‘বললে রাজা, ‘মন্ত্রী, তোমার জামায় কেন গন্ধ?’
মন্ত্রী বলে ‘এসেন্স দিছি, গন্ধ তো নয় মন্দ!’
রাজা বলে, ‘মন্দ-ভালো দেখুক শুঁকে বদ্যি’ (সুকুমার রায়)
এখন বদ্যি নয়, গন্ধ বিচার করতে শুরু করেছে প্রায় সকলে। অনেকেই খাবার টেবিলে বসে ধোয়া ওঠা রং-বেরঙ্গের খাবার দেখে গন্ধ শুকতে শুকতে মনে মনে ভাবছেন, গন্ধটা কেমন কম কম মনে হচ্ছে না? অমনি তার শুরু হয়ে যাচ্ছে সন্দেহ। তবে? তবে কি করোনা? ব্যাস্। আবার গন্ধ শোকার চেষ্টা, এবার মনে হলো আরো একটু কম। তবে কি? হঠাৎ মনে হলো, তাই তো, কাল থেকে মাথাটা ধরে আছে মনে হচ্ছিলো। গলাটাও কেমন ভারী ভারী হয়ে আছে। খাওয়া মাথায় উঠলো, যাও বা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল, তাও বন্ধ হয়ে গেল। মুখে এখন সব কিছুই বিস্বাদ লাগছে। আবার হঠাৎ করে মনে পড়লো, বিকাশ বলছিল, করোনায় নাকি স্বাদও কমে যায়! তবে কী? কোনমতে খেয়ে উঠে মুখ গোমড়া করে অন্য ঘরে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে থার্মোমিটার বগলে দিয়ে দেখা। না, এখন স্ত্রীকেও বলা যাবেনা।
গন্ধ দিয়ে শুরু হয়েছিল, দুশ্চিন্তা আর আতঙ্ক নিয়ে সে রয়ে গেল মনের মধ্যে। শুরু হলো রোজ থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর দেখা। মনের আনন্দে স্ফূর্তি আর রইল না।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে যার জন্ম, এখন তার বয়স দশ মাস হয়ে গেল। তাকে এখন আমরা অনেকটা জেনেছি। এখনো না জানার পরিধিটা বেশী, কিন্তু জানার অঙ্কটাও কম নয়। সে আমাদের কি কি ক্ষতি করেছে বা করতে পারে, আমাদের পক্ষে কতটা মারাত্মক সে বিষয়ে আমাদের একটা ধারণা জন্মেছে। একদম অজানা একজন মারাত্মক শত্রুকে দেখে আমরা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আতঙ্কে ছুটে বেড়াচ্ছিলাম, এখন যেন তাকে অনেকটা চিনে ফেলেছি। আমরা অনেকটা ধাতস্থ হয়েছি, তার মানে এই নয়- তাকে হাল্কা ভাবে নেবো। তার থেকে অবশ্যই দূরে থাকবো, তাকে কাছে ঘেষতে দেব না।
সে যে সব ক্ষতি করে বা করতে পারে, তার মধ্যে অন্যতম সে আমাদের ঘ্রাণ শক্তি সাময়িক ভাবে কমিয়ে দিতে পারে।
যে কোন ভাইরাস, বিশেষতঃ যারা আমাদের সর্দি-কাশি ঘটায়, তারা সবাই কম-বেশী ঘ্রাণ কমিয়ে দেয় বা দিতে পারে। সর্দি হলে ঘ্রাণ কমে যায় আমরা জানি। তা হলে করোনার ক্ষেত্রে আমরা এত চিন্তিত কেন? কারণ করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৩০ থেকে ৬০ শতাংশের ঘ্রাণ ক্ষমতা কমে যেতে পারে।
