শব্দ দুটি কি সমার্থক? অবশ্যই নয়! করোনা প্রকোপের পর আমাদের সরকারি সমস্ত বিজ্ঞপ্তি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলছে। শুধু আমাদের দেশে নয়, অন্যান্য দেশেও।
সামাজিক দূরত্ব মানে কি? একে অপরকে এড়িয়ে চলা। নিজ নিজ কুটিরে বন্দী থাকা। এই সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কি একটা সমাজ টিঁকে থাকতে পারে? সমাজের ভিত্তিটাই ভেঙে পড়ে না?
শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা মানে এমন একটা দূরত্ব, যাতে রোগ না ছড়ায়। সাবধানতা অবলম্বন করেও সামাজিক থাকা যায়। হয়তো অনেকে লক্ষ্য করেছেন অতিসম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং-এর বদলে ফিজিক্যাল ডিস্ট্যান্সিং শব্দগুলো ব্যবহার করছে। কারণ হিসেবে বলছে সামাজিক দূরত্ব মানুষের মনের উপর চাপ সৃষ্টি করে। অনেকে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে এক আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ মানুষের বিপদে-আপদে এগিয়ে আসছেন না! কেউ মারা গেলে তাঁকে দাহ করতে বা কবর দিতে আত্মীয় প্রতিবেশীরা এগিয়ে আসছেন না। কী দুঃসহ এই পরিবেশ!
অথচ আমাদের, বাঙ্গালীদের ব্যতিক্রমী একটা ইতিহাস আছে।
১৮৬৯-এ বর্ধমানের লাগোয়া অঞ্চলে ম্যালেরিয়া মহামারী রূপে দেখা দেয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় সোজা বর্ধমানে গিয়ে ডেরা বাঁধেন। সেখানে কিছুজনের সহায়তা নিয়ে একটা ক্লিনিক খোলেন এবং শয়ে শয়ে মানুষকে কুইনিন দিয়ে চিকিৎসা করেন। তিনি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলে কয়েক হাজার লোক ম্যালেরিয়াতে মারা যেতেন। একথা ইতিহাসের পাতা খুঁজলেই জানা যাবে।
১৮৯৮-এ প্লেগের মহামারীর সময় আজকের মতই ভয়ঙ্কর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। তখন স্বামী বিবেকানন্দ প্লেগ নিয়ে এক ইশতেহার প্রকাশ করেন। তারপর মার্চ ১৮৯৯-এ ভগিনী নিবেদিতা ও স্বামী সদানন্দ প্লেগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন কিছু সঙ্গী-সাথী নিয়ে। মনে রাখতে হবে এটা ছিল বিউবোনিক প্লেগ অর্থাৎ এর সংক্রমণ ক্ষমতাও ছিল আজকের করোনার মত। প্লেগ রোগীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তাঁদের চিকিৎসা করা, আশপাশের নোংরা আবর্জনা পরিষ্কার করা। অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করে। কথিত আছে ডা রাধা গোবিন্দ করের অসম্মতি সত্বেও নিবেদিতা এক বস্তিতে একটি প্লেগ আক্রান্ত শিশুকে নিয়ে দুইদিন ছিলেন–শিশুটি মারা যাওয়া পর্যন্ত। একে বলে সহমর্মিতা!
আজকের করোনা মহামারীতে এই সহমর্মিতার অভাব চারিদিকে অত্যন্ত প্রকট। তাই শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই পথ চলা শ্রমিক মজুররা অভুক্ত/অর্ধভুক্ত হয়ে চলেছেন। সরকার কি ব্যবস্থা নিয়েছে সেই আলোচনায় যেতে চাইছি না, সাধারণ মানুষ কতটা সাহায্য করছেন?
সামাজিক দূরত্বে সহমর্মিতার বড়ই অভাব। তাই আমার পরিচিত এক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বিধান নগরে তাঁদের বাড়িতে পুলিশ ডেকেছিলেন কিছু আবশ্যিক ওষুধ এনে দিতে। পুলিশ এনেও দিয়েছে। কিন্তু তাঁদের দীর্ঘদিনের প্রতিবেশীদের কাছে হয় আবেদন করেননি অথবা আবেদন করলেও প্রতিবেশীরা সাহায্য করেননি। একেই বলে সামাজিক দূরত্ব!!
