অনেক দূরের এক দেশে এক সময়ে একটা রেল স্টেশন ছিল। ছোট্ট স্টেশন। তাতে একটা মাত্র প্ল্যাটফর্ম – ট্রেন দাঁড়াবার জন্য। প্ল্যাটফর্মে সবুজ ঘাসের চাদর, তার দুই প্রান্তে হলুদ বোর্ডে স্টেশনের নাম লেখা। এক পাশ দিয়ে রেল লাইন, অন্য পাশে লোহার বেড়া। বেড়ার ও পারে এক সারি বড় বড় গাছ। সূর্য গরম হয়ে উঠলে প্ল্যাটফর্মে ছায়া থাকে। প্ল্যাটফর্মের মাঝখানে একটা ছোট্ট স্টেশন ঘর, তাতে স্টেশনমাস্টারের অফিস, টিকিট ঘর আর যাত্রীদের অপেক্ষা করার একটা হলঘর।
ছোট্ট স্টেশন। বেশি লোকের আসা যাওয়া নেই। একজন স্টেশন মাস্টার, তাঁর একজন সহকারী। স্টেশন মাস্টার ট্রেন-এর খবর রাখতেন। কোন কোন ট্রেন এল গেল মস্ত মোটা খাতায় লিখে রাখতেন। কেউ টিকিট কাটতে এলে নিজের অফিস ঘর থেকে বেরিয়ে, টিকিট ঘরে গিয়ে টিকিট দিতেন। কেউ কোন ট্রেন থেকে নামলে তার টিকিট জমা নিতেন।
সহকারী সাহায্য করত। প্ল্যাটফর্মের দু প্রান্তের বড় বড় সিগন্যাল ওঠাত, নামাত। ট্রেন আসার সময় হলে প্ল্যাটফর্মে ঘণ্টা বাজাত। ঝাড়ু দিয়ে স্টেশন পরিষ্কার করত। স্টেশন মাস্টার বাবুর জন্য চা বানিয়ে আনত। সময়ে সময়ে পাম্প চালিয়ে প্ল্যাটফর্মের পাশে মস্ত উঁচু ট্যাঙ্কে জল ভরত।
ছোট্ট স্টেশন। বেশি রেলগাড়ি দাঁড়াত না সেখানে। ভোরবেলা একটা ট্রেন আসত, ফিরত বিকেলে। আর একটা ট্রেন আসত একটু বেলায়, ফিরত সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলে। আরও অনেক ট্রেন আসত যেত, কিন্তু কোনটাই দাঁড়াত না।
টেলিফোনে খবর পেলে স্টেশন মাস্টার সহকারীকে ডাকতেন।
“ঘণ্টা বাজাও,” বলতেন স্টেশন মাস্টার। “এক্সপ্রেস আসছে।”
সহকারী গিয়ে প্ল্যাটফর্মের ঘণ্টা বাজাত। একটা বড় লোহার টুকরোকে আর একটা ছোট লোহার টুকরো দিয়ে পেটাত। শোনার কেউ নেই – শুধু স্টেশন মাস্টার, তবু মন দিয়ে বাজাত। ঘণ্টা বাজত, টং-টং, টং-টং, টং-টং। তারপর গিয়ে সিগন্যাল ডাউন করে দিত। তার পর দূরের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করত, কতক্ষণে ট্রেন দেখা যায়। রেল লাইনটা যেখানে গিয়ে আকাশে মিশেছে, সেখানে ছোট্ট কালো বিন্দুর মত ট্রেনটা দেখা গেলে ডেকে আনত স্টেশন মাস্টারকে। মাস্টার হাতে লাল আর সবুজ নিশান নিয়ে বেরিয়ে আসতেন। লালটা গোটান থাকত, সবুজটা খোলা। হুড়মুড় করে এসে পড়ত এক্সপ্রেস ট্রেন। ইঞ্জিনের দরজা থেকে ড্রাইভার তার সবুজ নিশান দেখাত, ট্রেনের শেষে জানালা থেকে গার্ড তার সবুজ নিশান দেখাত, প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে সবুজ নিশান দেখাতেন স্টেশন মাস্টার। দেখতে দেখতে, স্টেশন কাঁপিয়ে, প্ল্যাটফর্মটা ধুলোয় ঢেকে দিয়ে চলে সেট এক্সপ্রেস ট্রেন। স্টেশন মাস্টার যত্ন করে সবুজ নিশানটা গুটিয়ে নিয়ে চলে যেতেন ঘরে, আর সহকারী সিগন্যালটা আবার সবুজ থেকে লাল করে যেত মাস্টারের চা করতে।
খানিক পরে আবার ফোন বাজত। স্টেশন মাস্টার আবার সহকারীকে ডাকতেন, “ঘণ্টা বাজাও। প্যাসেঞ্জার ট্রেন আসছে।”
