পশ্চিমবঙ্গের বাজারে কিন্তু ওয়েস্ট বেঙ্গল স্কুটার্স বিশেষ সুবিধে করতে পারল না।
আমরা খড়গপুর যাওয়ার বছর দুই আড়াইএর মধ্যেই বাবার অনেক সহকর্মী কাকুদের কোম্পানি ছেড়ে অন্য চাকরি নিয়ে চলে যেতে দেখলাম।
বাড়ির আবহাওয়া আবার মেঘলা হতে শুরু করেছিল। মা চিন্তিত। বাবা কেমন আনমনা। আমার ইস্কুলের পরীক্ষাগুলোর রেজাল্টও খারাপ হতে আরম্ভ করল।
হবে না কেন? পড়াশোনায় যে মন ছিল না মোটে। তখন মুখিয়ে থাকতাম পাক্ষিক আনন্দমেলা আর শুকতারার জন্য।
ভবিষ্যৎ নিয়ে মা-বাবার মধ্যে গুরুগম্ভীর আলোচনা চলছে খাবার টেবিলে, আর আমি শোবার ঘরের খাটে উপুড় হয়ে ডুবে আছি ‘ভুতুড়ে কুকুর’ আর ‘পান্ডব গোয়েন্দা’র মধ্যে।
সেটা ১৯৭৮সাল। দক্ষিণবঙ্গে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে। মেদিনীপুর জেলা রীতিমত ক্ষতিগ্রস্ত। রেললাইন জলের তলায় চলে যাওয়ার কারণে, খড়্গপুর থেকে কলকাতা সরাসরি ট্রেন চলাচল বন্ধ হলো। ট্রেন আদ্রা হয়ে প্রচুর ঘুরে, তিন ঘন্টার পথ ন’ঘন্টায় অতিক্রম করে কলকাতা পৌঁছচ্ছিল। তাও অনিয়মিত। আমাদের খুব মন খারাপ। এবার পুজোয় কলকাতায় যাওয়া হবে না? ঐটুকু বয়সেই পুজোর কলকাতা আর কলকাতার পুজোর যে একটা অমোঘ আকর্ষণ রয়েছে, তা বুঝে ফেলেছিলাম আমি। যদিও থিমপুজো টুজো তখন সুদূর ভবিষ্যতের গর্ভে, তবু, অপছন্দের ইস্কুলের বন্দী সময়টুকুর অবকাশে কলকাতা আসার জন্য ছটফট করতো আমার শিশুমন।
ষষ্ঠীর দিন সকালে বাজার নামিয়ে দিয়ে বাবা কোথায় যেন বেরিয়ে গেল। ঘন্টাখানেক পরে ফিরল। হাতে ট্রেনের টিকিট। মা-কে বলল, ”ঝপ করে গোছগাছ করে নাও। রাতের ট্রেনে রাঁচি যাচ্ছি আমরা। ওদিকে লাইনে গোলমাল নেই।”
মা তো আকাশ থেকে পড়ল। বলল– ”রিজার্ভেশন পেলে কি করে? এত তাড়াতাড়ি?” (প্রসঙ্গত, তখন তৎকাল ছিল না।)
বাবা বলল– ”দূর, এ তো প্যাসেঞ্জার গাড়ি। হাতিয়া প্যাসেঞ্জার। সারা রাত ধরে ঝ্যাকড় ঝ্যাকড় করতে করতে যাবে। সেকেন্ড ক্লাসের টিকিট। রিজার্ভেশন-টেশন হয় না এ গাড়িতে।”
মায়ের প্রশ্ন–”মাছ এনেছিলে যে বাজার থেকে। এতটা কি করে উঠবে এক দিনে?”
বাবার সপ্রতিভ উত্তর–”এক কাজ করো, চপ্ করে ফেলো মাছগুলোর। বেশ রাত্তিরে ট্রেনে যেতে যেতে খাওয়া যাবে।”
রাত দশটা নাগাদ আধঘুমন্ত খড়্গপুর স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম থেকে হুসহাস করতে করতে ছেড়ে দিল রাঁচি হাতিয়া প্যাসেঞ্জার। বেতের টুকরিতে মাছের চপ, আর বেঢপ কালো ট্রাঙ্কে আমাদের জামাকাপড় ঠুসে, কাঠের বেঞ্চিতে, টিমটিমে আলোর নীচে, আয়েস করে শুরু হল আমাদের ”পূজা হলিডে”!!
