আমার ঠাকুর্দার বারোজন ছেলেপুলে ছিল। বারোজনের মধ্যে বাবা ছিল কনিষ্ঠতম। একবার আমি আর বাবা বসে হিসেব করেছিলাম, আমার পিতৃকুলে তুতো ভাইবোন ছিলাম বিয়াল্লিশজন। এঁদের মধ্যে সর্বসাকুল্যে পনেরোজনকেও আমি চোখে দেখেছি কিনা সন্দেহ আছে।
আমার যেটা আদি ‘বাপের বাড়ি’ — অর্থাৎ আমার ঠাকুর্দার করা বাড়ি, সেটা ছিল কলকাতার উত্তর শহরতলিতে। বিরাট বড় নিরানন্দ একতলা বাড়ি। জাফরি ঘেরা বারান্দা। লাটাখাম্বাওয়ালা কুয়োতলা। মোটা মোটা লোহার গরাদে দেওয়া জানলা। পিছনে মজা ডোবা, জঙ্গুলে কচু আর আশশ্যাওড়ার বন, দেওয়ালের নোনায় কখনো আফ্রিকার, কখনো বা উত্তর আমেরিকার ম্যাপ।
সে বাড়ির সমস্ত আসবাবে কেমন একটা গম্ভীর, হাস্যহীন, উচ্ছ্বাসহীন গভীরতা ছিল— সেগুনকাঠের ভারী কালচে সিন্দুক, বিছানাপত্তরের আলমারি থেকে কালো আবলুস কাঠের পালঙ্ক— সবকিছুর মধ্যে এমন একটা দমচাপা অনাত্মীয়তা ছিল, যে আমি ভারী অস্বস্তিবোধ করতাম।
বাবা তখন কলেজে পড়ানো ছেড়ে হিন্দুস্থান মোটর্সে ঢুকেছে। ছোটমামাই মুরুব্বিয়ানা করে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। মামা তখন সে কোম্পানির পারচেজ ম্যানেজার। সংসারের বিরাট হাঁ ভরানোর মতো মাইনেপত্র ছিল না অধ্যাপকের চাকরিতে। তাছাড়া তখন নকশাল আমল। বাবা পড়াতো হাবড়া শ্রীচৈতন্য কলেজে। সান্ধ্য অধ্যাপনা। বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যে গড়িয়ে গভীর রাত। ছোট্ট আমাকে বুকে জড়িয়ে নানারকম ভয় নিয়ে মায়ের দমচাপা যাপন। অবিশ্বাসী, রক্তের আঁশটে গন্ধমাখা বাতাস ক্রমাগত কানের কাছে ফিসফিস করে যেত — দিনকাল ভাল নয়, ভাল নয়। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে অবলীলায় পেশাটাই বদলে ফেলেছিল বাবা। বদলে ফেলেছিল? না কি বদলাতে বাধ্য হয়েছিল? জানা নেই।
সংসারের অনটন যে নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েও খুব একটা ঘোচেনি, তা ঐ শিশুবয়সেও বুঝতে অসুবিধে হতো না আমার। চাকরিটার নামের ভার যতখানি, বেতনের ধার ততখানি ছিল না বোধহয়।
সন্ধেরাতে ফিরত বাবা। আমি তখন উপেন্দ্রকিশোরের ‘বাঘ শিয়ালের মেলা’ কিংবা ইস্কুলের হোমটাস্কে ডুবে আছি। চা আর চিঁড়েবাদামভাজার দৈনন্দিন সান্ধ্য জলখাবারের ফাঁকে দুটো চিন্তিত গলা কানে আসত মাঝে মাঝেই।
“এ মাসেও এতগুলো টাকা কম?”
” হ্যাঁ, নরেনের দোকানের পাওনাটা আজ পুরোই মিটিয়ে দিলাম।”
“সে তো দিলে—কিন্তু–এরপর? সারা মাস পড়ে আছে—”
“দেখি! কিছু একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে!”
“এক বছর তো হয়ে গেল—কোম্পানি মাইনে বাড়াবে না?”
খানিকক্ষণ নীরবতা। শুধু চিঁড়ে চিবোনোর আওয়াজ। তারপর বাবার গলা পেতাম ফের—” প্রাইভেট কোম্পানি— বোঝোই তো সব— যে জেনারেল ম্যানেজারের কাছের লোক হবে, তার কপাল খুলবে— আমাদের মতো হেঁজিপেঁজির দিকে নজর পড়বে অনেক পরে—- তাছাড়া–“, বাবার গলাটা বুজে আসতো—“আমার সুপারিশের চাকরি— সকলেই করুণার চোখে দেখে— আমারও যে পার্টস আছে, তা প্রুভ করার সুযোগ পাচ্ছি কই?”
মায়ের গলায় একটা অদ্ভুত কাঠিন্য বাজতো–“তুমি অন্য চাকরির চেষ্টা করো। আমিও চাই না, তুমি এই সুপারিশের চাকরিতে বেশিদিন পড়ে থাকো—”
“হুম। অ্যাপ্লাই করেছি গোটা দুয়েক জায়গায়— যদি লেগে যায়— দেখি— বেটি কি করছে? ঘুমিয়ে পড়ল না কি?”