টং-টং, টং-টং, টং-টং… আবার বাজত ঘণ্টা। সহকারী এবার আর সিগন্যাল সবুজ করতে যেত না তক্ষুণি। এই ট্রেন থামবে। দূর থেকে দেখা যেত প্যাসেঞ্জার ট্রেন। মাটি কাঁপিয়ে নয়, ঝুক ঝুক করতে করতে, আস্তে আস্তে স্টেশনে ঢুকত। খটাং-খটাং, ঘড়াং-ঘড়াং, ক্যাঁচ-ক্যাঁচ, ফোঁস-ফোঁস – কত রকম শব্দ করতে করতে ট্রেন এসে দাঁড়াত প্ল্যাটফর্মে। বেশিরভাগ দিনই কেউ নামতোও না, উঠতোও না।
স্টেশন মাস্টার ঘর থেকে বেরিয়ে গার্ডের কামরার সামনে দাঁড়াতেন। বলতেন, “নমস্কার, কেমন আছেন, গার্ড সাহেব?”
“ভাল, ভাল,” তড়িঘড়ি জবাব দিতেন বিরক্ত গার্ড। “তাড়াতাড়ি সবুজ নিশান দেখান দেখি! এমনিতেই লেট চলছে, তার ওপর এই ফালতু স্টেশনে আর সময় নষ্ট করে কাজ নেই।”
ট্রেন থামলে সিগন্যাল ডাউন করে এক ছুটে ইঞ্জিন ড্রাইভারের কাছে আসত সহকারী। বলত, “নমস্কার, ড্রাইভার সাহেব, আজ এক কাপ চা খাবেন নাকি?”
“ধ্যাৎ, চা!” মুখ বেঁকিয়ে বলত ইঞ্জিন চালক। “তাড়াতাড়ি ঘণ্টা দাও হে, দেখি লেট মেক আপ করা যায় কী না!”
অগত্যা, সহকারী ঘণ্টা বাজাত, স্টেশন মাস্টার সবুজ পতাকা নাড়াতেন, গার্ড আর ড্রাইভারও সবুজ ফ্ল্যাগ দেখাত, তার পর, ইঞ্জিনের সিটি বেজে উঠত জোরে, ভীষণ তেজের সঙ্গে ফোঁ-ও-ও-ও-ও-শ করে অনেকখানি ধোঁয়া ছেড়ে ইঞ্জিনটা ট্রেনটাকে টেনে নিয়ে চলে যেত। সারা স্টেশনটা কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যেত।
কখনও, অনেক রাতে, একটা মালগাড়ি গড়িয়ে গড়িয়ে এসে থামত স্টেশনে। মালগাড়ির চালক নেমে এসে স্টেশন অফিসে বসে স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে সহকারীর বানান চা খেত।
একবার সে জিজ্ঞেস করেছিল, “খুবই ছোট্ট স্টেশন এটা, তাই না?”
“ভীষণ ছোট,” বলেছিলেন স্টেশন মাস্টার।
“বেশি লোক আসেও না বোধহয়?” জানতে চেয়েছিল মালগাড়ি চালক।
“এখন আর কেউ আসে না,” বলেছিলেন স্টেশন মাস্টার। “আগে কাছের গ্রামটা ছিল বর্ধিষ্ণু, শহর থেকে অনেকেই আসা যাওয়া করত। তখন ছ’টা ট্রেন থামত এখানে। কত ভীড় থখন, কত চাওয়ালা চা বিক্রি করত। খবরের কাগজওয়ালা আসত কাগজ নিয়ে, পত্রিকা নিয়ে। আস্তে আস্তে গ্রামের লোকেরা সবাই শহরে গিয়ে কাজ করতে শুরু করল, বাড়ি করে ওখানেই থেকে গেল। তার পর লোকজনের আসা যাওয়াও কমে গেল। যারা চা কফি বিক্রি করত, তারাও এখান থেকে অন্য স্টেশনে চলে গেল। এখন এখানে সারা দিনে মাত্র দুটো ট্রেন থামে।”
ক্বচিৎ, কদাচিৎ, কখনও সখনও – সিগন্যাল না পেলে, বা রেল লাইনে কোথাও কোন গণ্ডগোল হলে – দূরপাল্লার এক্সপ্রেস ট্রেন বাধ্য হয়ে দাঁড়াত ছোট্ট স্টেশনে। লোকে প্রথমে বলত, “বাঃ, কী সুন্দর ছোট্ট স্টেশন একটা! ঠিক ছবির মতন।” তার পর, যখন অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হত, তখন চা না পেয়ে, খাবার না পেয়ে, বিরক্ত হত। বলত, “এক কাপ চা পাওয়া যায় না, একটা খাবার দোকান পর্যন্ত নেই! কেমন বিচ্ছিরি স্টেশন রে বাবা!”
