তখন দ্বিতীয় ক্লাসে পড়ি বোধ হয়। দুপুর বেলায় স্কুল থেকে ফিরে দেখি উঠোনময় উদবিগ্ন জনসমাবেশ।উৎকন্ঠায় আচ্ছন্ন পাসের বাড়ি।কাকার ছেলে শুকদেবের মুখটা ভয়ার্ত।কিছু জায়গায় কান্নার রোল। শুকদেবের মা কে মাঠের মধ্যে চন্দ্রবোড়া সাপে কামড়েছে।দ্বিতীয় শ্রেনীর অভিজ্ঞতায় এ ছিল নিশ্চিত মৃত্যুর অপেক্ষা মাত্র।
দুপুরের কিছু পরে বিচিত্র সাজের কিছু লোক এল।হাতে লোহার বালা।দসাশই চেহারা।সবাই তাদের সম্ভ্রম দেখিয়ে সর্পদষ্টের কাছ অবধি এগিয়ে দিলো।এরা জাতে ওঝা।আমাদের গ্রামের স্বঘোষিত গুনিনরাও হাজির তাদের সঙ্গে।শুকদেবের বাবা শুকনো মুখে উঠোন থেকে উঠে ওদের কাজে হাত লাগালো।
ওদের কর্মকান্ডে আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে শুকদেবের কাছ থেকে সরে গিয়ে আমার দিদির কোলে আশ্রয় নিলাম।মন্ত্রের ধ্বনি গমগম করে উঠলো কিছুক্ষন পরেই।হোম শুরু হল। আমার বাবা স্কুল শিক্ষক।খবর পেয়ে দুরগ্রামের স্কুল থেকে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হল। বাবা গ্রামের গুরুজনেদের কাছে বললেন রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে।সবাই তাচ্ছিল্যের সুরে বাবাকে বোঝালেন- এরা হল অমুক গ্রামের নামকরা গুনিন।এদের ওপর ডাক্তার কিছু করে দেবে এটা ভাবাই অন্যায়।
হতোদ্যম হয়ে বাবা সর্পদষ্টের পরিবারের আপনজনেদের রাতের বেলায় আমাদের বাড়ি ডেকে বোঝালেন। ফিরে গিয়ে তারা আবার গ্রামের মোড়লদের কাছে বাবার কু্যুক্তির অযৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলল।ফলে সংখাগরিষ্ঠতার চাপে নতিস্বীকার করে বাবার যুক্তি মুখথুবড়ে পড়ল।মৃত্যু হল সাত দিন পরে।সাতদিনের মন্ত্রচ্চারনের খরচের সাথে পারলৌকিক ক্রিয়ার খরচ মেটাতে বাবা কিছু অর্থসাহায্য করলেন।শুকদেবরা মামাবাড়িতে আশ্রয় নিলো।শুকদেবের বাবার নতুন বিয়ে হল।
এরপর দূরজেলায় নয় বছরের পাঠ শেষে জয়েন্ট এন্ট্রান্স উত্তীর্ন হয়ে যখন চিকিৎসকের তকমা লাগলো নামের আগে ততদিনে সেদিনের সেই স্মৃতিতে শ্যাওলা জমেছে।চিকিৎসার শাস্ত্র অনুযায়ী বুঝেছি সর্পদংশনে মৃত্যু শুধুমাত্র এ সমাজের অজ্ঞানতার ফল মাত্র।পশ্চিমবাংলায় চার ধরনের সাপ ছাড়া (চন্দ্রবোড়া,গোখরো,কেউটে,কালচিতি)বাকি সবই নির্বিষ।বিষাক্ত সাপের কামড়ে একমাত্র এ.ভি.এস ছাড়া কোনোরুপ মন্ত্রচ্চারনে রোগীকে বাঁচানো অসম্ভব। আর নির্বিষ সাপের কামড় পিঁপড়ের কামড়ের ন্যায় গুরুত্বহীন। এক্ষেত্রে রোগি বাঁচাতে কোনোরুপ ওঝা,গুনিন,শক্তিশালী মন্ত্র বা ডাক্তারেরও প্রয়োজন পড়েনা।আর এই নির্বীষ সাপের কামড় নিয়েই ওঝাদের যত কেরামতি।নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি ওঝারা নিজেরাই যখন বিষাক্ত সাপের কামড় খান তখন কিন্তু দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছে এ.ভি.এস নিয়ে নিজেদের জীবন রক্ষা করেন।কিন্তু পরের প্রানের বিনিময়ে নিজের রোজগার করতে তাদের হাত কাঁপে না। অবুঝ সমাজ তাদের এ আসুরিক ভনিতা ঢোঁক গিলে হজম করেন। আর প্রান বাঁচানো ডাক্তারকেই অসুর রুপে প্রতিষ্ঠা করে সামাজিক অবক্ষয়ের চাক্ষুষ প্রমান দেয়।প্রথিতযশা চিকিৎসক দয়ালবন্ধু মজুমদারের মত অনেকের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আজ সাপের কামড়ে মৃত্যুকে নিছকই সমাজের অসচেতনতার ফল বলে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়।আজ আমরা সবাই জানি বিষাক্ত সাপের কামড়ের একশ’ মিনিটের মধ্যে যদি একশ’ মিলিলিটার (দশ ভায়াল) এ.ভি.এস রোগীর শরীরে প্রবেশ করানো যায় সে রোগির একশ শতাংশ বাঁচার সম্ভাবনা থাকে।প্রতিটি শয্যাবিশিষ্ট সরকারী প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই এ.ভি.এস বিনামুল্যে পাওয়া যায়।ডেবরা হাসপাতালে কাজের সুবাদে প্রচুর বিষাক্ত সাপের কামড়ের রোগী দেখেছি।ভ্রান্ত ধারনার বশবর্তী হয়ে সময়ে না পৌঁছানোর খেসারত রোগীর মৃত্যুর বিনিময়েও রোগীর বাড়ির পরিজনেদের আজও বোঝাতে পারিনি। আজও যখন একশ’ মিনিটের মধ্যে হাসপাতালে আসা সর্পদষ্টের রোগীদের ন্যুনতম পরিকাঠামোয় বাঁচিয়ে ফেলতে পারি,সবাই তখন বিশাল কিছু করেছি ভেবে ধন্য ধন্য করে।
আমার মনের কোনে কিন্তু একটা অতৃপ্ত ইচ্ছে আজও হানা দেয়।অগোচরে চোখের কোলটা ভিজে ওঠে। ছোটোবেলার সেদিনের সেই মন্ত্রোচ্চারন তাচ্ছিল্যের তর্জনী তুলে এখনও অনুরনিত হতে থাকে “ হেরে দেরে চন্দ্রবোড়া,যাকে খায় তার ব্রম্ভ পোড়া”।
এক সেনা ডাক্তারের ডায়েরী পর্ব -১১
ইস্ট-পাকিস্থানের মুক্তি যুদ্ধ স্বাধীনতার সময় ভারত ও পাকিস্থানের বিভাজনের সঙ্গে বাংলাও বিভাজিত হয়– পুর্ব ও পশ্চিম। পূর্ব বঙ্গ পূর্ব-পাকিস্থান হয়ে ইসলামবাদের অধীনে আসে। ভাষা ও