কালিয়াগঞ্জে আমার সাড়ে পাঁচ বছরের একক সংসারের পাট গুটিয়ে নেবার ভার মা একা আমার কাঁধে চাপিয়ে দিতে পারেনি। চলে এসেছিল কলকাতায় বাবাকে একা ফেলে। অবশ্য সেটা যত না আমাকে গোছগাছে সাহায্য করতে, তার চেয়ে অনেক বেশি আমার এই সিদ্ধান্তে নিজের বাঁধনহারা আনন্দ ব্যক্ত করতে, সেটা বুঝতে পেরেছিলাম আমি।
মা হয়ত আমাকে ঠিকঠাক পড়ে উঠতে পারেনি, তবে আমার মানসিক দ্বন্দ্ব আর টানাপোড়েন ছুঁয়ে গিয়েছিল মায়ের মন।
শেষ সন্ধেবেলায় আমি যখন বললাম, যাই, একটু ঘুরে আসি হাসপাতালটা — মা বাধা দেয়নি। কোয়ার্টার ভর্তি মানুষ তখন। এককোণে আমার হোলড্-অলে মোড়া বিছানা, গোটাদুই টেবিল, চেয়ার, আমার শখের ছোট্ট রঙিন টিভিটা, একখানা আলনা কাম ড্রেসিং টেবিল আর কয়েকটা বাসনকোসন, বইপত্তর, গ্যাসস্টোভ, সিলিংফ্যান ইত্যাদির বস্তা বাঁধাছাঁদা হয়ে, রাতের বাসের মাথায় উঠে লম্বা পাড়ি দেবার জন্য তৈরি হয়ে পড়ে রয়েছে।
হাসপাতাল বাড়িতে নৈমিত্তিক রোগীর ভিড়। লেবার রুমে আলো জ্বলছে। কিচেনে স্বাভাবিক ব্যস্ততা। ড্রেসিং রুমে সেলাই শেষ করে ব্যান্ডেজ বাঁধছে মলয়। লালুর বাবার চায়ের দোকানে নিত্যকার রাজবংশী মুখেদের ভিড় — প্যাঁকপ্যাঁক বাজছে ভ্যানরিকশার হর্ন, নতুন রুগী এলো বোধহয়।
কালিয়াগঞ্জের বয়স্ক পুরোনো ডাক্তারবাবু ডাক্তার ঘোষ চলেছেন মহেন্দ্রগঞ্জ বাজারে সান্ধ্য তাসের আড্ডায় — আমায় দেখে থমকে দাঁড়ালেন এক মুহূর্ত। একগাল হেসে বললেন –“কালিয়াগঞ্জের ভাত উঠল তাহলে শেষ পর্যন্ত?”
সাড়ে আটটা। বাসের চাকা গড়াতে শুরু করেছে, জানলার বাইরে একটা অবয়বহীন ভিড় — কতশত চেনামুখ! প্রতিটি মুখের একটা গল্প রয়েছে আমার জীবনে — স্নেহের, শাসনের, নির্ভরতার, বন্ধুত্বের —
“আবার আসবেন তো দিদি?”
“দেখবেন দিদি, ভুলে যেয়েন না আমাদের—”
“ফোন করলে চিনবেন তো তখন?”
আমার কোলে স্টুডেন্টস হেলথ হোমের কালিয়াগঞ্জ শাখার দেওয়া গোটানো মানপত্র, বঙ্কিম রচনাবলী, শুকনো গোলাপের তোড়া আর অনেক অনেক স্মৃতি। আমার চোখ দুটো জানলার বাইরে উদগ্রীব উৎকন্ঠায় খুঁজে চলেছে দুটো মুখ। জানি, তাঁরা আসেননি। আসবেন না, জানতাম। আমার বদলির অর্ডারের খবর জানাজানি হওয়ার পর থেকেই আমার সঙ্গে আর একটিবারও বাক্যালাপ করেননি ডাক্তার কোলে। মঞ্জুদি তখন খুব অসুস্থ।
বাস গতি নিয়েছে। সরে যাচ্ছে দোকানপাট, বিলে মোড়, প্রণবানন্দ ইস্কুল। জানলার বাইরে মুখ বাড়ালাম আমি। ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা লাগল মুখে। চোখ আটকালো মাইলফলকের পাশের স্তম্ভে। “কালিয়াগঞ্জ থানা, উত্তর দিনাজপুর, আপনাকে বিদায় জানাচ্ছে। আপনার যাত্রা শুভ হোক।”
কালিয়াগঞ্জ, আমার হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা, তোমার অমোঘ আকর্ষণ ছিঁড়ে ফিরতেই হলো আমাকে, ফিরতেই হচ্ছে তাহলে শেষ পর্যন্ত!
