“তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি চালাও আখতারদা, আটটা পনেরোর লঞ্চটা না পেলে খুব প্রবলেম হয়ে যাবে”— ক্লাস এইটের আমার গলায় তখন বদমেজাজি তাড়া।
শ্যামনগরের জগদ্দল-ঘাটের ঘিঞ্জি রাস্তায় পথচলতি মেয়েপুরুষ, হাটের পসারিদের বাঁচিয়ে, প্রাণপণে প্যাডেল করে চলেছে মিল কোয়ার্টার থেকে জগদ্দল-ঘাট অবধি আমার দু’বেলা আসাযাওয়ার সারথি, রিকশাচালক আখতারদা।
এবড়োখেবড়ো পথে দ্রুত প্যাডেলের পরিশ্রমে ঘাম নামতো তার কপাল বেয়ে, আমি যেন দেখেও দেখতাম না। রিকশা টানতে টানতেই আপন মনে বিড়বিড় করত সে — সাড়ে আটটার লঞ্চে গেলেও তো ইস্কুল গেট খুলা মিলবে, ইতনি জলদি করার কি আছে রে বাবা?
আরে, আমিও তো জানি, সাড়ে আটটার লঞ্চে গেলেও চলবে, কিন্তু নন্দিনী যে আটটা পনেরোর লঞ্চেই যায়। আমার জন্য তো আর ও অপেক্ষা করবে না! আর স্কুলে পৌঁছোবার পরে গল্পের অবকাশ সেই লাঞ্চ টাইম ছাড়া পাওয়া দুষ্কর। আর লাঞ্চের সময় তো পিয়ালি, গার্গী, মিতালি ওরা সব থাকবে — ওদের সামনে প্রাণের কথা বলা যায়? এদিকে উইকেন্ডের পরে রাজ্যের গল্প জমে রয়েছে — নন্দিনীর ক্যাল যাবার কথা ছিল লাস্ট সানডে, কোনো মুভি দেখল কিনা জানতে হবে! এবারের নতুন স্পোর্টসওয়ার্ল্ডে সানির একটা দারু-উ-ণ পোস্টার দিয়েছে নাকি — আমাদের বাড়িতে স্পোর্টসওয়ার্ল্ড রাখা হয় না — ও আমাকে একেবারে দিয়ে দেবে বলেছে! ওর হার্টথ্রব তো রাভি শাস্ত্রী, সানির পোস্টার নিয়ে ওর মাথাব্যথা নেই। তবে কি না ফেয়ার এক্সচেঞ্জ হতে হবে — এবারের পাক্ষিক আনন্দমেলায় খেলার পাতায় শাস্ত্রীর একটা রঙিন ছবি দিয়েছে, ওকে দেখাতে ও বলেছিল ওটা ওর চাই — যদিও আনন্দমেলার পেজগুলো স্পোর্টসওয়ার্ল্ডের মতো গ্লসি নয়, তবুও শাস্ত্রীর ছবি তো — ও অদ্ভুতভাবে ঠোঁটদুটোকে ছুঁচোলো করে বলেছিল — “paper quality doesn’t matter—-”
ঘাটে পৌঁছে দেখলাম, ঘ্যারঘ্যার আওয়াজ করে আটটা পনেরো ছেড়ে যাচ্ছে জেটি থেকে, দৌড়েও আর নাগাল পাওয়া যাবে না।
আশাভঙ্গের রাগটা গিয়ে পড়ল আখতারদার ওপর। “তুমি অমন ইডিয়টের মতো না চালালে ঠিক পেয়ে যেতাম লঞ্চটা”—বদরাগী ঘোড়ার মতো পা ঠুকে বললাম আমি।
আখতারদার মুখটা শক্ত হয়ে উঠল —“দাঁড়াও, আমি বিকালে মাকে বলব, তুম আমাকে অংরেজিতে গালি দিছো! তুম বহোৎ গরম মিজাজ হচ্ছো আজকাল–”
আমি তো অবাক! যাহ্, গালাগাল আবার কখন দিলাম!
