উনিশ শো আটানব্বইয়ের নভেম্বর মাসের বারো তারিখে, উত্তর দিনাজপুরের জেলা সদর রায়গঞ্জের কর্ণজোড়ায় সিএমওএইচ অফিসে সরকারি চাকরির যোগদানের নথিতে সই করলাম আমি।
আর তার তিন দিন পরে, রায়গঞ্জ থেকে আরও পঁচিশ কিলোমিটার দূরের ছোট্ট একটা হাটুরে মফস্বল শহরের অন্ধকার হাইওয়ের ধারে, বাস গুমটির সামনে থেকে কলকাতার বাসে চেপে বসল বাবা-মা। আমি একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম, কলকাতা থেকে সাড়ে চারশো কিলোমিটার দূরত্বের একটা অচেনা আধাশহরের জনবিরল রাস্তায়, বহু দূরে, জমাট অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে একটা দূরপাল্লার বাসের রক্তচক্ষু টেললাইট।
হেমন্তের তারাখসা আকাশের ছাদের নীচে, আমার ভীরু চোখ থেকে গড়িয়ে আসা দু’ফোঁটা গোপন অশ্রুর সাক্ষী হয়ে রইল একটা অচেনা, টিমটিমে মফস্বল শহর — কালিয়াগঞ্জ।
কালকেউটের পিঠের মতো মসৃণ চকচকে একটা রাস্তা, দুধারে হাটুরে দোকানপাট — সাইকেল সারাই, হার্ডওয়্যার, এসটিডি বুথ, ক্লথ মার্চেন্ট, মুদিখানা – সব কিছুর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। ষাট পাওয়ারের হলুদ বাতি কিংবা সবজে সাদা হ্যাজাকের আলো। ওরই মধ্যে স্টেশনারি দোকান রঞ্জন স্টোর্স আর শাড়ি বিপণি হরিনারায়ণ বস্ত্রালয় একটু ঝলমলে।
রাস্তার একপ্রান্তে বয়রা কালীর মন্দির। সেখান থেকেই ছাড়ে কলকাতার বাস। বয়রা অর্থে বধির। এমন কালীঠাকুর যে নাকি ভক্তের প্রার্থনা শুনেও শোনে না। আসলে ভয়ঙ্কর জাগ্রত। ফি বছর কালীপুজোয় নাকি দুশো আড়াইশো পাঁঠাবলি হয় সেখানে — রক্তগঙ্গা বয়ে যায় মন্দির চত্বরে। এসব আমায় শুনিয়েছিল আমার রাঁধুনি কাম রাইট হ্যান্ড বেলা। এই গঞ্জ শহরে যে মানুষটির বাড়িতে ভাড়াটে হয়ে উঠেছিলাম প্রথমে, সেই সুনীলদার জুটিয়ে দেওয়া লোক। ওই সাপের পিঠের মতো রাস্তার মাঝামাঝি সুনীলদার ওষুধের দোকান — পপুলার ড্রাগ হাউস। পাশে আরো একটা – সরমা মেডিক্যাল, তার মালিক আলাদা। এই দুই দোকান মালিকই তাঁদের ঘরবাড়ির অংশ এবং ওষুধের দোকান লাগোয়া চেম্বার কালিয়াগঞ্জ হাসপাতালের নবাগত ডাক্তারদের ভাড়া দেবার জন্য সদা উন্মুক্ত রেখেছিলেন। কোয়ার্টার খালি নেই? কুছ পরোয়া নেহি, সরমা আর পপুলারের ভাড়াবাড়ি আছে।
ঐ দুটো দোকানের উল্টোদিকে ছিল কালিয়াগঞ্জ স্টেশন। ভাড়ার সাদা অ্যামবাসাডর আর রিকশার ভিড়ে, ছোট্ট লাল বাড়ির গায়ে খুপরি টিকিট কাউন্টার আর সিমেন্টের হলদে থামে আঁকাবাঁকা কালো অক্ষরের ‘কালিয়াগঞ্জ’ কথাটার অস্তিত্বই সঙ্কটে পড়ে গিয়েছিল। অবশ্য কৌলীন্য কিছু ছিল না সে স্টেশনের। দিনে চারপাঁচবার হাঁপাতে হাঁপাতে নিচু প্ল্যাটফর্ম ছুঁতো শিবরাত্তিরের সলতের মতো একখানি প্যাসেঞ্জার ট্রেন – বারসই রাধিকাপুর প্যাসেঞ্জার। একদিকে বিহারের বারসই, অন্যদিকে বাংলাদেশ সীমান্তের রাধিকাপুর। মধ্যিখানে কয়েকটি অশ্রুত রোম্যান্টিক নাম – ঝিটকিয়া, বাঙালবাড়ি, ডালিমগাঁও—