“জানলাটা টেনে দে খুকু, ঠান্ডা লেগে যাবে তোর—“, মা আমার হাতটা মুঠো করে ধরে। আমি হাসিমুখে তাকাই মায়ের দিকে। মা চোখ কুঁচকে দেখে।বুঝতে চেষ্টা করে আমার চোখে জল এসেছে কিনা। তারপর, প্রায় ফিসফিস করে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে ওঠে —“খুব মন খারাপ লাগছে, না রে খুকু?”
আমি মায়ের মুঠোটা আর একটু শক্ত করে চেপে ধরে সহজ গলায় বলি —“কাল অত ভোরে ম্যাটাডোর নিয়ে বাবা ধর্মতলায় পৌঁছতে পারবে তো মা? অত মালপত্তর কিন্তু ম্যাটাডোর ছাড়া বেহালা নিয়ে যাওয়া যাবে না গো — ট্যাক্সির ডিকিতে আঁটবে না—”
মা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আমার মুখের দিকে।
বাস ছুটেছে চৌত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়ক দিয়ে। বাতি নিভে গেল। সবাই ঘুমোবে এখন। আমিও চোখ বন্ধ করলাম। আমি বাড়ি ফিরছি। ফিরছি, না যাচ্ছি? কোথায় আমার বাড়ি? মানুষ যেখানে মাথা গোঁজে, সেটাই কি তার বাড়ি? নাকি, সরকারি কার্ডে যে নম্বরি ঠিকানা থাকে, বাড়ির হদিশ সেখানেই? ইঁটকাঠ দিয়ে বাড়ি হয়, নাকি মানুষ দিয়ে? মানুষ দিয়ে হলে, কেমন মানুষ? রক্তসম্পর্কের, না কি আত্মার আত্মীয়?
বহুকাল আগের একটা ফুলপাঞ্জাব ট্রাকের যাত্রার কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ।
আমার ঠিকানা কোথায়? বুড়োদাদুর পুরোনো বাড়ি? খড়্গপুর? ডানবারের কোয়ার্টারে? গোরাচাঁদ রোড, ক্যালকাটা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ লেডিজ হোস্টেল? হাজিনগরের বাংলো? আমার বাবার সারদা পার্কের বাড়ি? কালিয়াগঞ্জ?
“জীবনপুরের পথিক রে ভাই
কোনো দেশেই সাকিন নাই
কোথাও আমার মনের খবর পেলাম না—“
পোশাকি নাম বৃন্দাবনপুর ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ঘরোয়া নাম পাঁচবিঘা হাসপাতাল।
হাওড়ার কোনা এক্সপ্রেসওয়ের নিবড়া মোড় থেকে বম্বে রোড, থুড়ি, ছ’নম্বর জাতীয় সড়ক চলে গেছে কোলাঘাটের দিকে। সেই রাস্তায়, উলুবেড়িয়া ইএসআই হাসপাতাল পেরিয়ে, একটা নির্জন বাঁকে, ধর্মতলা থেকে বাগনানগামী সিটিসি বাস আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে যেতো। স্টপেজের নাম নিমদিঘি। সেখান থেকে হাসানদার ন্যাড়া ভ্যানরিকশায় আরো তিন সাড়ে তিন কিলোমিটার গেলে পাঁচবিঘা হাসপাতাল।