আমি তখন বুকে বালিশ চেপে, জানলার গরাদের ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখছি। বুদ্ধুর বাপ আর নরহরি দাস কখন হারিয়ে গেছে মন থেকে। আমি দেখছি, আকাশে একটাও তারা নেই। ওই, ওই বিদ্যুৎ চমকালো। আকাশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত একটা তীব্র আলোর ছড় টেনে গেল যেন— ‘ওপারেতে মেঘের মাথায় একশো মানিক জ্বালা!’
এক্ষুণি বাজ ডাকবে— কড়কড়! কড়কড়! আমি বিবর্ণ মুখে দুহাতে কান চেপে দেওয়ালের দিকে ফিরলাম। উত্তর আমেরিকার ম্যাপটা কখন যেন একটা বদমেজাজি বুড়োর মুখ হয়ে গেছে। কটমট করে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে।
পাড়ার ইস্কুলে আমার রেজাল্ট খুব ভাল হতো না। মাঝারি গোছের ছাত্রী ছিলাম আমি। বাড়িতে মায়ের কাছেই পড়তাম। আমার ধারণা ছিল, ইস্কুলের মিস-রা যত ভালই পড়ান না কেন, আমার মায়ের চেয়ে ভাল শিক্ষক কেউ নেই।
বড়বয়সেও আমার সে ধারণা খুব একটা পাল্টায়নি।
একবার ক্লাস থ্রি-র হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার রেজাল্টের পরে বাড়ি এসেছি। জামাকাপড় ছেড়ে বাঁধানো রোয়াকে বসে একটা আমের আঁটি চুষছি আপন মনে। ইচ্ছে আছে, বাগানের পশ্চিম কোণে আঁটিটাকে পুঁতবো। এই বাগানটায় সব রকমের গাছ আছে— আতা, পেয়ারা, বাতাবিলেবু, কলকেফুল, স্থলপদ্ম, দুখানা বাহারি ক্রোটন, মায় একটা ঝাঁকড়া ঘোড়ানিম গাছও আছে—শুধু কোনো আমগাছ নেই। অথচ আম খেতে আমি কি ভালই না বাসি!
তেড়ে আঁটি চুষতে চুষতে খেয়ালই করিনি, কখন উল্টোদিকের বাড়ির পঞ্চা ময়রাদের ভাড়াটে, এক জেঠিমা এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। মায়ের কাছে উলের প্যাটার্ন তুলতে এসেছে বুঝি। শীতে বুনবে।
”কি গো খুকু, তোমার রেজাল্ট ক্যামন হোলো এবার? আজ ফল বেরিয়েচে না?”
“হ্যাঁঅ্যাঅ্যা—- আমি ফোর্টিনথ হয়েছি।” আঁটির শাঁসগুলো তৃপ্তিভরে মুখে টানতে টানতে আমার জবাব।
“সেকি? ফার্স্ট সেকেন্ড না— থার্ডও না— একেবারে ফোর্টিনথ?”
আমার নিবিষ্ট ভাবে আঁটি ভক্ষণ বন্ধ হলো। আমি মুখে প্রশ্নচিহ্ন এঁকে বসে রইলাম। ফোর্টিনথ হওয়া তাহলে খুবই অগৌরবের— কই, মা তো রেজাল্ট দেখে কিচ্ছু বললো না আমায়? বকলোও না।
আমার অবিন্যস্ত মাথার চুলে তার রুক্ষ কড়াপড়া আঙুলগুলো বোলাতে বোলাতে সেই পাড়াতুতো জ্যেঠিমা বলতে লাগল—“কত বিদ্বান বাপের মেয়ে তুমি— তোমার মায়ের মতো অত নামী কলেজ পাশ করা মেয়ে একটিও নেই এ তল্লাটে— একটু মন দিয়ে পড়ালেখা কোরো মা— মনে রেখো, তোমার বাপ-মা তোমার মুখের দিকেই তাকিয়ে রয়েচে—তিনটে নয়, পাঁচটা নয়, একটিমাত্র সন্তান যে তুমি তাদের— তোমার ওপর তাদের কত আশা ভরসা—”
প্রায় চল্লিশ বছর আগের সেই অনামা শুভাকাঙ্ক্ষীর কথাগুলো আজও অনুরণন তোলে মনে। যে কোনো পরীক্ষার আগের রাত্তিরে পড়তে বসার সময় অবধারিত ভাবে জ্যেঠিমার কথাগুলো কানে বাজত।
আজ অনুভব করি, কতখানি নিখাদ সত্যি ছিল কথাগুলো। আমার হাতের বেড়ের মধ্যে গুটিশুটি হয়ে শোয়া আমার রুগ্ন মায়ের প্রায়ান্ধ চোখ,—ছবির ফ্রেমের মধ্যে থেকে বাবার দুটো উজ্জ্বল ঝকঝকে চোখ, নিরন্তর আমারই মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার মসৃণবন্ধুর চলার পথের দিকে সতর্ক দৃষ্টি মেলে, অতন্দ্র তাকিয়ে আছে।
পথ ভুল করি, আমার সাধ্য কি?
(ক্রমশ)