কালিয়াগঞ্জ শহরের বুক চেরা রাস্তাটার অন্য প্রান্তে একটা স্ট্যাচু। বিবেকানন্দের। সেটা শহরের বিবেকানন্দ মোড়। আমার হুল্লোড়বাজ সহকর্মী জয়ন্ত-র ভাষায় বিলে মোড়। বিলে মোড়ে ছিল একখানা মিষ্টির দোকান, শহরের ভারী নামকরা – সেখানে মিষ্টির ভ্যারাইটি বলতে ছিল রসগোল্লা আর কালাকাঁদ ধরনের ছানার সন্দেশ। তবে কালিয়াগঞ্জের স্পেশ্যালিটি ছিল রসমালাই। বিত্তবান/দরিদ্র নির্বিশেষে প্রতিটি বিয়েবাড়ির স্ট্যান্ডার্ড মেনু ছিল তুলাইপাঞ্জি চালের ভাত, খাসির মাংস আর রসমালাই।
ঐ যে, কুয়াশামাখা ভোরে নর্থবেঙ্গল স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশনের বাস একটা শীতে জড়োসড়ো, শাড়ি-শাল-সোয়েটারের পুঁটলিকে নামিয়ে দিলো বিবেকানন্দ মোড়ে। সঙ্গে ছোটো একটা ভিআইপি সুটকেস।
রিকশা ছুটে এলো সেটা তুলবে বলে। ওই তো মহেন্দ্রগঞ্জ বাজার – হাসপাতালপাড়ায় ঢুকছে রিকশা। আরো এগোলে পঞ্চায়েত সমিতি আর বিডিও অফিস। তারপরেই তিস্তা প্রকল্পের ক্যাম্পাস। ডাইনে তাকালে বিশাল বাড়ির গম্ভীর গেটের বাইরে ফলকে লেখা নামে চোখ আটকাবে – ডঃ এস কে কোলে
ডঃ মিসেস মঞ্জু কোলে।
তারপরেই একটা দরজাবিহীন তোরণ যেন – সেখান দিয়ে রিকশা ঢুকলেই দেখতে পাওয়া যাবে ডানহাতে বটগাছতলার ধারে, নোনাধরা আদ্যিকালের অফিসবাড়ি। তার পাশে নিচু টিনের চালের আউটডোর, তারও পাশে এক্সরে আর ইসিজির ঘর। আর বাঁদিকে টানা বারান্দাওয়ালা টিনের চালের একতলা ব্যারাকের মতো হাসপাতাল বাড়ি – কোনো সম্বোধনী প্রমোশনেও যাকে ‘বিল্ডিং’ বলা যাবে না।
একপাশে তিরিশ বেডের মেল ওয়ার্ড, অন্যপাশে সমসংখ্যক বিছানার ফিমেল ওয়ার্ড। মাঝে চৌখুপি জায়গাটায় সিস্টারদের ঘর, একটা ত্যাড়াবাঁকা আউটডোর অপারেশন থিয়েটার আর একখানি মলিন লেবার রুম।
মেল ওয়ার্ডের রোগী সংখ্যা খুবই কম, তাই সে ঘর অপেক্ষাকৃত পরিচ্ছন্ন। ফিমেল ওয়ার্ডে কিন্তু তিল ধারণের জায়গা নেই। দু’সার জং ধরা লোহার খাটের মাঝের একফালি জায়গায় গুঁতোগুঁতি করছে ঘাড় মোচড়ানো স্যালাইন স্ট্যান্ড আর তোবড়ানো অক্সিজেন সিলিন্ডার। মেঝেতে পা ফেলবার জায়গা মেলা দুষ্কর। কুটকুটে লাল কম্বলের উপর সবজে চাদর বিছিয়ে তৈরি করা ‘বেডে’ উপছে পড়ছে রোগী।
প্রায় প্রত্যেকের সঙ্গেই বাড়ির লোক রয়েছে। ব্যথায় ছটফট করা প্রসূতির মাথার কাছে বসে দাঁতে কালো ফিতে চেপে চিরুনি দিয়ে চুল বাঁধছে শাশুড়ি, তার পাশের বেডেই ডায়েরিয়ায় নেতিয়ে পড়া শিশুর মুখে স্তন গুঁজে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে তরুণী মা, আর এই দুই বিছানার পায়ের কাছে ‘এক্সট্রা বেড’এ নাকে অক্সিজেনের নল, হাতে স্যালাইনের চ্যানেল আর মূত্রনালিতে ক্যাথিটার গোঁজা চেতনাহীন স্ট্রোকের রোগিণীর কোলের কাছে গুটিয়ে শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে দুই বিনুনির কিশোরী!