একপাশ দিয়ে ঝোপজঙ্গলে ঘেরা ইঁটপাতা রাস্তা চলে গেছে সেই কাটরা পর্যন্ত। অন্যপাশে প্রাচীরবিহীন নিরাভরণ হাসপাতাল বাড়ি। সিমেন্ট বাঁধানো চত্বর ছাড়ালেই মাঠ, ধানক্ষেত — তারপরেই জঙ্গল। ওরই মধ্যে একদিকে জড়ামড়ি করে দাঁড়িয়ে কতকগুলো শ্রীহীন কোয়ার্টার্স – নির্বান্ধব পরিবেশে পরস্পরের হাত ধরে বাঁচতে চাইছে যেন।
যত রোগীর ভিড়, সব দিনের বেলায়, আউটডোরে। সহজে ভর্তি হতে চাইতো না কেউ। হলেও পীড়াপীড়ি করে ছুটি নিয়ে চলে যেতো সন্ধের মধ্যেই। যদি অবস্থা ছুটি দেওয়ার মতো না হতো, তবে রেফার করিয়ে ছাড়ত মাইল পাঁচেক দূরের উলুবেড়িয়া মহকুমা হাসপাতালে।
সন্ধে নামলে বদলে যেতো চারপাশ। স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের টিমটিমে আলো আঁধার দূর করার পরিবর্তে আরো যেন বাড়িয়ে তুলতো। দূরের ঘনসন্নিবিষ্ট গাছপালায়, জঙ্গলে ঘেরা জনহীন রাস্তায়, আঁধার যেন জমাট বেঁধে থাকত থোকা থোকা জোনাকির মতো। কখনো বা চন্দ্রহীন রাতে অন্ধকার উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তো জনশূন্য মাঠে। মাঝে মাঝেই নৈঃশব্দ্য ভেঙেচুরে প্রহর ঘোষণা করে যেত শিয়ালের দল।
তাড়াতাড়ি রাতের খাওয়া সেরে দিনের পাট চুকোনোর মধ্যেই কানে আসতো, সিস্টার স্বপ্নাদি ছেলেকে খেতে ডাকছে —“বাবু, রুটি হয়ে গেছে, আর বসে বসে ঢুলিস না— খেয়ে শুয়ে পড়।”
নিখিলদার বুড়ি মায়ের কাশির আওয়াজ, দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরে সিস্টার রাণুদির স্বামীর টিউবওয়েল পাম্প করে জল তুলে স্নানের আওয়াজ, রাতজাগা প্যাঁচার গুমগুমে আওয়াজের সঙ্গে মিশে যেতো আমার মশারীর নিচে বিবিধ ভারতীর আপ কি ফরমাইশের মন কেমন করা সুর — ‘ম্যায় জিন্দগী কে সাথ নিভাতা চলা গয়া—‘
আধোঘুম আঁধারি চুপকথা ছিঁড়ে কোনো রাতে নড়ে উঠতো কোয়ার্টারের জাফরির দরজার কড়া। জিডিএ দাদা বাসুদার গলা পেতাম জানলার বাইরে —“দিদি, আসুন, রুগী এয়েচে।”
বৃন্দাবনপুরে আমরা দুজন ডাক্তার পোস্টেড ছিলাম। আশিক, ডঃ আশিক হোসেন সপ্তাহে তিনদিন ডিউটি করতো আর আমি তিনদিন করতাম। রবিবার ডিউটি হতো রোটেশনে।
আমার ভাগে পড়ত তিনটি রাত। হাসপাতাল বাড়িতে তালা পড়ে যেত সন্ধেবেলা।আর ঠিক রাত নটা বাজলে, সে তালার চাবি নিয়ে নিখিলদা আমার সঙ্গে মাঠ পেরিয়ে, হাসপাতালে পৌঁছত।