সহস্র অসুবিধা আর ‘নেই-নেই’- এর মধ্যেও সেই স্বল্পালোকিত কামরার ভিতর মা-বাবার অনাবিল হাসিটুকু আজও মনে আছে আমার। কয়লার গুঁড়ো ছেটাতে ছেটাতে তীব্র হুইসল দিয়ে অন্ধকার চিরে ছুটে যাচ্ছিল ট্রেন আর তার চাকার ছন্দে আমার মনে দোলা দিচ্ছিল — পুজোর ছুটি, পুজোর ছুটি, পুজোর ছুটি—
স্কুটার ফ্যাকটরি প্রথমদিকে শান্তিপূর্ণ ভাবে চললেও, পরে খুচরো শ্রমিক অশান্তির খবর আসতে আরম্ভ করল — বাবা-কাকুদের সান্ধ্য আড্ডাও হালকা মজলিশি থেকে চিন্তাসঙ্কুল হয়ে যাচ্ছিল দিনদিন।
উইক এন্ডে দীঘা বেড়ানোর বা কাঁসাইয়ের ধারে হঠাৎ পিকনিকের প্ল্যান থেকে আলাপচারিতা মোড় নিচ্ছিল অন্য দিকে। কানে ঢুকতো অচেনা শব্দবন্ধ — ইউনিয়ন, ছাঁটাই, ক্লোজার।
আমার জানার কথা ছিল না যে পশ্চিমবঙ্গ নামের যে রাজ্যটায় আমরা থাকি, সেখানে ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে গেছে বছর তিনেক আগেই। কারখানা, কোম্পানি, অফিসগুলো অভ্যস্ত হতে শিখছে এক নতুন শব্দের সঙ্গে — ধর্মঘট।
খড়গপুরে ঠিকে কাজের লোক জোটানো দুঃসাধ্য ছিল। বেশিরভাগ স্থানীয় বাসিন্দাই নিজেদের কাজটুকু নিজেরাই করে নিতেন, বাইরের লোকের সাহায্যের প্রয়োজন পড়তো না।
অসুবিধে হলো নতুন চাকরি নিয়ে ‘বড় শহর’ থেকে আসা আমাদের মতো বহিরাগত পরিবারগুলির। রেলশহর বলে খ্যাত খড়গপুরে কেন জানি না প্রচুর দক্ষিণী মানুষের বাস ছিল। আর তারা বেশির ভাগই ছিল অন্ধ্রের লোক। হয়ত পরিবারের একজন রেলকর্মী, বাকিরা স্থানীয় বাড়িতে কাজ খুঁজে ফিরত — মেয়েরা গৃহকর্মীর, ছেলেরা মজুর, মালী বা ড্রাইভারের কাজ।
স্কুটার কোম্পানির অফিসারদের বাড়িতেও এইরকম জনা কয়েক অন্ধ্রবাসিনী বহাল হয়েছিল। হ্যাঁ, আমাদের বাড়িতেও।
গিরজা (ঐ ছিল তার নাম) ভারি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন গৃহকর্মনিপুণা ছিল। কিন্তু স্রেফ ভাষা সমস্যার জন্য আমাদের বাড়িতে সে টিকতে পারল না। বাংলা সে মোটেই জানত না। আর মায়ের শেয়াল-কুকুর লেভেলের হিন্দি(মানে কেয়া হুয়া, ইয়ে হুয়া অবধি লিমিট), সে বেচারার বোধগম্য হতো না। ফলে, গিরজা বাঁধাকপি কোটার হুকুম পেলে অসময়ে এক কাঁড়ি কফি বানিয়ে ফেলতে লাগল — নয়ত, বাসনগুলো মেজে রাখার ফরমাশ শুনে একরাশ বেসনের বড়া ভেজে আনতে আরম্ভ করল। সুতরাং, অচিরাৎ গিরজা-বিদায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল।
কিন্তু সে বিদায় হবার কয়েকদিনের মধ্যেই যখন তরজুনা নামের এক সহায়সম্বলহীন মেয়েকে আমার মা ‘ডোমেস্টিক হেলপ’ হিসেবে নিয়োগ করল, বাবা তো বটেই, পাড়াসুদ্ধ লোক এমন বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তে হতবাক হয়ে গেল।
কারণ? তরজুনা অসম্ভব নোংরা। তরজুনা সিঙ্গল মাদার। এবং তরজুনা মুসলমান! এলাকাময় ঢিঢি পড়ে গেল। ব্যানার্জি বাড়ির বউ, সে নাকি আবার দীক্ষিত — বাড়িতে একটা নষ্টচরিত্রের(তখন মানে বুঝিনি) নিচুজাতের মুসলমানকে কাজের লোক রেখেছে! আহা, তার হাতের রান্না না খাক, জোগাড় দেবে তো মেয়েছেলেটাই। টিউবওয়েল থেকে তো আর বাঁড়ুজ্জে গিন্নি নিজে জল ভরতে যাবে না, ঐ মেয়েছেলেটাই এনে দেবে তো! চা করবে, ঘরদোর মুছতে গিয়ে ঠাকুরের আসন ছুঁয়ে দেবে, ম্যাগোঃ!