“কেমন ধারা জায়গা এটা” ভীষন রেগে একদিন এক ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করেছিলেন। “একটা চায়ের দোকানও নেই?”
“ছোট্ট স্টেশন, স্যর,” কাঁচুমাচু হয়ে বলেছিলেন স্টেশন মাস্টার। “কেউ আসেই না প্রায়।”
“কোন মানে হয়? কেউ আসে না – এমন একটা স্টেশন বানান কেন?”
স্টেশন মাস্টার জানতেন না, ওই ভদ্রলোক ছিলেন রেল বিভাগের বড় অফিসার। বড় শহরে তার পরের মিটিং-এ গিয়েই জানতে চাইলেন, “যে স্টেশনে কেউ যায় না, সেরকম স্টেশন আমরা রাখি কেন?”
“ওই স্টেশনের কথা আমরা জানি,” বললেন আর এক জন বড় অফিসার। “ওটা আমরা বন্ধ করে দেব। আর কয়েক মাস অপেক্ষা করছি, তার পরেই স্টেশন মাস্টার আর তার সহকারী রিটায়ার করবে। ওরা অবসর নিলেই আমরা স্টেশনটা বন্ধ করে দেব।”
তাই হল। স্টেশন মাস্টার আর সহকারী অবসর নেবার পরে শহর থেকে রেলের অফিসাররা এলেন ছোট্ট স্টেশনে। স্টেশন মাস্টারের অফিসে তালা লাগালেন। স্টেশন মাস্টার যে সব বড় বড় খাতায় লিখতেন, বাক্সে করে সেগুলো নিয়ে গেলেন শহরে। লাল আর সবুজ নিশানগুলো বন্ধ করে রাখলেন আলমারিতে। টিকিট ঘরে তালা লাগালেন। পাম্পটা খুলে পাঠিয়ে দিলেন আরেকটা স্টেশনে। সিগন্যাল ঘরে তালা দিয়ে সিগন্যালগুলোও খুলে নিলেন।
আর কোন ট্রেনকে ছোট্ট স্টেশনে দাঁড়াতে হত না। ট্রেন ড্রাইভার আর গার্ডরা খুব খুশি হল। বলল, “এই ভাল হল। কেউ আসতও না, কেউ যেতও না। মিছিমিছি দাঁড়াতে হত। সময় নষ্ট হত।”
স্টেশনে মানুষের আসা যাওয়া এমনিই কম ছিল, এখন একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল। গরু আসত প্ল্যাটফর্মে চরতে। বাইরের মস্ত চত্বরে আর রিক্সা, বাস গাড়ি, কিচ্ছু আসত না। শুধু কাছের গ্রাম থেকে ছেলেরা এসে ফুটবল খেলত।
প্ল্যাটফর্মে ঘাস কাটা বন্ধ হয়ে গেল। আস্তে আস্তে সেগুলো লম্বা হতে শুরু করল। গাছের পাতা, কাঠকুটো বা বড় ডালপালা পড়ে নোংরা হতে শুরু হল প্ল্যাটফর্ম। লোহার বেড়া আর মেরামত হল না। মরচে পড়ে সেটা আস্তে আস্তে ভাঙতে শুরু করল। স্টেশন ঘরের রং খসে পড়তে আরম্ভ করল। দেওয়ালে ফাটল ধরল, চলটা উঠতে শুরু করল। এক দিন রাতে ঝড় হল। জলের ট্যাঙ্কের পায়া গেল ভেঙে। ট্যাঙ্কটা প্ল্যাটফর্মে আছড়ে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
কেউ খোঁজও করল না।