জানতে গেলে আমাদের একটু নাক গলাতে হবে নাকের মধ্যে। আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের অন্যতম নাসিকা বা নাক। ইন্দ্রিয় মানেই শরীরে নার্ভ বা স্নায়ুর তারের মধ্যে দিয়ে সিগনালের আদান-প্রদান। আমাদের ঘ্রাণের নার্ভের বৈজ্ঞানিক বা ডাক্তারী নাম ‘অলফ্যাক্টরি নার্ভ’। আমাদের নাকের উপর দিকটায় থাকে। অসংখ্য ‘নার্ভ ফাইবার’ বা সরু সরু তারের মতো কোষ (নিউরোন) দিয়ে একটি নার্ভ তৈরি হয়। অন্যান্য নার্ভের মতো, এই নার্ভও নষ্ট হয়ে গেলে আর নতুন করে তৈরি হয় না। চিরতরে গন্ধ হারিয়ে যায়। তবে একটি নার্ভ-এ শুধু নার্ভ কোষ বা নিউরোন থাকে না, আরো কয়েক ধরনের কোষ থাকে। তারা নিউরোনের সহযোগী হয়ে কাজ করে। সেই কোষ নষ্ট হয়ে গেলে আবার তারা নতুন করে তৈরি হতে পারে। আমাদের আলোচ্য ‘অলফ্যাক্টরি নার্ভ’-এ এই রকমের দুই ধরনের কোষ আজকের আলোচনায় আসবে, তারা হলো ১) বেসাল কোষ ২) সাস্টেন্টাকুলার কোষ। (এই নামের কোন বাংলা প্রতিনাম নেই)।
কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাসের নাম ‘নভেল করোনা ভাইরাস’। অন্য প্রজাতির আরো করোনা ভাইরাস আছে। তবুও আজকের আলোচনায় আমরা ‘নভেল করোনা ভাইরাস’কে ছোট করে শুধু করোনা ভাইরাসই বলবো।
এই করোনা ভাইরাস শরীরের সব ধরনের কোষকে আক্রমণ করতে পারে না। করোনা ভাইরাস বসার জন্য কোষের গায়ে বিশেষ প্রোটিন বা ‘রিসেপ্টর’ দরকার। যে সব কোষে ACE2 gene বা TEMPRESS-2 থাকে, সেই সব কোষকে করোনা ভাইরাস আক্রমণ করে। যেমন আমাদের শ্বাস নালীর কোষ।
আনন্দের কথা, ‘অলফ্যাক্টরি নার্ভ’ এ এই ধরনের কোন ‘রিসেপ্টর নেই। কিন্তু আগে যে দুই ধরনের কোষের কথা বললাম, বেসাল কোষ ও সাস্টেন্টাকুলার কোষ- তাদের মধ্যে এই ‘রিসেপ্টর আছে। তাই করোনা ভাইরাস এদের ক্ষতি করে এবং সাময়িক ভাবে আমাদের ঘ্রাণ ক্ষমতা চলে যায়। ‘অলফ্যাক্টরি নার্ভ’ ঠিক থাকে বলে গন্ধ আবার ফিরে আসে।
এবার দেখি কতোটা ক্ষতি হয় এবং কি কি ক্ষতি হয়।
আগে একবারে প্রথমে যে গবেষণা হয়েছিল, মে মাস নাগাদ- তখন দেখা গিয়েছিল, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৭ % ঠিক মতো গন্ধ পায় না বা একেবারেই গন্ধ পায় না।
পরে যখন জানা গেল, ঘ্রাণ ক্ষমতা কমে যাওয়া করোনার অন্যতম উপসর্গ, তখন আরো বিস্তারিত গবেষণা হলো। এখন যা তথ্য আছে তাতে দেখা যাচ্ছে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের এক তৃতীয়াংশের ঘ্রাণশক্তি কমে যায়। দু’একটা গবেষণা দেখিয়েছে, এই হার ৬৪ শতাংশ। আসলে, ঘ্রাণ আমাদের বিভিন্ন লোকের এমনিতেই কিছুটা কম-বেশী আছে। তাই ব্যক্তিগত (Subjective) তারতম্য হতে পারে। এখন তাই নানা রকম পরীক্ষা করা হচ্ছে, যাতে ঠিক মতো বোঝা যায়- কতোটা ঘ্রাণশক্তি লোপ পেয়েছে। তার মধ্যে আছে-Olfactory psychophysical assessment, Test of odor