রূপালীর সাথে দেখা সাক্ষাত খুব কমই হয়। সৌভাগ্যক্রমে আজ রবিবার রাত আটটায় বাড়ি ফিরে দেখি রূপালীও উপস্থিত। দুজনে বসে বসে চা খাচ্ছিলাম, আর সুখ দুঃখের গল্প করছিলাম।
তবে গল্পে মাঝে মাঝেই বাধা পড়ছিল। একের পর এক ফোন আসছে। কারো জ্বর কমছে না, কারো আবার প্লেটিলেট কাউন্ট তেত্রিশ হাজার, কারও প্রেশারের ওষুধ খেয়ে মাথা ঘুরছে।
রূপালী চরম বিরক্ত হয়ে বলল, ‘সারা সপ্তাহে আমার সাথে একঘণ্টা কথা বলো কিনা সন্দেহ। অন্তত সেটুকু সময় তো ফোনটাকে বন্ধ রাখতে পার। ওদিকে চেম্বারে রোগী দেখার সময় তো দিব্যি ফোন বন্ধ করে রাখ। প্রয়োজনে আমিই তোমাকে ফোন করে পাইনা।‘
আমি বললাম, ‘তুমি পার্থকে ফোন করবে, অথবা গৌরকে। ওদের বললে ওরা আমাকে জানিয়ে দেবে।‘
রূপালী এবারে একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। বলল, ‘তোমার সাথে কথা বলার জন্য আমাকে শেষ পর্যন্ত অন্য লোককে ফোন করতে হবে?‘
দেখলাম পরিস্থিতি ক্রমশ হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। বললাম, ‘রাগ কোরোনা লক্ষ্মীটি, আমি ফোন আধঘণ্টা বন্ধ রাখছি। এই আধঘণ্টা শুধু তোমার সাথেই গল্প করব।‘
ফ্লাইট মোডে পাঠানোর চেষ্টা করতে করতেই ফোন আবার বেজে উঠল। সঞ্জয়দা ফোন করেছে। কাঁচুমাচু মুখে বললাম, ‘এইটা ধরে নিচ্ছি। আর ধরব না।‘
সঞ্জয়দা আমাদের গাড়ি চালায়। ফোন ধরে বললাম, ‘তোমাকে যেমন বলেছিলাম, তুমি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গাড়ি নিয়ে অশোকনগরে দীপকদার বাড়িতে চলে যাবে। দীপকদা বেশ কিছু সাপ দেবেন। সেগুলো নিয়ে তুমি আমার খাটের তলায় সাবধানে ঢুকিয়ে রাখবে। পরের দিন বেলা বারোটা নাগাদ ঐ সাপ বইমেলায় নিয়ে যাব।‘
ফোন কাটা মাত্রই রূপালী বলল, ‘তুমি সঞ্জয়দাকে কী আনতে বললে?’
‘সাপ।‘
‘সাপ দিয়ে কী করবে?’ রূপালী প্রায় আঁতকে উঠে বলল।
বললাম, ‘চার তারিখ থেকে চৌমাথায় বইমেলা আছে। সেখানে আমাদের প্রণতি প্রকাশনীর স্টলে একটা সর্প প্রদর্শনী করব। সবাইকে সাপ দেখিয়ে হাতে কলমে সাপ চেনাব।‘
‘তোমার কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে? তুমি বই মেলায় সাপ রাখবে? উদ্যোক্তারা তোমাকে কিছুতেই রাখতে দেবেন না।‘
আমি হেসে বললাম, ‘উদ্যোক্তাদের সাথে আমার কথা হয়ে গেছে। ওনাদের কোনো আপত্তি নেই। এবারে আমরা স্টল আরও বড়ো করছি। দু’শ স্কোয়ারফিট। ছোটো মেসো নিজেই মাথা খাটিয়ে বই ডিসপ্লের জন্য স্ট্যান্ড কারখানা থেকে বানিয়ে এনেছে। দেখবে এবারে বইমেলা আমরাই জমিয়ে দেব।‘
রূপালী এতো খুশির খবর শুনে একটুও আনন্দিত হল না। ভয়ানক গম্ভীর গলায় বলল, ‘তুমি এই খাটের তলায় বিষাক্ত বিষাক্ত সাপ রাখবে? সেই খাটে শুয়ে তুমি ঘুমবে? তোমার কী মাথা সত্যি সত্যিই খারাপ?’
