কথারম্ভ
করোনা ভাইরাসের ওষুধ বা টিকা আবিষ্কারের বিবরণ আর করোনা টেস্টিং-এর নতুন নতুন পদ্ধতি নিয়ে কাগজে খবর বেরোচ্ছে। রোগটির প্রতিরোধ বা চিকিৎসা হয়তো অদূর ভবিষ্যতে সম্ভব হবে।
• আপাতত দেখা যাচ্ছে চীন আর আমেরিকা থেকে নতুন ওষুধ, নতুন পদ্ধতিতে করোনা টেস্টিং আর নতুন টিকা আবিষ্কারের দাবি বেশি উঠছে। _(১)_
• আমাদের দেশ থেকে সস্তায় দ্রুত টেস্টিং-এর দাবি উঠেছে, আর কয়েকটি পুরনো ওষুধ ও বিসিজি-র মতো পুরনো টিকা করোনা-তে কতটা কার্যকর হতে পারে, তাই নিয়ে পরীক্ষা ও সমীক্ষা প্রকাশিত হচ্ছে।_(২, ৩)_
•এর সঙ্গে অন্য কিছু দেশেও আবিষ্কৃত নতুন ওষুধের ট্র্যায়ালের কাজ শুরু হয়েছে। ড্রাগ-ট্রায়াল নিয়ে অনেক নৈতিক আপত্তি করোনাতঙ্কে আপাতত ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে।
বিজ্ঞানের গবেষণা কোথায় কেমন হবে, তা শুধুমাত্র বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীর সিদ্ধান্ত নয়। বিভিন্ন দেশ তার নিজস্ব অবস্থা অনুযায়ী ভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। সেটা নির্ভর করে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষমতা, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত সুবিধা এবং ঐতিহ্যগত প্রবণতা ইত্যাদির উপরে। তবে এই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে আরও একটা ব্যাপার চোখে পরে, তা হলো আত্মবিশ্বাস অথবা তার ঘাটতি। আমরা পারবো- এই মনোভাব।
সাধারণভাবে ভারতীয়দের ধারণা হলো যে, আমরা করোনা অতিমারির মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু আবিষ্কার করতে পারব না।
• বিগত শতকের চিকিৎসাবিজ্ঞানে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপির মূল কাজটা ভারত আর বাংলাদেশের গবেষকরাই করেছিলেন।_(৪)_ কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের আত্মবিশ্বাস এতই কম যে আমরা এর মধ্যেই সেকথা ভুলেছি। (পাশের ছবিটি সেই গবেষক দলের অন্যতম ডা দিলীপ মহালনবিশ-এর।)
দু’শ বছরের বেশি আগে ভারতীয় টিকা বা ভ্যারিওলেশন-এর বিবরণ ইংরেজরা লিখে প্রবল আগ্রহের সঙ্গে নিজের দেশে পাঠাত। জেনার তাঁর ভ্যাক্সিন নির্মাণে প্রাচীন ভারতীয় পদ্ধতি থেকে মূল সূত্রটি পেয়েছিলেন, সেটা আমাদের মনেও থাকেনি। সেই প্রসঙ্গেই পর্ব ৮ এর মূল আলোচনা।
হলওয়েল সাহেব। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সার্জেন। অন্ধকূপ হত্যা নিয়ে সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে একটি বইতে সিরাউদ্দৌলা তথা তৎকালীন ভারতীয় শাসকদের কলঙ্কিত করেছিলেন। হলওয়েল সাহেব কিছুদিন পরে বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে যান। তাঁর ১৭৬৭ সালে লেখা গুটিবসন্তের টিকার বিবরণ হচ্ছে এ-বিষয়ে ইউরোপীয়দের বিবরণগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রাচীন।_(৫)_
কী লিখেছিলেন হলওয়েল?