threshold, odor discrimination, odor identification ইত্যাদি। এ সব পরীক্ষা করেই করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির ঘ্রাণ ক্ষমতা বিচার করে দেখা যাচ্ছে, আগের থেকে অনেক বেশী শতাংশ লোকের ঘ্রাণশক্তি কমে যাচ্ছে। যা তারা নিজেরাই হয়তো সব সময় বুঝতে পারছে না। আরেকটা গবেষনায় দেখা গেছে, ৬০ জনের মধ্যে ৫৯ জনই ঘ্রাণ কম পাচ্ছে।
আমরা জানি, করোনা হলে জ্বর হয়, সর্দি-কাশি হয়, গলা ব্যথা হয়, পেটের সমস্যা হতে পারে। এ সব হতেই পারে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের ঘ্রাণের সমস্যা সাধারণের চেয়ে ২৭ গুণ বেশী হয়, যেখানে অন্য উপসর্গের মাত্রা ২.২ থেকে ২.৬ গুণ বেশী। কাজেই এমনও হতে পারে, অন্য কোন উপসর্গ নেই, শুধু ঘ্রাণশক্তি কমে গেছে।
আরেকটা কথা বলা দরকার, যেহেতু নাকের অনেকটা অংশ জুড়েই জিভের সাথে সম্পর্ক, তাই গন্ধের সাথে সাথে স্বাদও কমে যেতে পারে।
তবে আশার কথা, এই ঘ্রাণ ক্ষমতা কমে যাওয়া চিরস্থায়ী নয়। অধিকাংশেরই ২ সপ্তাহের মধ্যে ঘ্রাণশক্তি ফিরে আসে। যেহেতু ‘অলফ্যাক্টরি নার্ভ’ আক্রান্ত হয় না, তাই ঘ্রাণ ক্ষমতা ফিরে আসে। কারো কারো অবশ্য সময় বেশী লাগে।
যদি ঘ্রাণ ক্ষমতা ফিরে আসতে দেরী হয়, আরোগ্যের দু’সপ্তাহ পরে ফিরে না আসে তবে কি করণীয়?
তারও বিধান আছে। ‘Olfactory Training” বা ঘ্রাণের ট্রেনিং নিতে হয় তাকে। কি ভাবে?
চার রকমের ঘ্রাণের দ্রব্য নিতে হবে।
১। লেবু
২। গোলাপ
৩। লবঙ্গ
৪। ইউক্যালিপটাস তেল
প্রতিদিন অন্ততঃ ২ বার প্রতিটির ঘ্রাণ ২০ সেকেন্ড করে নিতে হবে। তিন মাস বা দরকারে তারও বেশী।
এ ছাড়া কোন কোন চিকিৎসক স্টেরয়েড জাতীয় স্প্রে ব্যবহারের কথা বলেন, কিন্তু তার কোন নিশ্চিত উপকারিতা প্রমাণিত নয়, বরং অনেক সময় ক্ষতি হতে পারে।
আর বলা হয়েছে নাকের মধ্যে সোডিয়াম সাইট্রেট নেবার কথা। তা ছাড়া ইন্ট্রানেজাল ভিটামিন-এ এবং ওমেগা-৩ যুক্ত ভিটামিন বা খাবার খেতে হবে।
মোদ্দা কথা, করোনা হলে বেশীরভাগ লোকের ঘ্রাণশক্তি কমে যায়, তবে যেহেতু নার্ভকে আক্রান্ত করে না, তাই সাধারণতঃ ২ সপ্তাহের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়। যদি ঠিক না হয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ঘ্রাণের ট্রেনিং নিয়ে কিছু ওষুধ খেলে ঠিক হয়ে যায়। চিন্তার কিছু নেই।
শেষ কথা- করোনা কিন্তু অন্যতম মারণ রোগ। অনেকেরই প্রাণ নিচ্ছে করোনা। তাই মস্তানী না দেখিয়ে সতর্ক থাকুন। মাস্ক পরুন, স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখুন। কারণ, কে জানে আপনিই হয়তো করোনার পরবর্তী টার্গেট।
আপনি সুস্থ থাকুন, অন্যকে সুস্থ রাখুন।