কত বছর কেটে গেল। রেল ইঞ্জিনের ড্রাইভাররা, গার্ডরা আস্তে আস্তে ভুলেই গেল যে এখানে একটা ছোট্ট স্টেশন ছিল, যেখানে তারা কোন দিন গাড়ি দাঁড় করাত। শুধু কখনও, অনেক রাতে, একটা ভারি মালগাড়ি আস্তে আস্তে গড়গড় করে যেত সেখান দিয়ে। থামতে হত না তাকেও, কিন্তু তার চালকের মনে পড়ত, অনেক দিন আগে, সেখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে স্টেশন মাস্টার আর তার সহকারীর সঙ্গে চা খাবার কথা।
কখনও, সন্ধ্যার অন্ধকার যখন ঘন হয়ে আসছে, তখন বুড়ো স্টেশন মাস্টার আর সহকারী এসে বসতেন নোংরা প্ল্যাটফর্মে, আর অন্ধকার, আধভাঙা স্টেশন বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দুঃখ পেতেন ছোট্ট স্টেশনটার জন্য।
***
আরও অনেক বছর পরে, বড় শহরের স্টেশনের টিকিট ঘরে এক ভদ্রলোক এসে দাঁড়ালেন। বললেন, “আমাকে ছোট্ট স্টেশনের একটা টিকিট দিন।”
টিকিট ঘরের লোকটি অবাক হয়ে বলল, “সে রকম কোন স্টেশনই নেই!”
ভদ্রলোক বললেন, “নিশ্চয়ই আছে। আমরা ছোট বেলায় কাছের গ্রামে থাকতাম, আর ছোট্ট স্টেশন থেকে ট্রেন ধরতাম বড় শহরে আসার জন্য। কোথায় গেল সেই স্টেশন?”
টিকিট ঘরের বাবু কপাল চাপড়ে বললেন, “এইবারে বুঝলাম। কিন্তু সে স্টেশন তো কবেই বন্ধ হয়ে গেছে।”
ভদ্রলোক ভুরু কুঁচকে বললেন, “তবে কাছের গ্রামে যাব কী করে?”
“পরের স্টেশনে নামতে হবে, ওখান থেকে বাসে বা ট্যাক্সিতে যাবেন,” বললেন টিকিট ঘরের বাবু।
ভদ্রলোক তাই করলেন। পরের স্টেশনের টিকিট কেটে সেখান থেকে গেলেন কাছের গ্রামে। ওখানে পৌঁছনর পর গ্রামের লোকজন নতুন লোক দেখে তাঁকে ঘিরে ধরল।
“কে আপনি?”
“আমাকে ভুলে গেছ? আমি তো ওমুক! ওমুক আমার বাবা! ওমুক আমার মা! অনেক বছর আগে মা-বাবার সঙ্গে আমি বড় শহরে চলে গেছিলাম!”
গ্রামের লোকেরা অবাক! তাই তো বটে! “তখন তো তুমি ছোট্টটি ছিলে – এখন কত্তো বড় হয়েছ। কী করছ আজকাল? বাবা মা কেমন আছেন? এত দিন পরে গ্রামে ফিরলে যে, কী ব্যাপার?”
“বলছি। মা-বাবা ভাল আছেন। তবে বুড়ো হয়েছেন, তাই আর এত দূরে আসতে পারেন না। শহরের বাড়িতে রয়েছেন। আমি পড়াশোনা শেষ করে ব্যবসা করছি। আমি কারখানা বানাই। এখানে আমি কাজে এসেছি। কী কাজ বলছি, কিন্তু গ্রামটা এত ছোট হয়ে গেল কী করে? আমি যখন ছেড়ে গিয়েছিলাম, তখন তো আমাদের গ্রাম এত ছোট ছিল না?”