হাতের কিডনি ডিশে ইঞ্জেকশনের অ্যাম্পুল আর কাচের সিরিঞ্জ নিয়ে বেডে বেডে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সর্বংসহা সিস্টার দিদিরা।
তারই মাঝে ন্যাকড়া জড়ানো কাপড়ের পুঁটুলি হাতে লেবার রুম থেকে বেরোচ্ছে আয়া মাসি —
“ও দিদি, লিখে নাও, বারো নম্বরের মেল বেবি, ওজন দু’কিলো আটশো” —
গড়গড় শব্দে গড়িয়ে আসছে ডায়েটের গাড়ি। গরম ভাত আর পাঁচমেশালি ঘ্যাঁটের গন্ধে গা ঝাড়া দিয়ে উঠছে ওয়ার্ডের বাইরের ঝিমোতে থাকা হুলো বেড়ালটা।
এই হাসপাতাল বাড়ির উল্টোদিকে দুই কামরার আউটডোর বিল্ডিং, রাস্তা থেকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়। একেকটি ঘরে একটি টেবিল আর চারটি করে চেয়ার, সর্বাধিক চারজন করে ডাক্তার বসতে পারেন সেখানে। এই চেয়ার টেবিল আর দেয়ালের মধ্যে যে সামান্য পরিসর, তার একদিকে কোনো মতে একটা কাঠের শোয়ার জায়গা — সেটা রোগীদের একজামিনেশন টেবিল। খুব কম রোগীদেরই শুইয়ে পরীক্ষা করার সময় পাওয়া যেত, কারণ ঐ ঘন্টা পাঁচেক আউটডোরের অবকাশে জনা চারেক ডাক্তারকে দৈনিক প্রায় ছ’শো রোগী দেখতে হতো। জেনারেল আউটডোরের পিছনের ঘরে বসতো ডেন্টাল ওপিডি, তার পরিসর দেখলে পাড়ার চিলতে সেলুনও অবাক হয়ে যাবে।
আউটডোর বিল্ডিং এর এক পাশে ছিল এক্সরে ঘর আর অন্যপাশে, বটতলার নিচে, জীর্ণ হাসপাতাল অফিস।
সেখানেই আমার প্রথম আলাপ হয়েছিল ডক্টর কোলের সঙ্গে। কালিয়াগঞ্জ হাসপাতালের তৎকালীন বিএমওএইচ ডক্টর শিশির কোলে — এক অজানা দূরশহরে যে মানুষটার অভিভাবকত্বে আমাকে সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্তে কলকাতা ফিরে গিয়েছিল আমার বাবা মা।
লেবার কেস সম্পর্কে আমার অজ্ঞতা অকপটে ব্যক্ত করার পর যিনি সংক্ষেপে বলেছিলেন, “কোনো চিন্তা নেই, পুতুলমাসি, প্রণতিমাসির কাছে শিখে নিও। ওরা খুব এফিসিয়েন্ট।”
আমার কালিয়াগঞ্জ বাসের প্রতিটি অভিজ্ঞতার প্রতিটি পরতে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে রয়েছেন এই মানুষটি এবং তাঁর পরিবার। দু’চার কথায় তাকে বেঁধে ফেলা অসম্ভব।
ঐ যে, পুতুলমাসির হাতে আমার প্রথম প্রসূতির যোনিপথের এপিসিওটমি সেলাই শেখার হাতেখড়ি হচ্ছে।
কিচেনের ভিতর শোনা যাচ্ছে নন্দুর হাঁকডাক —
কিছুতেই ডায়েটের হিসেব মিলছে না। চেপে ধরেছে সিস্টার দিদিরা।
“কি করব দিদি, হামি দুধের লোভে পড়িয়ে গিছলাম—”
নন্দু অসৎ? অথচ এই নন্দুই হাসপাতালে পরিত্যক্ত নবজাতিকাকে কোলে তুলে নিয়েছিল, নিজের মেয়ের মতো মানুষ করবে বলে।
কিচেনের ওপাশে সুইপারদের কোয়ার্টার। বেচু বাসফোর, শঙ্কর হরি-দীপঙ্কর হরিদের আস্তানা। কানে বাজছে সিস্টার দিব্যশ্রীদির চিৎকার —
“দিদি, আজও বেচু নামেনি ইভনিং ডিউটিতে,
মদ গিলে পড়ে আছে, ওর বউ এসে সোয়াব দিয়ে, গামলা খালি করে দিয়ে গেছে। এবার নতুন ডেলিভারি হলে, কি করে সাফ করাব বলেন দেখি?”
হাসপাতালের ভিতরের টানা রাস্তার দুপাশে কোয়ার্টারের সারি – বর্মণদা, ড্রাইভার কালীদা, গ্রুপ ডি দাদা সুরেশদা, রেখামাসী, লিলিমাসী, পি এইচ এন দিদি অনুপমাদি, নার্স দিব্যশ্রীদি, হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট বৈদ্যনাথবাবু, হাসপাতালের চাইল্ড স্পেশালিস্ট দেবাশিস চক্রবর্তী আর একেবারে শেষ প্রান্তে সার্জেন কালীশঙ্কর ভটচাজের কোয়ার্টার।
আর ঐ যে নিচু ছাদে কালো পিচচটের আস্তরণ দেওয়া, একচিলতে খোলা বারান্দাওয়ালা, বাঁশের বেড়া দেওয়া ছোট্ট বাসাটি — ঐটি আমার আস্তানা, কাজে যোগ দেবার মাস ছয়েকের মাথায় সুনীলদার ভাড়াবাড়ির পাট চুকিয়ে যেখানে এসে উঠেছিলাম।
এবার একটা টিভি কেনো, সুকন্যাদি। আর একটা গ্যাসের কানেকশন নাও – এইভাবে স্টোভের রান্না খেয়ে আর কদ্দিন চালাবে?”— জয়ন্ত বলেছিল।
“কেন রে?”- চোখ পাকিয়েছিলাম আমি –
“এই স্টোভেই ডিমের ঝোল, ভাত, বেগুনভাজা আর পেঁপের চাটনি করে খাওয়ালুম যে তোকে, তার বেলা?”