অন্ধকার, জনশূন্য, মৃত হাসপাতালে তখন একটি বস্তুই জীবিত, টেলিফোন।
আমি ফোন করতাম মাকে — বাড়িতে। বাবা ফোন করত আমাকে — মধ্যমগ্রামের অফিস থেকে। চাকরিটা বাবা ছাড়েনি। বছরদেড়েক আগে বুকে বসেছে পেসমেকার।নানা ওষুধ খেতে হয় নিয়মিত — তবু ছাড়েনি। নিত্য যাতায়াতের অসুবিধে হয় বলে, সারা সপ্তাহ ওখানে কারখানার এক কামরার গেস্ট হাউসে থেকে, সপ্তাহান্তে বাড়ি ফিরত।
এত কষ্ট স্বীকার করে, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে যে বাড়ি করালো, সেই বাড়িতে পর্যন্ত একটানা থাকতে পারল না মানুষটা। যতদিন শরীর দেবে, কাজ করে যাবে, তবু কিছুতেই উপার্জনক্ষম, উপযুক্ত সন্তানের মুখাপেক্ষী হবে না, সারা জীবন নিজের শর্তে বেঁচে থাকা ‘লেবার সাহেব’।
সালটা ২০০৪। পুজো আসছে। উত্তরবঙ্গে থাকতে, আমি পুজোর সময় বাড়ি আসতে পারতাম না। মা বাবা আসতো আমার কাছে। আমি ফিরতাম কালীপুজোর সময়।
এবার আর সেইরকম কোনো নিষেধের বাঁধন নেই। ষষ্ঠী আর সপ্তমী ডিউটি করে দিতে হবে কেবল। আশিক বাকি তিনদিন টেনে দেবে।
আমি মহানন্দে বাজার করছি। কখনো মায়ের সঙ্গে। কখনো একা।
মিসি আর বালানন্দে নেই। ও তখন কালিম্পঙে পোস্টেড। দেবুও ওখানে একটা বেসরকারি হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত মেডিক্যাল অফিসার।
বোনের বিয়ে হয়েছে বছরখানেক হলো। সেও তার সংসার আর গান নিয়ে বেজায় ব্যস্ত। তবু পুজোয় অন্তত একটা দিন চুটিয়ে ঠাকুর দেখার প্ল্যান করেছি দুজনে।
সেদিন বিশ্বকর্মা পুজো। আমার ডিউটি ছিল না হাসপাতালে। বাবা যথারীতি ফ্যাকটরিতে।
সন্ধে নাগাদ একটা ফোন এলো। বাবা। মা দু’ একটা টুকটাক কথা বলে আমাকে দিলো লাইনটা। “কি রে, কখন ফিরলি আজ?”— বাবা কি একটু অন্যমনস্ক?
“কি গো, আজ তো আমার অফ। ভুলে গেলে?”
“ওহহ, তাই তো—” বাবা যেন একটু ইতস্তত করলো — “আসলে, আজ বিশ্বকর্মা পুজোয় এখানে একটু খাওয়া দাওয়া ছিল, বুঝলি? ঐ খিচুড়ি, ইলিশ মাছ, পায়েস, এইসব আর কি — অবেলায় খেয়ে বোধহয় অম্বল হয়ে গেছে, জানিস! একটা ওমেজ খাবো না কি বল তো?”—-বাবার গলায় হাঁপ ও অস্বস্তি স্পষ্ট।
চিন্তিত ভাবে বললাম — “ওমেজ খাও। আর রেগুলার যে ওষুধগুলো খাচ্ছো, ওগুলো মিস করোনি তো?”
“না না, খেয়েছি—”
“তোমার কষ্ট হচ্ছে খুব, না বাবা? সত্যি করে বলো তো?”