গ্রামের লোকে বলল, তখন তো গ্রামে কত লোক ছিল। এখন সবাই পড়াশোনা করতে নয়ত কাজের খোঁজে শহরে চলে গেছে। যেমন তোমার বাবা মা চলে গিয়েছিলেন। আমরা ক’জন এখানে পড়ে আছি।”
“সে সব আমি আবার বদলে দেব,” বললেন সেই ভদ্রলোক। “আমি এখানে কারখানা বানাতে এসেছি। বিরাট বড় কারখানা হবে। কত লোকের চাকরি হবে। তখন এই গ্রাম থেকে আর কাউকে চাকরির খোঁজে শহরে যেতে হবে না। বরং সবাই শহর থেকে ফিরে এসে এখানেই থাকবে।”
ভদ্রলোক ঠিক তাই করলেন। দেখতে দেখতে কাছের গ্রামের বাইরে মস্ত একটা কারখানা তৈরি হল। সেই কারখানায় কত লোকের চাকরি হল। গ্রামের লোকের তো চাকরি হল বটেই, এমনকি গ্রাম থেকে যারা শহরে চলে গিয়েছিল, তারাও অনেকে ফিরে এল। শুধু তাই নয়, দূর থেকেও অনেক অনেক লোক সেই কারখানায় কাজ করতে আসত। কিন্তু তাদের রোজ রোজ পরের স্টেশনে নেমে বাসে করে কাছের গ্রামে আসতে হত। তাই সব্বাই মিলে রেল কোম্পানিকে চিঠি লিখল, “আমরা ওই ছোট্ট স্টেশনে নেমে কাছের গ্রামে যেতে চাই।”
তাই রেলের অফিসাররা ফিরে এলেন আবার। সঙ্গে তালা খোলার চাবি। আবার সব ঘর খোলা হল। সব ঘর পরিষ্কার হল। স্টেশন মাস্টারের ঘর খোলা হল, পরিষ্কার হল। টিকিট ঘর খোলা হল, পরিষ্কার হল। ওয়েটিং রুম খোলা হল, পরিষ্কার হল। স্টেশন ঘরের দেওয়ালের ফাটল সারিয়ে ঝকঝকে হলুদ রং করা হল। নতুন জলের ট্যাঙ্ক বসল। নতুন পাম্প লাগান হল। নতুন সিগন্যাল এল – তাতে ঝকঝকে নতুন লাল আর সবুজ আলো। আর, যেহেতু স্টেশনটা আরও বড় করা হল, তাই আরেকটা নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরি হল, যাতে একসঙ্গে দুটো ট্রেন দাঁড়াতে পারে স্টেশনে।
একজন নতুন স্টেশন মাস্টার এলেন। বয়স কম। চটপটে, স্মার্ট। আর একজন সহকারী স্টেশন মাস্টার এলেন। টিকিট বিক্রি করার জন্য আরও একজন এলেন। প্ল্যাটফর্ম পরিষ্কার করার জন্য, সিগন্যাল বদলান’র জন্য, পাম্প চালান’র জন্য আলাদা আলাদা লোক রাখতে হল। বড় স্টেশন কী না!
নতুন স্টেশন মাস্টারের জন্য চেয়ার টেবিল সারান হল, তাতে নতুন করে রং লাগান হল। নতুন টেলিফোনের লাইন লাগল – নতুন টেলিফোন এল। আলমারি খুলে দেখা গেল পুরনো লাল আর সবুজ নিশান দুটোই উইপোকায় খেয়ে ফেলেছে। তাই নতুন স্টেশন মাস্টারের জন্য নতুন ফ্ল্যাগও আনা হল।
সে কী দারুণ দৃশ্য! দিন রাত স্টেশন গম গম করছে। সারা দিনে রাতে আটটা ট্রেন থামে। কত ফেরিওয়ালা! তারা চা, কফি, নানা রকমের খাবার দাবার বিক্রি করে। বই বিক্রি করে, খবরের কাগজ বিক্রি করে, ম্যাগাজিন বিক্রি করে। শ’য়ে শ’য়ে লোক আসতে লাগল।
স্টেশন আর ছোট্ট নয়।
কিন্তু লোকে বলল, স্টেশনের নাম বদলানো যাবে না। তাই তার নাম ছোট্ট স্টেশনই রয়ে গেল।
আগের বুড়ো স্টেশন মাস্টার আর তার সহকারি প্রায়ই আসতেন স্টেশনে নতুন মাস্টার আর তার সহকারীর সঙ্গে গল্প করতে। নতুন স্টেশন মাস্টার চা আনাতেন। সবাই মিলে একসঙ্গে চা খেতেন আর গল্প করতেন আনন্দে। কারণ তাঁদের পুরনো, ভুলে যাওয়া দুঃখী স্টেশন আর দুঃখী নয়।