কান এঁটো করা নিঃশব্দ হাসিতে মুখ ভরিয়ে জয়ন্ত বলেছিল –
“হ্যাঁ, তা খাইয়েছ। কেবল পেঁপের চাটনিতে নো লেবু, ওনলি গাদাগুচ্ছের চিনি, অ্যান্ড বেগুনভাজা ওয়াজ আধসেদ্ধ” —
“মার খাবি কিন্তু তুই—”
জয়ন্ত খাদ্যরসিক ছিল। খুব ভাল রাঁধুনিও।
“তুমি গ্যাসের কানেকশন নেবে তো? নাকি রীতাদির মতো প্রতি সপ্তাহে হাফ কেজি সর্ষের তেল কিনবে, আর ভাববে, এর চেয়ে বেশি কিনে কি হবে? যদি কালই ট্রান্সফার অর্ডারটা এসে যায়? জানো, গত দুবছরে একখানা বিছানার চাদরও কেনেনি রীতাদি — ট্রান্সফার অর্ডারের ভরসায়—”
রীতাদি আমার পাশের কোয়ার্টারের মেডিক্যাল অফিসার। সে-ও কলকাতার মেয়ে।প্রতি তিন মাসে একবার করে ট্রান্সফারের দরখাস্ত ছাড়ত রাইটার্সে।
আউটডোরের দুটো চিলতে ঘর। একেকটায় দুজন করে ডাক্তার বসেন। আমি বসতাম আমাদের ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক স্যার ডাক্তার কোলের সঙ্গে। স্বল্পবাক সংবৃতস্বভাব মানুষ। ওঁর স্ত্রীও হেলথ সার্ভিসেই ছিলেন। লেপ্রসি ইউনিটে। ওখানেই। স্বামী-স্ত্রীর রমরমা প্র্যাকটিস। ওখানকার মানুষের ভাষায় ‘ব্যবসা’।
প্রাইভেট প্র্যাকটিস করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই শুনে ডঃ কোলে বলেছিলেন —
“এতদূরে চাকরি করতে এসে ব্যবসায় নামবে না, শুধু মাইনের টাকাতে চলবে?”
কলকাতাইয়া শোভন ভাষার সঙ্গে তিন তালাক হয়ে গিয়েছিল আমার, সেই মুহূর্ত থেকে।
“কি নাম? মদন সরকার? তা মদন, কি কষ্ট তোমার, বলো?”
“এইজ্ঞে, বোথি হইসে, বোথি”—
শুনে তো আমার একগাল মাছি। স্বল্পবাক কোলেসাহেব নিজের পেশেন্ট দেখতে দেখতেই জবাব দিলেন –
“মুখে ঘা। বি কমপ্লেক্স লিখে দাও।”
পরের রোগীর কাতরানি শুনে আঁতকে উঠলাম –
“মাথায় বিষ, হাতে পায়ে বিষ, সারা গায়ে বিষ—”
আবার উদ্ধারকর্তার গলা —
“বিষ মানে পোলিয়াদের ভাষায় ব্যথা। Bodyache হচ্ছে। ব্রুফেন প্যারাসিটামল দিয়ে দাও—”
স্থানীয় রাজবংশীদের কেন যে কালিয়াগঞ্জের বাঙালিরা ‘পোলিয়া’ বলে অভিহিত করতেন, জানতে পারিনি কখনো।
এমনি করেই এদের ভাষায় দড় হয়ে গেলাম একদিন।
“ছেলেটার পেচিস কমছে পার্বতী? আরো দুদিনের মেট্রোজিল লিখে দিলাম, অশ্বিনীবাবুর থেকে নিয়ে নিও”।
কিংবা,
“কি গো গুন্ডু, কাশ হইছে তো খুব – এই সিরাপটা দুই ছিপি করে দিনে তিনবার জল ছাড়া খাবা, কেমন? পরশুদিন আউটডোরে আসো ফের, দেখব কমতেছে কিনা—”
পেচিস মানে আমাশা, আর কাশ হলো গিয়ে কাশি, এ কথা জলবৎ তরলং হয়ে গিয়েছে ততদিনে।
\যদিও ছুটিতে বাড়ি ফিরে কখনো কখনো আত্মীয়বন্ধুদের সামনে সেই অনাগরিক উচ্চারণ বেরিয়ে পড়ত অসাবধানে, আর কনভেন্ট শিক্ষিত মেয়ের মুখে অমন ‘চাষাড়ে’ ভাষা শুনে মায়ের ভুরুতে অসন্তোষের ভাঁজ গভীর হতো।
কিন্তু ততদিনে খুকু মায়ের অসন্তোষ অগ্রাহ্য করার মতো বড় হয়ে গিয়েছে।
কনভেন্ট শিক্ষার রেশমী নকাবটা কালিয়াগঞ্জ নামের মায়াবী জায়গাটার মাঠেঘাটে কবে যেন হারিয়ে ফেলল খুকু। কি করে, সে নিজেই জানতে পারল না।