“খুব না — ঐ একটু—” একটা ক্লিষ্ট হাসির আওয়াজ শোনা গেল।
“শোনো, ভাল করে শোনো — তুমি কালই দিন সাতেকের একটা ছুটির দরখাস্ত দিয়ে বাড়ি চলে এসো। একটা থরো ইনভেস্টিগেশন দরকার তোমার।”
আমি চেয়েছিলাম, পিজি-তে হোক, তবু বাবার জেদাজেদিতেই অ্যাঞ্জিওগ্রাম হলো বাইপাসের ধারের বেসরকারি হাসপাতালে। মেয়ে সরকারি ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও সরকারি হাসপাতালের উপর বিন্দুমাত্র ভরসা ছিল না বাবার।
তিনটে ব্লক পাওয়া গেল অ্যাঞ্জিওগ্রামে। যে কার্ডিওলজিস্ট বাবার পেসমেকার বসিয়েছিলেন, তাঁর কাছেই গেলাম প্রথমে। তিনি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করতে চাইলেন।
বাবা প্রশ্ন করল — “বাইপাস সার্জারি নয় কেন?” ততদিনে আমার মামার দু-দু’বার সফল করোনারি বাইপাস হয়ে গেছে বি এম বিড়লা হাসপাতালে। স্বভাবতই বাবাও বাইপাস সার্জারির দিকেই ঝুঁকেছিল।
কার্ডিওলজিস্ট ডাক্তার সৌমিত্র কুমারের উত্তরটা আমার আজও পরিষ্কার মনে আছে — “করোনারি আর্টারি বাইপাস গ্রাফটিং ইজ আ ভেরি মরবিড অপারেশন। আপনি চাইলে অন্য কার্ডিওলজিস্ট কনসাল্ট করতে পারেন।”
না, অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করাবার সঙ্গতি ছিল না তখন আমাদের। বাবাও চায়নি সেটা।
সেই দু’হাজার চার সালের দুর্গাপুজোর একাদশীর দিন, আমাদের সারদা পার্কের বাড়ি থেকে হেঁটে বেরিয়ে, মোড়ের মাথা থেকে ট্যাকসি ধরে, বাবা রুবি জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হতে চলল। দুদিন পরে বাইপাস হবে — একলক্ষ টাকার প্যাকেজ।
অপারেশন নির্বিঘ্নেই শেষ হলো। ম্যাকিনটশ, ক্যাপ মাস্ক শোভিত সুদর্শন সার্জেন ওটি থেকে বেরিয়ে অপেক্ষমাণ মাকে বললেন —“মাসীমা, নাথিং টু ওয়ারি অ্যাবাউট। অপারেশন ইজ সাকসেসফুল।”
একদিন পরে, যখন আইসিসিইউতে বাবাকে দেখতে ঢুকলাম, একমুখ কাঁচাপাকা দাড়ি আর খানিকটা লজ্জিত অথচ খুশিয়াল হাসি নিয়ে বাবা আমার হাতটা ধরে বলল — “জানিস বাপি, ডাক্তারবাবু আজ সকালে রাউন্ডে কি বললেন?”
“কি, বাবা?”— আমি বাবার রুক্ষ চুলে ভরা মাথাটায় হাত বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞাসা করলাম।
“বললেন, ওহ্ মেসোমশাই, ইউ’ল লিভ ফর অ্যানাদার টোয়েন্টি ইয়ার্স—”
আরো একদিন পরে জেনারেল বেডে দেওয়া হলো বাবাকে। সব আত্মীয়স্বজনরাই এসে দেখে গেছেন একে একে। মামা তো ভীষণ খুশি —“রিমার্কেবল রিকভারি হচ্ছে, বুঝলি ডলি! তাছাড়া, তুই চিন্তা করিস না — আমি স্নেহাংশুর কুষ্ঠী দেখেছি। লং লাইফ, মিনিমাম আশি পঁচাশি তো বটেই—”
পাঁচমাস আগে বাবার বয়স আটষট্টি পূর্ণ হয়েছে। কার্ডিওথোরাসিক সার্জেনের নিদানের সঙ্গে মামার ভবিষ্যদ্বাণী মিলিয়ে নিলাম আমি। আর একদিন পরেই হাসপাতাল থেকে বাবার ডিসচার্জ হবে, জানালেন আর এম ও।
সেদিন রোববার হওয়ায় অনেকেই এসেছেন ভিজিটিং আওয়ার্সে। বাবা যেন একটু চঞ্চল — ছটফট করছে। কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করতে, বলল — পেটে হালকা একটা ব্যথা হচ্ছে, দিন তিনেক না কি পায়খানা হয়নি। ছুটলাম আর এম ও-র কাছে। তিনি সার্জেনকে ফোনে কনসাল্ট করে একটা ডিকোলিক ট্যাবলেট আর এনেমা দিতে বললেন নার্সকে।
বোন এসেছিল সেদিন বাবাকে দেখতে। একসঙ্গেই ফিরছিলাম সবাই। ও হঠাৎ বলল –“মেসোমশাইয়ের হাত তো সব সময় খুব গরম থাকে, আজ এত ঠান্ডা দেখলাম কেন রে?”
