাল মিডিয়েটর নিঃসরণ করে। ইন্টারলিউকিন, ফাইব্রোনেকটিন, টি এন এফ ইত্যাদি মিডিয়েটরগুলি দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়ায় ফুসফুসে ফাইব্রোসিস সৃষ্টি করে। এছাড়া ফ্যাগোসাইট কোষগুলো নিকটস্থ লসিকা নালিতে জড়ো হয় এবং লসিকা গ্রন্থি স্ফীত হয়ে নডিউল (nodule) তৈরি করে। ফুসফুসের Nodular Fibrosis সিলিকোসিসের গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য।
আমাদের ফুসফুসে বা শ্বাসনালীতে যে কোন ক্ষতিকর বস্তু প্রবেশ করলে সেটিকে বাইরে বের করে দেওয়ার জন্য কাশি হয়।
সিলিকোসিসে আক্রান্ত রোগীরা প্রাথমিক ভাবে দীর্ঘদিন ধরে কাশিতে ভুগতে থাকে। ফাইব্রোসিসের কারণে ধীরে ধীরে ফুসফুসের হাওয়া থলি দিয়ে অক্সিজেন পারাপার কমে যায় এবং ফুসফুসের মোট বায়ু ধারণ ক্ষমতাও ক্রমশ কমে আসে। ফলে পরের দিকটাতে এসব রোগীর প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হয়, একটু পরিশ্রমেই হাঁপ ধরে।
আরও সমস্যার বিষয় হল, সিলিকোসিসে আক্রান্ত ব্যক্তির টিবি হওয়ার সম্ভাবনা একজন সুস্থ মানুষের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। তার ওপরে অনেকের আবার বিড়ি বা সিগারেট জাতীয় ধূমপানের নেশা থাকে। ফলত সিলিকোসিস খুব দ্রুত গতিতে ফুসফুসকে অকেজো করে দেয়।
এখনও পর্যন্ত এই রোগের তেমন একটা কার্যকর চিকিৎসা নেই বললেই চলে। কেন না একবার ফুসফুসে ফাইব্রোসিস হয়ে গেলে সেটাকে পুনরাবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় না। হাঁপানির ওষুধে কিছুটা হলেও আরাম মেলে। পরের দিকে যেমন যেমন রোগলক্ষণ বা উপসর্গ দেখা যায়, সেই মতো চিকিৎসা চলে।
এই রোগে চিকিৎসার থেকেও প্রতিরোধে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার। নিয়ন্ত্রিত ধূলিকণায় কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। আপাতত সঠিক ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (Personal Protective Equipment) যেমন মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা দরকার। আর দরকার শ্রমিকদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করা।
ছবি ঋণ স্বীকার: ছবিটি উত্তর ২৪ পরগনা মিনাখা ব্লকের সিলিকোসিস আক্রান্ত শ্রমিক নাসির মোল্লার।
Very interesting.