“ব্রাহ্মণদের বিশেষ গোষ্ঠি … প্রতি বছর এই কাজ করত… বৃন্দাবন, বারাণসী ও এলাহাবাদ থেকে ছোট ছোট দলে [গুটিবসন্ত] রোগের সময়ের আগে এসে…।… একটা ছোট যন্ত্র দিয়ে তারা [চামড়ায়, সাধারণত হাতে] সামান্য রক্ত বেরনোর মতো ক্ষত করত, তারপর তারা দুভাঁজ করা কাপড়ের বটুয়া (যা তারা তাদের কোমরের কাপড়ে সবসময় বেঁধে রাখত) থেকে ছোট একটুকরো তুলোয় করে গুটিবসন্তের জিনিস দু-তিন ফোঁটা গঙ্গাজলে ভিজিয়ে, ঐ ক্ষততে লাগাত, তারপর একটা সামান্য ব্যান্ডেজ দিয়ে দিত, হুকুম করত যেন ছয়ঘন্টার মধ্যে ঐ ব্যান্ডেজ খোলা না হয়।_(৬)_
গর্ভবতী নারী, আগে টিকা পায়নি এমন মানুষ, যাদের গুটিবসন্ত হতে পারে তেমন লোকদের সদ্য টিকা দেওয়া মানুষের কাছাকাছি আসতে বারণ করা হত—কারণ কাছাকাছি এলে তাদের গুটিবসন্তের খারাপ আক্রমণ হতে পারত। যাকে টিকা দেওয়া হত তার খাবারদাবার সম্পর্কে কঠিন বাধানিষেধ আরোপ করা হত। টিকা দেবার পরে তার গায়ে যতদিন জ্বর না আসছে ততদিন তাকে বারবার ঠাণ্ডা জলে স্নান করানো হত, আর সাধারণত ছ’দিনের মাথায় জ্বর আসত। তখন দিন-তিনেক স্নান বন্ধ রাখা হত। তারপর গুটি বেরত। তখন আবার যতদিন গুটি পেকে খোসা না উঠছে, ততদিন বারংবার স্নান করানো শুরু হত। সেই সময় কাঁটা দিয়ে গুটির পুঁজ বের করে রোগীর কষ্ট দূর করা হত, আর পরের বছর টিকা দেবার মালমশলা সংগ্রহও হত। টিকা দেবার জিনিসটি সর্বদা আগের বছর সংগৃহীত রস, যা শুকিয়ে রাখা হত।”
হলওয়েল লিখেছেন, কেবল দক্ষ ব্রাহ্মণেরা টিকা দেবার কাজ করতেন। সাধারণত তাঁরা এলাহাবাদ, বারাণসী, বৃন্দাবন প্রভৃতি সুদূর হিন্দু পবিত্রভূমি থেকে আসতেন। টিকা দেবার পুরো সময়টাতে তাঁরা ‘অথর্ব বেদ’-এর মন্ত্র পড়তেন। হলওয়েল সাহেবের উদ্দিষ্ট পাঠকরা ছিলেন ব্রিটিশ ডাক্তাররা, বিশেষ করে রয়্যাল সোসাইটির সদস্যরা। হলওয়েল যখন লিখছিলেন তখন একই ভ্যারিওলেশন পদ্ধতি তুরস্ক থেকে ইংল্যান্ডে ঢুকেছে, তার কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা নিয়ে ইংরেজ ডাক্তারদের সন্দেহ ছিল। ভ্যারিওলেশন হিন্দু সমাজের মাথা অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের কাজ, বেদমন্ত্র পাঠের সঙ্গে করা হত, এমন বললে ইংরেজ ডাক্তারদের কাছে এটি বেশি গ্রহণযোগ্য হত। ভারত সম্পর্কে যেসব ইংরেজ ডাক্তার খবর রাখতেন, তাদের কাছে ব্রাহ্মণদের পরিচয় ছিল সুপ্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার প্রতিনিধি হিসাবে।
আসলে কিন্তু ভ্যারিয়েলেশন কেবল ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া ছিল না, আর পদ্ধতিটি সবসময় একই রকম থাকত না। সে কথায় পরে আসব।
সৌভাগ্যক্রমে হলওয়েল ছাড়াও আরও কিছু ব্যক্তির এই বিষয়ে ইংরাজিতে লেখা পাওয়া গেছে। এমন একজন হলেন রাধাকান্ত দেব। হলওয়েলের বিবরণের প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে ১৮৩১ সালে রাধাকান্ত লিখেছেন—