আমার মনে পড়ে গেল বাবার বন্ধু অজয়কাকুও একই কথা বলছিলেন বিকেলে —“সুকন্যা, ব্যানার্জিদার বোধহয় ভিতরে কিছু একটা কষ্ট হচ্ছে! তা ছাড়া হাতটাও খুব ঠান্ডা — তুমি একটু দেখো তো।”
পরেরদিন, সোমবার ঘুম ভাঙল ফোনের আওয়াজে। হাসপাতাল থেকে ফোন করেছে। “যত শিগগির সম্ভব চলে আসুন— রোগীর কন্ডিশন হঠাৎ ডিটিরিওরেট করেছে—”
হাসপাতালে পৌঁছে শুনলাম, বাবার মলদ্বার দিয়ে সাংঘাতিক ব্লিডিং হচ্ছে। ডাক্তাররা কারণ খুঁজে বার করতে পারছেন না। পালস ভীষণ বেশী। কোলাপ্স করে যাচ্ছে বাবা। ওঁরা তাই রোগীকে ভেন্টিলেশনে দেওয়ার অনুমতি চাইছেন বাড়ির লোকের কাছে।
জেনারেল বেড থেকে স্ট্রেচারে শুইয়ে বাবাকে শিফট করানো হচ্ছে আইসিইউতে। মাথার কাছে দাঁড়ানো মাকে আকুল গলায় বলছে বাবা —“আমায় বাড়ি নিয়ে চলো। এখানে থাকলে আমি ভাল হবো না। বাড়ি চলো, বাড়ি গেলেই ঠিক হয়ে যাব আমি—”
পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আমি — তাকিয়ে আছি মায়ের পাথরের মতো মুখের দিকে —
রক্তাভ ঘোলাটে চোখে আমার দিকে তাকালো বাবা — “তোকে আমি ভীষণ বিপদে ফেলে দিলাম, না রে বাপি?”
আমার ঠোঁট নড়ে উঠল। অস্ফুটে বললাম — ‘না বাবা, একদম না, এক্কেবারে না—‘
আমার অব্যক্ত বেদনার ভাষা বাবার কানে গেল কি না জানতে পারলাম না।
সারাদিনই আমরা ঠায় বসে হাসপাতালে। মামা এসেছে। মামাতো দাদা, দিদি, জামাইবাবু। মাসী। বোন। ভাই। বাবার মধ্যমগ্রাম অফিসের সহকর্মী। প্রতিবেশী কাকুরা। এসে পৌঁছেছেন সকলেই।
সন্ধে রাতের দিকে গড়াতে, অবস্থা আরো ঘোরালো হয়ে উঠল। ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইনচার্জ ডাক্তারবাবু মুখ গম্ভীর করে এসে বলে গেলেন — ‘হি ইজ সিংকিং। আয়্যাম সরি।”
সেই প্রথম, মায়ের মুখে আমি মৃত্যু দেখলাম। যুদ্ধের, বিশ্বাসের, ভালবাসার মৃত্যু। দু’ চোখ ভর্তি জল নিয়ে ছুঁতে চাইলাম মায়ের হাত। কঠিন একটা স্বর উত্তর দিলো — “আমাকে একমনে ঠাকুরকে ডাকতে দাও খুকু, বিরক্ত কোরো না।”
খবরটা এলো পরের দিন ভোররাতে। আমি আর মা সারারাত মাসীর বাড়িতে জেগে কাটিয়ে দিয়েছি। আমাদের সঙ্গেই রাত জেগেছে ভাই, বোন, মাসী, ওদের কিছু সহৃদয় প্রতিবেশিনী।
মাসীর গাড়িতেই আমি আর মা পৌঁছলাম রুবি হাসপাতালে।
ঠান্ডা সিসিইউ। এক এক করে ঢুকলাম আমরা। এক অচেনা সিস্টার দিদি পরম মমতায় জড়িয়ে নিলেন মা-কে। মা উপুড় হয়ে পড়লো লেবার সাহেবের পায়ের উপর। সেই প্রথম। সেই শেষ।
আমার অ্যাটলাস বড় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। মাথার কাছে মনিটর কিন্তু স্তব্ধ হয়নি — হার্ট বিট নেই আর, তবু পালস রেট ৬১/মিনিট — বলে যাচ্ছে যান্ত্রিক পেসমেকার।
চিরজন্মের নাস্তিক, বামপন্থী লেবার সাবের গায়ে কে জড়িয়ে দিল হলুদ নামাবলী?