বাবাকেও একটু বিচলিত দেখেছিলাম মায়ের ওই সিদ্ধান্তে। মা শুধু তার প্রতিবাদী প্রতিবেশিনীদের একটা কথাই বলেছিল — ”মেয়েটা বড্ড গরিব। খেতে পায় না। ওর স্বামী ছেড়ে চলে গেছে। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে কাজ খুঁজতে এসেছিল এ বাড়িতে। ওকে না রাখলে অধর্ম হতো যে।”
তরজুনা থেকে গিয়েছিল। রুক্ষ চুলে তেল পড়েছিল। গায়ে শতচ্ছিন্ন ত্যানার পরিবর্তে উঠেছিল মায়ের পুরোনো তাঁতের কাপড়। দুপুরে সেই কাপড়ের আড়ালে মা বগি থালায় চুড়ো করে দিতো ডাল ভাত তরকারি, কোনোদিন দুটুকরো মাছ বা দুখানা ডিমসেদ্ধ। বলত —”মা ব্যাটায় খাস”।
তরজুনার ছেলেকেও দেখেছি। কোলে করে কাজে আসত মাঝে সাঝে। কালোকোলো হৃষ্টপুষ্ট ন্যাংটো শিশু, বছর দেড়েক বয়স হবে তার। আমার ছোট্টবেলার সোয়েটার ওর গায়ে দেখলে অব্যক্ত রাগে মুখ ভার হয়ে যেতো আমার — মায়ের বকুনির ভয়ে কিছু বলতে পারিনি কখনো।
ক্লাস সিক্সের অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর পরের রবিবারটা আমার স্পষ্ট মনে আছে আজও। বাবা দিন দুয়েক আগে কলকাতা গিয়েছিল। আমি জানতাম, ‘অফিসের কাজ’। কিন্তু, যেদিন ফিরলো, সেদিন বাবার মুখে অনাস্বাদিত সুখের তৃপ্তি। মা বাবার মধ্যে কি সব কথা হলো, শোবার ঘরে গল্পের বইতে মুখ গুঁজে উৎকর্ণ হয়ে শোনার চেষ্টা করলাম। কিছু বুঝলাম, বেশিটাই বুঝলাম না।
সেই রাতে, ঘুমোতে যাবার আগে, মা আমার চুলে বিলি কাটতে কাটতে জিজ্ঞাসা করেছিল —“হ্যাঁরে খুকু, এই ইস্কুলে তো তোর একটুও মন বসল না। নতুন জায়গায়, নতুন ইস্কুলে ভর্তি করে দিলে ভাল লাগবে তোর?”
উৎসাহের আতিশয্যে বিছানার উপর উঠে বসলাম আমি —“নতুন জায়গা? অন্য ইস্কুল? কোথায় মা, কোথায়?”
“এই কোম্পানিটা ভাল না তো, তাছাড়া কলকাতা থেকে অনেক দূরে, তাই বাবা এই চাকরিটা ছেড়ে দিচ্ছে, বুঝলি?”
“ছেড়ে দিচ্ছে?” — পলকে আমার গলা শুকনো — “বাবা আর চাকরি করবে না?”
আমার অনিশ্চয়তার আতঙ্ক মাকেও ছুঁয়ে গিয়েছিল বোধহয়। গলায় অনাবশ্যক জোর এনে মা বলেছিল —“দূর বোকা! চাকরি করবে না কেন? নতুন জায়গায়, নতুন চাকরি পেয়ে গেছে তো বাবা।”
“কোথায় মা?”
“ব্যারাকপুরের কাছে। গঙ্গার ধারে। একটা কটন মিলে রে!”
কটন মিল! মানে কাপড় তৈরি হয় সেখানে। কিন্তু মা যে বলল, ব্যারাকপুরের কাছে! তার মানে আমরা আবার সেই ঠাকুর্দার পুরোনো বাড়িতে গিয়ে উঠব? কাঁদো কাঁদো গলায় শুধোলাম —“আবার বুড়োদাদুর বাড়িতে থাকব আমরা, হ্যাঁ মা?”