“ফাল্গুন মাসের কোনো পবিত্র দিনে সুস্থ বাচ্চা ছেলে বা মেয়েকে টিকাদারেরা টিকা দিত। তাদের ওপরহাতে ছুঁচলো কোনো জিনিস বিঁধিয়ে দেওয়া হত, আর আগে তুলোতে লাগিয়ে রাখা পুঁজ ঢুকিয়ে দেওয়া হত। পুঁজ সংগ্রহ করা হত আগের কোনো প্রাকৃতিক গুটিবসন্তের পাকা গুটি থেকে। বাচ্চাদের জ্বর না আসা পর্যন্ত বারবার স্নান করানো আর ঝাল ও রসাল খাবার খাওয়ানো হত, ষষ্ঠ বা সপ্তম দিনে জ্বর আসত আর গুটিবসন্ত বের হত। তার তিনদিনের মাথায় জ্বর চলে যেত, গুটিগুলো থাকত, আর [গুটি বেরনোর] পঞ্চমদিনে সেগুলোর ওপর জল ঢেলে সেগুলো ভালভাবে বের করা হত। সাতদিনের মাথায় গুটির ওপরে কাঁচাহলুদ মাখানো হত যাতে সেগুলো তাড়াতাড়ি পাকে। নবম বা দশম দিনে গুটিগুলো পাকত, তখন বৈঁচির কাঁটা দিয়ে সেগুলো ফুটো করে দেওয়া হত। এই হল চিকিৎসা, আর এটা তিনসপ্তাহের মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হত, আর রোগী দিব্যি ভাল হয়ে যেত। পুরো সময়টা রোগী আর রোগীর বাড়ির লোকেদের খুব সাবধানে ও আলাদা ঘরে রাখা হত। কোনো অপরিচ্ছন্ন মানুষকে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হত না। রোগীর বাবা-মা আর বাড়ির লোকেরা শুচিভাবে থাকতেন, আর দেবী শীতলার পুজো করতেন—শীতলা হলেন বসন্তরোগ আদি গায়ে ফুটে বেরনোর রোগসমূহের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। টিকাদারদের বাড়ির অবস্থা অনুযায়ী পারিশ্রমিক দেওয়া হত, তবে সাধারণত দরিদ্ররা টিকাপিছু একটাকা আর অবস্থাপন্নরা দু’টাকা দিতেন।”
দেখা যাচ্ছে টিকা দেবার মূল ব্যাপারটা হলওয়েল আর রাধাকান্ত দেব মোটামুটি একরকমই বলেছিলেন। শীতলার পুজো, মন্ত্র আওড়ানো ইত্যাদি নিয়ে কেউ কেউ অন্যরকম বলেছেন। মূল বিতর্ক হল টিকা দেবার জিনিসটা কী, তাই নিয়ে। হলওয়েল আর রাধাকান্ত দেব দুজনেই বলছেন তুলোয় টিকার বীজ থাকত, আর টিকা দেবার পরে গায়ে গুটি বেরোলে তার পুঁজ সংগ্রহ করা হত, যা দিয়ে অন্যদের টিকা দেওয়া হত।
তবে যে বছর গুটি থেকে রস সংগ্রহ করা হত, সে বছরই সেই রস টিকার মাধ্যমে অন্যের ওপর প্রয়োগ করা হত কিনা, এ-ব্যাপারে রাধাকান্ত দেব স্পষ্ট করে কিছু বলেন নি।
• হলওয়েল এবং অন্য কয়েকজনের বক্তব্যে আমরা দেখছি, আগের বছরের গুটির রস নিয়ে টিকা দেওয়া হত।
• আবার অন্য লেখাতে পাচ্ছি, একজনকে টিকা দিয়ে সে-বছরই সেই রোগীর গুটির রস টিকা হিসেবে ব্যবহার করা হত।
এখন এই সিদ্ধান্ত সমগ্র প্রক্রিয়াটির ক্ষেত্রে কিন্তু যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। টিকার রস কয়েকদিনের মধ্যে ব্যবহার করলে তাতে অন্য জীবাণু (বিশেষ করে টিবি ও সিফিলিস) বেঁচে থাকার ও সেই সব রোগ ছড়াবার সম্ভাবনা বেশি। আবার, একবছর পরে ব্যবহার করলে গুটিবসন্তের বীজাণু না-ও বেঁচে থাকতে পারে, বা কম সংখ্যক হয়ে যেতে পারে, এমনকি কমজোরিও হয়ে যেতে পারে।