শাড়ির কুঁচির প্রান্ত দু’ আঙুলে তুলে সে নেমে পড়ল আলপথে, সর্ষে আর গমের খেতে, মাটি নিকোনো গরিব দাওয়ায় বসল পাটি পেতে, খোদেজা খাতুনের বাড়ির কাঁচের ফাটা ময়লা পিরিচে চুমুক দিয়ে খেলো জল মেশানো দুধের ফ্যাকাসে সিমুইয়ের পায়েস।
শহুরে, ‘বড় হাসপাতালে’ কাজ করা মেয়েটা জানল, কাকে বলে ব্লক, অঞ্চল মানেই বা কি — উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র কেমন হয়, অঙ্গনওয়াড়ির মেয়েরাই বা কেমন করে সাহায্য করে স্বাস্থ্যকর্মীদের। ধীরে ধীরে নিবিড় পরিচয় ঘটল সরকারি তৃণমূল স্তরের নানা স্বাস্থ্য যোজনার সঙ্গে — ওতপ্রোতভাবে কখন যেন সে জড়িয়ে পড়ল এই বিপুল কর্মকান্ডের মধ্যে, যার সঙ্গে কেবল আলাপ ছিল প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিনের পাঠ্যবইয়ে।
আধুনিক ওষুধপত্র ব্যবহারে অভ্যস্ত ডাক্তারনী শিখলো, কিভাবে শুধু সেপট্রান, প্যারাসিটামল, অ্যান্টাসিড, মেট্রোজিল, মারকিউরোক্রোম, ও আর এস আর টিটেনাস টক্সয়েড সম্বল করেই চালিয়ে দেওয়া যায় একটা গোটা গ্রামের দুশোজন রোগীর স্বাস্থ্য শিবির।
ফিল্ড ভিজিটে গিয়ে মেয়েটা প্রথম সর্বগ্রাসী দারিদ্র্য দেখল। দোলাই গায়ে ঘ্যানা বাচ্চার চারবেলার আহার – তোবড়ানো অ্যালুমিনিয়ামের থালায় সাজানো ভাত আর শাকভাজা খেয়ে খুশিতে চকচক একটা কচি মুখ। তীব্র শীতে রাজবংশী বৃদ্ধার গায়ে কেবল একটি শাল, বুক থেকে হাঁটু পর্যন্ত তার পরিসর — অথচ সম্রাজ্ঞীর নির্লিপ্তি বয়সের আঁকিবুকি কাটা মুখশ্রীতে, চারপাশের বহমান অভাবী কালস্রোতের মাঝে অসন্তুষ্টির সামান্যতম ছায়াও যেন নেই সেই মুখে। মেয়েটা চোখের জল লুকোবার আড়াল খুঁজল জনান্তিকে।
কলকাতার আলোকময় রাজপথ, দোকানপাট, গতিশীল জীবনের ছবি ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসে। কোয়ার্টারের নোনাধরা দেওয়াল, ক্যাঁচকোচে টিউবওয়েল, জাফরিঘেরা অপরিসর জানলায় টাঙানো গোলাপফুল আঁকা গ্রাম্য পর্দা, সব কিছু বড় মায়ায় বেঁধে ফেলে তাকে।
ইভনিং ডিউটি না থাকলে সন্ধে কাটতো ডাক্তার কোলের বাড়িতে। ওঁদের একমাত্র মেয়েটি তখন কলকাতায় মেডিক্যাল পড়ছে। অতবড় প্রাসাদোপম বাড়িতে কেবল স্বামী, স্ত্রী আর দুটো কুকুর।
তিনটি মানুষের মধ্যে বাক্যালাপ বেশি হতো না। রোজ দুবেলা যাদের দেখা হচ্ছে, তাদের আর আলাদা করে গল্প করার কি থাকতে পারে?
একটা ঘরে টিভি চলতো। নীরবে দেখতাম তিনজনে। আমার কোলে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকত সুইটি — স্প্যানিয়েলটা। আর ডোবারম্যান প্রিন্স বাঁধা থাকত একতলায়। টিভি দেখতে দেখতেই এসে যেতো আমার রোজকার বরাদ্দ চা বিস্কুট – কখনো বা রসগোল্লা। ওঁরা মিষ্টি খেতেন না — রসগোল্লা আসত আমার আর সুইটির জন্য।
ন’টা বাজলে উঠে পড়তাম। আমাকে বাড়িতে ফোন করতে হবে। ততদিনে ডাক্তার ভটচাজের চাপাচাপিতে ফোন নিয়েছি কোয়ার্টারে। রাতের বেলা আর হাসপাতাল থেকে রিকশা করে সুনীলদার দোকানের কাছের এসটিডি বুথ অবধি গিয়ে ফোন করতে হয় না।
রাত সাড়ে আটটার পরে কল চার্জ অর্ধেক হয়ে যেতো। তা-ও একমাসে ফোনের বিল হতো তিন সাড়ে তিন হাজার টাকা! ওই দু’হাজার সালে!