ঠিকই। শারীরিক দূরত্ব বলা যুক্তিযুক্ত।লম্বা লম্বা চামচ,হাতা বাজারে খুব বিক্রি হচ্ছে।ডাক্তার দের শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চিকিৎসা করা সম্ভব হচ্ছে না,তাই অনেকেই মৃত্যু বরন করছে। physical medicine physical distancing করে কি ভাবে করা যায় ভাবতে হবে।
অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক আর প্রয়োজনীয় চিন্তা। এটি ছড়িয়ে দেওয়া দরকার।
এ বিষয়ে যোগ করতে চাইঃ
১) করোনা ভাইরাস-জনিত আতঙ্ক আর অজ্ঞানতা আমাদের চরিত্রের কয়েকটি দিক প্রকট করেছে যা এতদিন আমাদের সমাজের কিছু ‘ব্যাধি’ এখন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। এতদিন এগুলি ছিলই, তবে মূলত প্রচ্ছন্ন ছিল। তার মধ্যে প্রধান হ’ল আমাদের অতি স্বার্থপর চিন্তা, এখন আমাদের কাজেকর্মে তার প্রকাশ। ‘আমার সন্তান যেন …’ – এই ভাবনা কিন্তু সামূহিক নয়, এখন এটি নিছক পরিবারকেন্দ্রিক! আমি, আমার পরিবার ‘isolation’-এ থেকে নিরাপদ থাকব, কিন্তু আমার বাড়ির ‘কাজের লোক’ সংক্রামিত হওয়ার যাবতীয় ঝুঁকি বহন করেও আমার বাড়ির কাজ যেন করে দিয়ে যায়!
এ তো অজস্র স্বার্থপর চিন্তার একটি মাত্র উদাহরণ! কাল্পনিক নয়, প্রতিদিন দেখছি।
২) পাশাপাশি, এমন অনেক মানুষ দেখছি, যাঁরা একক বা সংগঠিতভাবে বিপন্ন, দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। যতটা সম্ভব ‘শারীরিক’ দূরত্ব মেনেও ‘সামাজিক’ দূরত্বের স্বার্থপর তত্ত্ব তারা খারিজ করেছেন। এও কোনো আহরিত তথ্য নয়, নিজে প্রতিদিন যা দেখছি, বুঝছি।
সমাজ তার নিয়মেই চলবে। আমরা আশায় থাকব স্বার্থপর সমাজেও এখনো যাঁরা আজকের বিবেকানন্দ-নিবেদিতা, তাঁদের দিকে তাকিয়ে। এঁদের প্রয়াসে হাত বাড়িয়ে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব, সমাজের ‘পাপ’ শোধরানোর এক ক্ষীণ চেষ্টা ।।।
সামাজিক শব্দটা সুচিন্তিতভাবে প্রয়োগ হয়েছে, শারীরিক শব্দ টা সরিয়ে।
মানুষ মানুষের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব তৈরির বহুদিনের প্রচেষ্টা কিছুটা হলেও সফল হলো l
‘সামাজিক দূরত্ব’ পথ্যটি মনঃপুত ছিলনা। আশিস ধন্ধটির নিরসন করে উপকার করলেন। আমরা যদি এরকম ভাবি এবং উদ্যোগী হই তাহলে এই দুঃসময়ে সমাজের বাঁধন দৃঢ় হয়। প্রসঙ্গত আশিস তাঁর রচনায় বিদ্যাসাগর আর নিবেদিতার প্রসঙ্গ সঠিক ভাবে উপস্থাপন করেছেন। বিদ্যাসাগরের দৌহিত্র সূর্য্য কুমার অধিকারী তার দাদামশায়ের স্মৃতি চারণে বর্ধমানে ম্যালেরিয়া রোগিদের সেবায় বিদ্যাসাগরের সহমর্মিতার কথা লিখেছেন। অংশটিতে বিদ্যাসাগরের সহমর্মিতা কত তীব্র ছিল তা উল্লেখনীয়।-
সরকারী সাহায্যের আশায় না থেকে তিনি নিজেও স্বতন্ত্র চিকিৎসালয় খুললেন। এই চিকিৎসালয় থেকে ওষুধ, পথ্যও দেওয়া হতে লাগল রোগীদের। বিদ্যাসাগরকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন প্যারীচরণ মিত্রের আত্মীয় গঙ্গানারায়ন মিত্র। ক্রমশঃ রোগীর ও প্রার্থীর সংখ্যা এত বেড়ে গেল যে, কোনও একজন লোকের সামর্থ্যে এত কুইনিন, পথ্য ও অর্থ দেওয়া অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। অবস্থা দেখে গঙ্গানারায়ন বলেন অই গরীব পল্লীর রোগীদের কুইনিনের বদলে সিঙ্কোনা দেওয়া হোক। বিদ্যাসাগর রাজী হননি, বলেছিলেন – অর্থশালী ব্যাক্তিদের জন্য কুইনিন, আর দরিদ্রের জন্য সিঙ্কোনার ব্যাবস্থায় আমি রাজী নই। এখনও আমি দেউলিয়া হই নি।
১৮৯৮ সালের মার্চ মাসে কলকাতায় যখন প্লেগের প্রকোপ দেখা দেয় তখন নিবেদিতার সাথে রবীন্দ্রনাথও রোগগ্রস্থ মূমূর্ষুদের সেবায় নিজেকে নিয়োযিত করেন। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর সঙ্গী। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর জানিয়েছেন –
সেই সময় কলকাতায় লাগল প্লেগ। চারিদিকে মহামারী চলছে, ঘরে ঘরে লোক মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। রবিকাকা আর আমরা এবাড়ির সবাই মিলে চাঁদা তুলে প্লেগ হাসপাতাল খুলেছি, চুন বিলি করছি। রবিকাকা ও সিস্টার নিবেদিতা পাড়ায় পাড়ায় ইন্সপেকশনে যেতেন।