আমি বললাম, ‘যে সাপ আনা হবে তার বেশিরভাগই নির্বিষ। ঘরচিতি, হেলে, দাঁড়াস, লাউডগা, পুয়ে এই সব। বিষধর সাপ বলতে একটা কালাচ, একটা গোখরো আর একটা চন্দ্রবোড়া।‘
রূপালী বলল, ‘থাকো তুমি তোমার সাপ নিয়ে। আমি চললাম। রাতের ট্রেনেই আমি বহরমপুর যাব।‘
এতো ভালো বিপদ। সাপ আর স্ত্রীর মধ্যে বাছতে হলে নিঃসন্দেহে স্ত্রীকেই বাছা উচিৎ। কিন্তু এদিকে অনেক পরিকল্পনা করা রয়েছে। পোস্টার টোস্টার তৈরি করে ফেলা হয়েছে। বললাম, ‘তুমি একটু মাথা ঠাণ্ডা করে বোসো। আমি তোমাকে বিস্তারিত বোঝাচ্ছি।‘
রূপালী বলল, ‘মাথা ঠাণ্ডা করব? এর পরেও আমি মাথা ঠাণ্ডা করব? তুমি যা সব কাণ্ড ঘটাও তাতে কারো পক্ষে মাথা ঠাণ্ডা রাখা সম্ভব? বাড়িতে তিনটে বাচ্চা রয়েছে। সাপ আনার আগে ওদের কথা একবার মনে এলো না?’
আমি বললাম, ‘দেখো, সাপ দেখে ওরাই সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাবে। তাছাড়া আমরা ছোটো বেলায় রাস্তা ঘাটে, পুকুরে জঙ্গলে কতো সাপ দেখতাম। ওরা তো সেসব দেখেনি। সাপ চিনে রাখাটাও তো জরুরি।‘
রূপালী দেখছি আমার সব কথাতেই রেগে যাচ্ছে। সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল, ‘হ্যাঁ, সাপ চেনাও আর চেনাতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটাও।’
দুর্ঘটনা? আমি বাস্তবিকই অবাক হই। ‘কী দুর্ঘটনা ঘটবে? আমি খুব সাবধানে দেখাবো। কাঁচের বয়েম কিছুতেই ভাঙবে না।’
‘কাঁচের বয়েমে কেন? সাপুড়েদের মতো ঝুড়িতেই তো সাপ রাখতে পারতে। ছি ছি, ডাক্তার হয়ে শেষ পর্যন্ত সাপ খেলা দেখাবে।‘
এইবার ব্যাপারটা আমার মাথায় ঢোকে। এবং হাসতে হাসতে আমার হেঁচকি উঠে যায়। রূপালী ততক্ষণে একটা ট্রলি ব্যাগে জামা কাপড় ঢোকাতে শুরু করেছে। আমার হাসি দেখে সেও থমকে যায়। গম্ভীর মুখে বলে, ‘হাসছ, এর পরেও তুমি হাসছ? লজ্জা নেই তোমার?’
আমি বলার চেষ্টা করি, ‘ হি হি… তুমি কী ভেবেছ… হি হি হিক… আমি জ্যান্ত সাপ এনে খাটের তলায়… হিক উরে বাবা রে… হি হি… জানো না জ্যান্ত সাপ আটকে রাখা বন্য প্রাণী আইনে… হিক …ইয়ে… এতো কাঁচের বয়েমে ফর্মালিনে মৃত সাপ…হি হি…’
রূপালী থমকে যায়। তারপর বলে, ‘সে কথা তো প্রথমে বললেই হতো।‘
হাসি কোনোমতে চেপে বললাম, ‘অনেকে ভয় পেয়ে সাপ দেখলে মেরে ফেলেন। দীপকদারা বিভিন্ন জায়গা থেকে সেই সব মৃত সাপ সংগ্রহ করেন। আর তুমি কী করে ভাবলে… হি হি।’
রূপালী আমার দিকে রোষকষায়িত নয়নে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি বলেই ভাবছিলাম। তুমি মাঝে মাঝেই এমন সব ঘটনা ঘটাও, আমার ধারণা তোমার পক্ষে সবই সম্ভব।‘
এখন স্ত্রীর এই বাক্যটাকে প্রশংসা হিসাবে নেব না নিন্দা হিসাবে সেটাই বুঝতে পারছি না।
আপাতত আপনাদের সকলকে আমন্ত্রণ মধ্যমগ্রাম চৌমাথার বই মেলায় প্রণতি প্রকাশনী ও ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির অশোকনগর শাখার সম্মিলিত স্টলে।
বই মেলা চলবে ৪ নভেম্বর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত, বেলা ৩ টে থেকে রাত ৯টা।