“তোর সম্পর্ক তৈরির একটা অদ্ভুত প্যাটার্ন দেখতে পাচ্ছি খুকু” —
“মানে?”
“মানেটা তুই ঠিকই বুঝছিস—”
“না বুঝছি না। এতটাই যখন বললে, আরো স্পষ্ট করে বলো।”
“নিজে বিয়ে করলি না। যেখানেই কোনো বয়স্ক কাপল দেখলি, তাদের পরিবারে এঁটুলির মতো সেঁটে গেলি। তোর কি বিন্দুমাত্র আত্মসম্মান নেই?”
“আরো কিছু বক্তব্য আছে মনে হচ্ছে — বলে ফ্যালো। কথা চেপে রাখতে নেই—”
আমার তরল জবাবে মা যেন থমকেছিল একটু।
“একটা পরিবারের ল্যাংবোট হয়ে যাচ্ছিস তুই। প্রত্যেকদিন ওদের বাড়িতে গিয়ে বসে থাকিস! মিসেস কোলে শাড়ির দোকানে যাবেন, তুইও চললি। ডাক্তার কোলে ফিল্ড ভিজিটে যাবেন, তুই হামেহাল হাজির। স্বামী স্ত্রী রায়গঞ্জ দোকানবাজার করতে যাবেন, তুই চললি সঙ্গে — এমন কি কোথাও নেমন্তন্ন গেলে পর্যন্ত তুই সঙ্গী। এসব কি, খুকু?”
“এক এক করে উত্তর দিই, মা? শাড়ির দোকানে দিদি একা শাড়ি কেনে না, আমিও কিনি। আর রায়গঞ্জে আমারও দোকানবাজার করার থাকে মাঝে মধ্যে — তাছাড়া ডক্টর্স অ্যাসোসিয়েশনের মিটিং থাকে, আমি একা তো যাই না, অন্যরাও থাকে। ফিল্ড ভিজিট আমার ভাল লাগে, মা। আর নেমন্তন্ন? সে তো সকলকেই বলা হয় – মানে গোটা হাসপাতালই নিমন্ত্রিত থাকে। এখানে তো ওটাই রিক্রিয়েশন — আমি একা না গিয়ে, ওঁদের সঙ্গে যাই, এই পর্যন্ত!”
একটু দম নিয়ে যখন আবার কথা বলি, আমার গলায় ইস্পাতের ধার —
“তোমায় একটা ছবি দেখাই মা, মুখে মুখে এঁকে — একটা আঠাশ উনত্রিশ বছরের মেয়ে, আমূল শহুরে। জীবনে কখনো একা থাকেনি। হোস্টেলে বন্ধুদের সঙ্গে আর বালানন্দের ছাদের ঘরে, সর্বক্ষণ আগলে থাকা মিসির সঙ্গে কেটেছে যার — হঠাৎ, একেবারে হঠাৎই, কলকাতা থেকে সাড়ে চারশো কিলোমিটার দূরে একটা অচেনা অজানা আধাশহরে, যার নামও কোনোদিন শোনেনি মেয়েটা, সেখানে চাকরি নিয়ে চলে আসতে হলো। বাপ মা পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেল। থাকবে কি করে? নতুন বাড়ি পড়ে আছে না — তাছাড়া চৌষট্টি বছরের বাবার সাধের চাকরি — বাপ মা থাকবে কেমন করে? তাই দুটো হাঁড়িকুড়ি, একটা স্টোভ আর ক্যাম্প খাট কিনে দিয়ে মেয়ের সংসার সাজিয়ে ফিরে গেল রাতের বাসে। আর অনাত্মীয় অচেনা শহরে, ফাঁকা বাসরাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ভয়কাতুরে মেয়েটা দেখল, ও-ই অনেকদূরে অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে কলকাতার বাসের টেললাইট। তখন এই অপরিচিত শহরটায় মেয়েটা কি করে রইবে, কারোর সঙ্গে বন্ধুত্ব না করে? জ্বর হলে, মন খারাপ হলে, ভয় করলে, কি করবে সে? কার কাছে ফিরবে?”