টিকার পদ্ধতিতে আরও কিছু রকমফের ছিল। ‘নীচু’ ব্রাহ্মণ ছাড়াও মালাকার/মালি, কুম্ভকার, শঙ্খকার, তাঁতি, নাপিত ইত্যাদিরা টিকা দেবার কাজ করতেন। এদের অধিকাংশই কাছেপিঠের শহর-গ্রাম থেকে আসতেন, বারাণসীর মতো দূরদেশ বা ‘পবিত্রভূমি’ থেকে আসা টিকাকার কমই ছিল। তবে টিকা নেবার ব্যাপারে জাতিভেদ ছিল। উঁচুজাতের বালকের হাতে টিকা দিয়ে সেই টিকার স্থানে হওয়া ফুস্কুড়ি থেকে রস নিয়ে টিকা দিতে চাইতেন সকলে।
আগের বছরের গুটিবসন্তের গুটি থেকে রস সংগ্রহ করে রাখা ও পরের বছর সেই রস দিয়ে টিকা দেওয়া চলত। আবার একজনের (সাধারণত ব্রাহ্মণ বালকের) হাতে টিকা দিয়ে তার টিকার জায়গাটা দিন আট-দশ পরে ফোঁড়ার মতো পেকে গেলে সেই জায়গা থেকে রস নিয়ে সেবছরই অন্যদের টিকা দেওয়ার প্রক্রিয়াও প্রচলিত ছিল ।
আগে দেখেছি ইউরোপ এই ভ্যারিওলেশন টিকা নিয়ে গুটিবসন্তের প্রকোপ থেকে খানিকটা রক্ষা পায়। ভারতে এই টিকা কতটা চালু ছিল? ব্রিটিশ-পূর্ব ভারত নিয়ে তেমন তথ্য জানা নেই, কিন্তু ব্রিটিশ আসার পরে কিছু কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য আছে।
সে নিয়ে বলব পরের পর্বে।
চিত্র পরিচিতি (কেবলমাত্র অব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহারযোগ্য)
১) ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপি-র অন্যতম জনক ডা দিলীপ মহালনবিশ (১৯৩৪-বর্তমান)
২) জন জেফানিয়া হলওয়েল (১৭১১-১৭৯৮)
৩) গুটিবসন্তের ভারতীয় টিকা পদ্ধতি সম্পর্কে হলওয়েলের বই
৪) রাধাকান্ত দেব (১৭৮৪-১৮৬৭)
তথ্যসূত্র
১) https://www.theverge.com/2020/ 3/23/21188167/coronavirus- treatment-clinical-trials- drugs-remdesivir-chloroquine- covid, accessed on 11 May, 2020
২) (https://thewire.in/health/ experimental-drugs-india- covid-19, accessed on 11 May, 2020
৩) https://www.hindustantimes. com/india-news/mandatory-bcg- vaccination-may-make-covid-19- less-virulent-in-india-study/ story-iMvOo11WpAomquZMBi4jRP. html, accessed on 11 May, 2020
৪) ORS: The medical advance of the century, https://www.unicef.org/sowc96/ joral.htm, accessed on 13 May, 2020
৫)An Account of the Manner of Inoculating for the Small Pox in the East Indies with Some Observations on the Practice and Mode of Treating that Disease in those Parts (London, 1767). John Zephaniah Holwell FRS
৬) Colonizing the Body – State Medicine and Epidemic disease in Nineteenth-Century India, David Arnold. University of California Press, 1993, Page 116-158