গাড়ির জানলায় সহপাঠী পার্থ-র মুখ —“সুকন্যা, আমাদের সকলকে জীবনে দুটো হার্ডল পেরোতেই হয় রে — তুই কেবল একটা হার্ডল আমাদের আগেই পেরিয়ে গেলি—”
অজয়কাকু সবাইকে নিজের কবজি উলটে দেখাচ্ছেন —“এই হাতঘড়িটা, এটা উনি আমায় দিয়েছিলেন, জানেন — দাদা দিয়েছিলেন এটা—”
পুরোহিত মন্ত্র পড়ছেন। হাতে জ্বলন্ত পাটকাঠি নিয়ে আমি প্রদক্ষিণ করছি বাবাকে — কি হাসি হাসি মুখ বাবার! আর কোনো কষ্ট নেই, কোনো যন্ত্রণা নেই, না বাবা? আমার আঁচল লুটোচ্ছে মাটিতে, পাশেই আগুনের মালসা — জামাইবাবুর গলা পেলাম, দিদিকে বলছেন —“মিতা, আঁচলটা তুলে দাও, আগুন ধরে যাবে—”
আমাকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দিদি। আমি পিছন পানে তাকালাম একবার — বিপুল হরিধ্বনির সঙ্গে ওরা চালিটা ঢুকিয়ে দিলো গনগনে আগুনের মধ্যে —
“এই রাস্তাটার নাম কি জানিস, বাপি? ছকু খানসামা লেন—”
“যত অদ্ভুত সব নামের রাস্তা তোমার নখদর্পণে, না বাবা?”
“হুম, আরো আছে — পটলডাঙা লেন, শশিভূষণ দে স্ট্রিট, মির্জাপুর স্ট্রিট, রূপচাঁদ মুখার্জি রোড — সব এক এক করে চিনিয়ে দেব তোকে—”
তোমাকে আজ কালীঘাটের পটুয়াপাড়ার উল্টোদিকের কেওড়াতলা মহাশ্মশানে চিরকালের মতো ছেড়ে যাচ্ছি বাবা, চিরজন্মের মতো ছেড়ে যাচ্ছি। আদিগঙ্গার জলে নামলাম আমি — আমার হাতে ধরা বাবার অবশেষ ভাসিয়ে দেব বলে।
“কিচ্ছু থাকে না খুকু, কিচ্ছু থাকে না — আত্মা নয়, পঞ্চভূত নয়, কিচ্ছু নয়। থাকে শুধু একমুঠো ছাই—” আমার কোলে মাথা রেখে বলছে মা, আমি জাপটে ধরে আছি মাকে।
আমি যে আর পারি না — আমারও যে ইচ্ছে করে, বাবার মতো সব বোঝার ভার নামিয়ে, অনেক দূরের ছুটির মাঠে হারিয়ে যেতে —
কিন্তু না, আমি পারলাম না যেতে। আমি পারব না কোনোদিন — সেই একজন আমাকে টেনে ধরে রেখেছে পিছনে — তার হাত ছাড়িয়ে, তার পিছুটান এড়িয়ে যাওয়া আর হলো না আমার!
না, মা নয়, কোনো বন্ধু নয়, আমার কাজ নয় — সে অমোঘ পিছুটানের নাম, জীবন।
হাটে মাঠে ঘাটে আমার শাড়ির খুঁটে বাঁধা পড়ে ফেরে সে। আমার চুলের কাঁটায়, হাতের চুড়িতে, কাঁধের ঝোলায়, চলার পথের ধুলোয়, আমায় বেঁধে রেখেছে সে দুশ্ছেদ্য মায়ায়। আমার আর যাওয়া হয় না কোথাও।
আমি জানি এই জীবনে, জীবনের হাত থেকে আমার আর মুক্তি নেই।
“চ্যায়েন সে হামকো কভি
আপ নে জিনে না দিয়া—
জহের ভি চাহুঁ অগর
পিনা, তো পিনে না দিয়া—“
(সমাপ্ত)