আশ্চর্যের কথা, যত অচঞ্চল, অসঙ্কোচ দৃঢ়তায় মায়ের কাছে উচ্চারণ করছিলাম শব্দগুলো, ততই কথাগুলোর অন্তর্নিহিত ফাঁকি প্রকট হয়ে উঠছিল নিজের কাছে। আমি বুঝতে পারছিলাম, মা একটা কথাও বেঠিক বলছে না — আমার নিজের মনকে বেআব্রু করে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে আমারই সামনে।
কালিয়াগঞ্জ থেকে কলকাতা আসতাম দেড় মাসে একবার। দিন পাঁচেকের জন্য। বাড়ির পরিবেশ বন্ধুসুলভ থাকত না সবসময়। তাই ওর মধ্যেই দু’তিনদিনের জন্য চলে যেতাম ছোটমাসীর বাড়ি। কাছেই।
মাসতুতো ভাইটার তখনো বিয়ে হয়নি। বোন তো আরো ছোট। মাসীর হাতের দুটো স্পেশ্যালিটি ছিল ভীষণ প্রিয়। লুচির সঙ্গে সাদা আলুর চচ্চড়ি আর সুজির পায়েস। আর রাতে থাকত রেস্তোরাঁ থেকে আনা খাবারদাবার, আইসক্রিম। আমার ‘ট্রিট’!
মাঝেমধ্যেই হতো সিনেমা দেখা, সেটাও শুধু বোনের সঙ্গে – কারণ ব্যবসা সামলে ছেলেমানুষ ভাইটা সময় পেতো না মোটে।
একবার ‘চোখের বালি’ দেখে ফিরছি। ট্যাকসিতে আমার হাতটা কোলের উপর নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে বোন বলল —
“তোকে একটা কথা বলব, শুনবি?” এগারো বারো বছরের ছোট হলেও আমায় ‘তুই’ বলেই ডাকত বোন। এখনো তাই ডাকে।
একটু অবাক হয়েই বললাম
“হ্যাঁ, বল না—”
“তুই কি নর্থ বেঙ্গলেই সেটল করে যাবি, না কি রে?”
“দূর! কি যে বলিস!”— উড়িয়ে দিতে চাইলাম আমি। সেই সঙ্গে এও বুঝতে পারলাম, উত্তরবঙ্গের এই প্রান্তিক শহর এবং তার মানুষজনের প্রতি আমার মানসিক দুর্বলতা নিয়ে মায়ের দুশ্চিন্তা মা ভাগ করে নিয়েছে মাসী এবং বোনের সঙ্গে।
বোনের গলা গম্ভীর, প্রায় কাঁদো কাঁদো —“শোন্, হয় কালিয়াগঞ্জ, নয় আমি, যে কোনো একটাকে বেছে নিতে হবে তোকে — ব্যস!”
ওই বয়সছাড়া উৎকট গাম্ভীর্যের সঙ্গতে চূড়ান্ত ছেলেমানুষি ঘোষণায় আমি হোহো করে হেসে ফেলেছিলাম, ট্যাকসি ড্রাইভার অবাক হয়ে ফিরে তাকিয়েছিল।
কলকাতা থেকে রাতের বাসে ফেরা। কুয়াশা জড়ানো ভোর আসত ঠান্ডা বাতাসে ভর করে। ঘুমভাঙা চোখে চেয়ে দেখতাম, বাস ছুটছে তীব্র গতিতে। ঘুরে যাচ্ছে মাঠ ঘাট, ঘুমন্ত বাজার হাট, জড়ামড়ি করে থাকা টিনের চালের ঘরদোর, পানার বিল, ইতস্তত শালের জঙ্গল। চোখ আটকাতো বন্ধ দোকানের মাথায় টিনের সাইনবোর্ডে — ইটাহার, উত্তর দিনাজপুর। ইটাহার! এর পরেই রায়গঞ্জ, কর্ণজোড়া, হেমতাবাদ। তারপর বাঘনের মোড়টা পেরোলেই প্রণবানন্দ ইস্কুলের লাল বাড়িটা দেখা যাবে — এসে যাবো কালিয়াগঞ্জ।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার মেয়ে যেন অনেকদিন পরে নিজের বাড়ি ফিরবে।
আমার মন তোলপাড় করে প্রশ্ন জাগতো, ভাল কি কেবল মানুষকে বাসা যায়? এই গেঁয়ো, আটপৌরে জনপদ যে তার সব সীমাবদ্ধতা নিয়ে অপ্রকাশ্য ভালবাসায় জড়িয়ে ফেলল আমায়, তার কি হবে?
ওই পার্বতী ইস্কুলের মাঠ, মজে যাওয়া চিরামতী নদীর শ্মশানঘাট, হাসপাতালপাড়ার মনা পাটোয়ারির বেহারি দুগগাঠাকুর, রাধিকাপুরের একলা রেলব্রিজের নিচের স্বচ্ছতোয়া টাঙনের জল, বরুণা পঞ্চায়েতের দূরতম সাবসেন্টার তমচারি মঠবাড়ি, বোচাডাঙ্গার প্রধানের মাটির একচালায় কাঁচের আলমারি থেকে উঁকি দেওয়া ‘দাস ক্যাপিটাল’, রাধামাসীর ‘পাঁউরুটির মালপোয়া’, সিস্টার শর্মিলিদির দুরন্ত বাচ্চাটা, মুখফোড় সুপারভাইজার বিজনবাবু, ভীষণ শান্ত হেলথ অ্যাসিস্টান্ট যামিনীদা, আমার ডাক্তার ভাইবোনেরা – মঞ্চ, সোমা, সুপর্ণা, হিমাদ্রি, অসিত — এরা তো আমার শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে। এদের নিজের থেকে আলাদা করব কি করে?