মা এবার শব্দ করে হেসে ফেলল। “না রে, সেই মিলে কোয়ার্টার আছে, স্টাফ কোয়ার্টার। আমরা সেখানেই থাকব”। তারপর একটু দম নিয়ে বলল —“এই তো ক’দিন বাদেই নতুন বছর পড়বে, তোর ইস্কুল খুললেই বাবা প্রিন্সিপ্যালের সঙ্গে দেখা করে তোর টি সি নিয়ে আসবে। মিলটা গঙ্গার ধারে। ওপারেই চন্দননগর। ওখানে একটা ভীষণ ভাল ইস্কুলে তোকে ভর্তির চেষ্টা করব আমরা। খুব ভাল করে অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে হবে কিন্তু। পারবি তো?”
কথাগুলো যেন আমার কানেই ঢুকছিল না। খড়গপুরের ইস্কুলের জেলখানা থেকে মুক্তির আনন্দে আমি তখন মশগুল। তার উপর ঠাকুর্দার পচা বাড়িটাতেও থাকতে হবে না জেনে আনন্দ দ্বিগুণ হয়েছে। নতুন ইস্কুল নিয়ে কোনো কৌতূহলই হল না আমার। স্বপ্নাবিষ্টের মতো প্রশ্ন করলাম মাকে —“ওই কটন মিলটার নাম কি মা?”
“ডানবার। ডানবার কটন মিল। সুন্দর নাম, না রে খুকু?”
নতুন বছর পড়ার ঠিক সাতদিনের মাথায় আমাদের তিন বছরের পরিযায়ী সংসার একটা ফুলপাঞ্জাব ট্রাকের পিছনে তুলে, আমাদের ছোট্ট যাযাবর পরিবারটি চিরতরে খড়গপুর ছেড়ে চলল।
ড্রাইভারের পাশের সিটের জানলা দিয়ে আমি দেখলাম, কত্ত নিচে ফ্যালফেলে চোখে দাঁড়িয়ে আছে তরজুনা — ওর দুহাতে মস্ত কাপড়ের গাঁটরি, তাতে মা ঠেসে দিয়েছে শাড়ি, চাদর, বাচ্চার সোয়েটার, হাতের মুঠোর মধ্যে বাবাকে লুকিয়ে গুঁজে দিয়েছে মাইনের অতিরিক্ত কিছু টাকা। সব কেমন অবহেলে ধরে দাঁড়িয়ে আছে ও।আর ওর হাঁটু আঁকড়ে দাঁড়িয়ে জুলজুল করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে একরত্তি ছেলেটা।
ইঞ্জিনের গর্জন তুলে ট্রাক ছেড়ে দিলেন বিপুলকায় পাঞ্জাবি ড্রাইভার। মা দেখলাম, মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে রয়েছে। আমি জানতাম, মা কি ভাবছে।
“মা, তুমি চলে যাচ্ছ — ইবার তো মুই আর মোর ছেল্যাটো না খেতি পেয়ি মরে যাব গ’—”
পিছনে পড়ে রইল কাঁসাইয়ের চর, লম্বা প্ল্যাটফর্মের স্টেশন, লালমাটির রাস্তা ঘেরা ব্যস্ত রেলশহর। পথ ছুটে চললো স্থবির বাড়িঘর, পুকুর, মন্দির, পীরের মাজার, দোকান বাজার ফেলে —
আমার ছোট্ট মনে ঢেউ উঠল — সব্বাই কেমন ইট কাঠ সিমেন্টের ঘরে বসে, শুয়ে, গল্পগাছা ঝগড়াঝাঁটি কিম্বা কাজকম্ম করে সময় পেরোচ্ছে। অথচ, এক্ষুণি, ঠিক এই মুহূর্তে আমাদের কোনো ঘর নেই, ঠিকানা নেই — একটা ছাদের নীচে যা যা জিনিস লাগে, সব একটা ট্রাকের উপর, বিশাল আকাশের নীচে সাজিয়ে নিয়ে কেমন ছুটে চলেছি আমরা তিনজন, আমি, মা বাবা —
আজ অনেক বছর পরে, সেই বোকা আমিটাকে এই বুড়ো আমিটা বোঝাই, আসল কথা হলো ওই তিনটে শব্দ, বাবা-মা-আমি!
এই তিনটে শব্দ একসাথে থাকলে, আকাশের তলায় হোক, কিংবা মাটির একচালায়, ঘর সেখানেই, আর কোথাও নেই, কোথাও নেই, কোত্থাও না।
(ক্রমশ)