ডানবার কটন মিলের দুটো অংশ ছিল। একটায় ছিল মিল, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং, পাওয়ার হাউস, বয়লার, লেবার অফিস আর জেনারেল ম্যানেজার, ডেপুটি ম্যানেজার, কমার্শিয়াল ম্যানেজার, এঁদের গঙ্গামুখী বাংলো — আর ঠাকুরবাড়ি। সে ঠাকুরবাড়ির আরাধ্য দেবতা ছিলেন রাধাকৃষ্ণ — সঙ্গে গণপতির মূর্তিও ছিল। অন্য অংশে ছিল অফিসার আর সুপারভাইজারদের কোয়ার্টার, ব্যাচেলর কর্মচারীদের মেস, সেইসঙ্গে মেস সংলগ্ন ক্যান্টিন। আর ছিল ক্লাবঘর, ব্যাডমিন্টন কোর্ট আর একটা অনাদরের বাগানের মধ্যে বিরাট সিমেন্টের চৌবাচ্চা — হোলির দিন হোসপাইপ দিয়ে তাতে জল ভর্তি করে রং গুলে মেস কোয়ার্টারের আপামর জনগণকে চোবানো হতো।
কটন মিলের দুটি অংশের মধ্যে ছিল রাস্তা — উত্তরে গঙ্গার ঘাট আর দক্ষিণে গারুলিয়া মেন রোডের সংযোগকারী রাস্তা। আর সেই পথে আমাদের বেরোবার একমাত্র উপায় ছিল ইয়াব্বড় দুই পাল্লার টিনের গেট, তিন নম্বর গেট।
ডানবার ছিল বাঙ্গুরদের মিল। ম্যানেজার, সুপারভাইজার থেকে ক্লার্ক, বেশিরভাগই অবাঙালি। অফিসের কর্মচারীদের মধ্যে মাড়োয়ারিদের প্রাধান্য ছিল। আর শ্রমিকরা মূলত বিহার উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা দেহাতি মানুষ — বাঙালির সংখ্যা ছিল হাতে গোণা।
বাবা এখানেও পার্সোন্যাল অফিসার হিসেবে যোগ দিয়েছিল — ওয়ার্কাররা ডাকতো ‘লেবার সাব।’
আমি স্কুল থেকে ফিরবার পথে রিকশা থেকে নেমেই দেখতে পেতাম, আমাদের দোতলার কোয়ার্টারের রাস্তার দিকে মুখ করা জানলার গ্রিলে গাল চেপে, মা একদৃষ্টে আমার ফেরার পথের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার সারাদিন হুটোপাটি করা মনটা তখন একদৌড়ে মায়ের কাছে পৌঁছে যাবার জন্য হাঁকপাঁক করত।
“জানো মা, আজ ম্যাথস ক্লাসে পরীক্ষার সময়, আমার টিউনিকের পিছন দিকের বাটন খুলে গিয়েছিল, মিসেস ঘোষ নিজের হাতে লাগিয়ে দিলেন — আমি একটুও নড়ছি না দেখে বললেন – no feelings Sukanya, eh?”— মা তখন আমার থালায় গরম রুটি তুলে দিতে ব্যস্ত—“গল্প পরে শুনব, এখন খেয়ে নে তো, চারটে বাজতে যায়”—
“শোনো না মা, আজ আমাদের সকলের ওয়েট নেওয়া হচ্ছিল গেমস ক্লাসে। আমাদের সব্বার ওজন ফর্টিফাইভ থেকে ফিফটির মধ্যে, খালি শবরীর ওজন ফিফটি সিক্স — অথচ ও একটুও মোটা নয়, জানো? ও বলল ওর নাকি হাড় ভারী — হ্যাঁ মা, হাড় ভারী হলে ওজন বেশী হয়?”
মা যতই বকাবকি করুক, আমার বকবক চলতেই থাকত —“জানো মা, শ্রীলতা কি দারুণ আঁকে গো — ও নাকি প্রাইজ নিতে দিল্লি যাবে, জানো?” কিংবা —
“মা, জানো আমাদের ক্লাসে একটা মেয়ে আছে দেবলীনা, ও নাকি ওর বাড়িতে আমার নাম বলেছে সুকানিয়া, তখন ওর বাবা বলেছেন, মেয়েটি কি গুজরাটি না কি — এমন নাম — হিহিহি, দেবলীনা বলেছে না না, বাঙালি — তারপর যখন স্পেল করে বলেছে, ওর বাবা বলেছেন, তাই বল, সুকন্যা, অমন সুকানিয়া সুকানিয়া বললে বুঝব কি করে?”
তারপরেই –“ও মা, এবার স্কুল ম্যাগাজিনে বেঙ্গলি সেকশনে আমার ‘অভাগিনী’ কবিতাটা সিলেক্টেড হয়েছে, জানো? সেই যে গো, ‘দ্বারে দ্বারে ফেরে অভাগিনী মেয়ে, আমোদ করিয়া দেখে কেউ চেয়ে’ ওই কবিতাটা—”
এমনি নানা বকবকানিতে শ্রান্ত করে তুলতাম মাকে।
আখতারদা কিন্তু বাড়ি এসে আমার নামে নালিশ করে দিলো সেদিন।”মা, দিদি আজ হামাকে গালি দিছে।”
“সেকি আখতার, গালি দিয়েছে কি?”
“হাঁ মা, ইটি ফিটি বলে গালি পাড়ছে”—
আমি হাঁহাঁ করে উঠি —“না না মা, আমি শুধু ইডিয়ট বলেছি, আর কিছু বলিনি, বিশ্বাস করো—”
মায়ের ঠান্ডা, কঠিন চাহনি দেখে বুকের ভিতরটা শুকিয়ে আসছিল যদিও।
“আখতার, ওটা গালি নয় বাবা, ইংরেজি শব্দটার মানে বোকা — তা-ও ওর ওটা তোমাকে বলা উচিৎ হয়নি।ও আর বলবে না, আমি ওকে শাসন করে দেব, তুমি এখন এসো বাবা — কাল ঠিক সাড়ে সাতটায় আবার চলে এসো, কেমন?”