আজও রাত নামলে, ঘর অন্ধকার হলে, বিছানায় ক্লান্তি উজাড় করে দিয়ে যখন বন্ধ করি দু’চোখ, বায়োস্কোপের ছবি ভেসে ওঠে মনের পর্দায়।
ঐ তো, তরঙ্গপুর মোড়ে দাঁড়িয়ে আমি। আমার ‘অমাইক’ গলায় সাধারণ স্বাস্থ্যবিধির ওপর ‘লেকচার’ দিচ্ছি – আমায় ঘিরে অবাক জনতা।
স্কুলপাড়ার মোড়ের গরম কাপড়জামার দোকানে ঢুকেছি সোয়েটার কিনব বলে। পাশের রাস্তা দিয়ে রিকশায় করে কলকাতার বাস ধরার জন্য যাচ্ছে দীর্ঘদেহী হিমাদ্রি। যেতে যেতে পথচলতি মানুষকে সচকিত করে হেঁকে যাচ্ছে —
“আরে সুকন্যাদি, সোয়েটার কিনতে ঢুকেচো — পাবে না, পাবে না, তোমার আমার সাইজের সোয়েটার এখেনে অমিল! সঅব চাইল্ড সাইজ মাল—”
রাতে একা কোয়ার্টারে ভয় পেতাম। ডাক্তার কোলে হুকুম করলেন আয়ামাসীকে,
“চন্দ্রামাসী, তুমি সুকন্যার সঙ্গে শোবে—”
আমি কাঁচুমাচু মুখে বললাম —
“আর যেদিন চন্দ্রামাসীর নাইট ডিউটি থাকবে, সেদিন?”
“একটা রাত্তিরও একলা থাকতে পারবে না?”—
দাঁত কিড়মিড় করে বলেছিলেন উনি,
“তাহলে তুমিও মাসীর সঙ্গে নাইট করবে সেদিন। যত্তসব!”
কর্ণজোড়ায় ডিস্ট্রিক্ট হেডকোয়ার্টারে মান্থলি মিটিং শেষ হয়েছে। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠতে পারছি না। ক’দিন আগেই রায়গঞ্জের রেডিওলজিস্ট প্রদীপদা ইউএসজি করে ছোটখাটো ফুটবলের সাইজের টিউমার পেয়েছেন ইউটেরাসে। আমি অনুভব করছি, নিম্নাঙ্গ ভেসে যাচ্ছে রক্তস্রাবে। সঙ্গিনী নার্সদিদি ইতিদি, আস্তে আস্তে আমায় ধরে তুলে নিজের শাল খুলে জড়িয়ে দিচ্ছেন কোমরে — ড্রাইভার কালীদা স্পিডোমিটারের কাঁটা তুলছে আশিতে — মুখে বুলি—
“জয় বিশ্বকর্মা! ভয় নাই দিদি – অবিশ্যি, ভরসাও নাই—”
আমার মায়োমেকটমি অপারেশন হচ্ছে কলকাতার নার্সিংহোমে। সকাল সাতটা থেকে লাউঞ্জে আমার মা বাবার পাশে উদ্বিগ্ন মুখে বসে আছেন মিসেস কোলে — আমার মঞ্জুদি।
কোনো জায়গাকে বুঝি এত ভালবাসা যায় না। কোনো মানুষকেও না। বুকে চাপ লাগে। মনে হয়, আর বুঝি স্বাধীনভাবে নেওয়া যাবে না নিশ্বাস। ভালবাসা পাকে পাকে চেপে ধরে অস্তিত্বকে – তার মধ্যেই বিলীন হয়ে যেতে চায় মন। সেই সর্বগ্রাসী দুর্নিবার টান যেন শিকড়সুদ্ধ তুলে আনতে চাইলো আমাকে। আমি অসহায়ের মতো তাকিয়ে দেখছিলাম, ভেসে যাচ্ছে মা বাবা, মাসী, বোন, বাড়ি, আমার শহর, আমার বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশ — এক আদিম বন্য আকর্ষণে আমি যেন সরে যাচ্ছি আমার চিরকালের বেঁচে থাকার কেন্দ্রস্থল থেকে।
কে যেন সেই মুহূর্তে চেতনার নিতল গভীর থেকে ডাক দিলো আমায় — “ফেরো। ফেরো এবার।”
কালিয়াগঞ্জে আমার পাঁচ বছর পূর্ণ হবার কিছুদিন আগে নিজেকেও অবাক করে দিয়ে আমি লিখে ফেললাম বদলির দরখাস্ত। পাঠিয়ে দিলাম রাইটার্স বিল্ডিংসে।
আমি জানতাম, এবার ফিরতে হবে। ফেরা ছাড়া পথ নেই।
(আগামী পর্বে সমাপ্য)