আখতারদা পিছন ফিরেছে কি ফেরেনি, আমার কানে টান পড়ল —“কনভেন্ট স্কুলে পড়ার এই শিক্ষা? আখতার বয়সে কত বড়, তাকে ইংরেজিতে demeaning words বলা হচ্ছে? তোমার লজ্জা হওয়া উচিৎ খুকু!”
হ্যাঁ, আমার স্কুল চন্দননগরের সেন্ট জোসেফ’স কনভেন্ট খুব নামকরা কনভেন্ট স্কুল ছিল ওই তল্লাটে। অবশ্য সেই স্কুলের সবকিছুই যে আমার ভীষণ ভাল লাগত, তা মোটেও না।
মিসেস লালের SUPW ক্লাস ছিল তার অন্যতম। কোনো বিচ্ছু মেয়ে, মিসেস লাল ক্লাসে ঢোকার আগেই চক দিয়ে বোর্ডে লিখে রাখত — Some Useful Periods Wasted—
আর তারপরই শুরু হতো গণথাপ্পড় খাওয়ার পালা। মিসেস লালের হাতে থাপ্পড় খায়নি, এমন মেয়ে সারা স্কুলে একজনও ছিল কি না সন্দেহ।
পরে, যখন আমরা ক্লাস টেনের ছাত্রী, মিসেস লাল অনেক কোমল হয়ে গিয়েছিলেন — তখন তাঁর ক্লাসে, উলের স্টোল বোনার ফাঁকে লাস্ট বেঞ্চে বসে আমি আর অনুশ্রী শরদিন্দু-র ঐতিহাসিক উপন্যাসের গল্প করতাম। তিন ঘর সোজা আর চার ঘর উল্টোর ডিজাইন ওলটপালট করে দিতো অর্জুন বর্মা, যৌবনশ্রী, বজ্রদেব।
এই স্কুলেই আমি প্রথম মুখোমুখি হলাম মৃত্যুর। একদিন ক্লাসে ঢোকা মাত্র গার্গী আমাকে বলল—“জানিস, আমাদের শ্যামার বাবা মারা গেছেন।” চন্দননগরী ঘটি গার্গীর জিভে কিছুতেই উর্দু ‘শমা’ উচ্চারিত হতো না, বাঙালি ‘শ্যামা’ই বেরোত।
শমা আগরওয়াল ছিল মুখচোরা মেয়ে। দরজার পাশেই ফার্স্ট বেঞ্চে বসত। ক’দিন আসছিল না স্কুলে। ওর বাবার মৃত্যুই যে ওর অনুপস্থিতির কারণ, সেটা ও স্কুলে না ফেরা অবধি জানতে পারিনি আমরা।
সেদিন নির্দিষ্ট বসার জায়গায় এসে ও স্কুলব্যাগটা রাখতেই, আমরা ঘিরে দাঁড়ালাম ওকে। কেউ কিছু বলতে পারছি না। কি বলব বুঝতেই পারছিলাম না কেউ। শমা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে চোখ থেকে গড়িয়ে আসা জল হাতের পিঠে মুছে নিচ্ছিল। আমি চাইলেও ছুঁতে পারছিলাম না ওকে। হঠাৎ মনে হলো — কেমন হয় বাবার চলে যাওয়া? আমার বাবাও যদি চিরকালের মতো চলে যায়? দেয়ালের হ্যাঙ্গারে ঝোলানো বাবার শার্টগুলো থাকবে, বসার ঘরের অ্যাশট্রেতে আধখাওয়া সিগারেটের টুকরো থাকবে, পাশবালিশ আর ভাঁজ ফেলা বিছানার চাদর থাকবে, বাথরুমের তাকে থাকবে অর্ধেক ব্যবহার হওয়া ব্রিলক্রিমের কৌটো — আর বাবাই শুধু থাকবে না? কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে এলো আমার। ফাঁকা হয়ে গেল মাথা। হৃদযন্ত্র একবার থেমেই আরবী ঘোড়ার মতো চলতে শুরু করল দ্রুত চালে।
শমার হাতদুটো জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললাম আমি।
আজও কখনো বিশ্বকর্মা পুজোর একলা সন্ধেবেলায় বাবার কথা খুব মনে পড়লে আমি যখন ছাদের আলসের ধারে গিয়ে দাঁড়াই, মাকে লুকিয়ে দুফোঁটা চোখের জল ফেলব বলে, আমার মধ্যে তেরো বছর বয়সী শমা আগরওয়াল এসে দাঁড়ায় — সমমর্মী আঙুলে মুছিয়ে দেয় ভিজে চোখ।
হারায় না, সত্যিই এই মহাবিশ্বে কিচ্ছু হারায় না — কখনো স্মৃতি হয়ে বেঁচে থাকে মানুষ, কখনো মানুষ হয়ে বেঁচে ওঠে স্মৃতি।
(ক্রমশ)