ডানবার মিলে ভোর পৌনে ছ’টার সাইরেন বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে পড়তাম আমি। ছ’টা দশের শিয়ালদাগামী ট্রেন ধরতেই হতো আমায়। ওভারব্রিজ থেকে নেমে লেডিজ কামরা অবধি যাবার সময় থাকত না। কল্যাণী থেকে দমদমের কাশীপুর গানশেল আর জেসপ ফ্যাকটরিতে কাজ করতে যাওয়া কাকুরা চিনে গিয়েছিলেন। জেনারেলে উঠেও জায়গা পেয়ে যেতাম রোজ।
শীতকালে বড্ড কষ্ট হতো আমার। মায়েরও। অত ভোরে উঠে, আমার স্কুল ড্রেস ইস্তিরি করে দেওয়া, দুখানা ঢাউস টিফিন বক্সে আমার দুবারের টিফিন গুছিয়ে দিত মা — একটা স্কুলের লাঞ্চ টাইমে খাবো, আর শুকনো কিছু হালকা টিফিন করব ফেরার সময়, ট্রেনেই। সকালে একটু আলুসেদ্ধ ভাত ছাড়া কিছু খেতে পারতাম না আমি — ওটুকুও গিলতে হতো মায়ের তাড়নায়। নয়ত ঐ অন্ধকার ভোরে, পাখিরাও যখন ডাকতে শুরু করেনি ভাল করে, তখন ভাত খাওয়া যায়? কতদিন দেখতাম, ট্রেন ইছাপুর স্টেশন ছাড়ার পরে পুবের ধানক্ষেতের উপর থেকে, কনে বউয়ের ঘোমটা তোলার মতো ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে কুয়াশার স্তর। একটা ক্রিমসন রঙের বলের মতো মোলায়েম নিস্তেজ সূর্যটা উঠব না, উঠব না করতে করতেও উঠেই পড়ছে শেষমেষ।
স্কুলে প্রেয়ার আরম্ভ হয়ে যেত আটটায়। অনেক চেষ্টা করেও লরেটো হাউসে হোস্টেল পাইনি আমি।
যাবার পথে স্কুল বাসও পেতাম না শিয়ালদা থেকে। কারণ, সে বাস বেরিয়ে যেতো সাতটার সময়। আর অধিকাংশ দিনই আমি ভারী ব্যাগ কাঁধে, হাঁচোড় পাঁচোড় করে দৌড়তে দৌড়তে জগৎ সিনেমার উল্টো দিকে শিয়ালদা ফ্লাইওভারের গোড়া থেকে, ভিড়ে ঠাসা সাতচল্লিশ নম্বর বাসে চড়ে ঝ্যাকড় ঝ্যাকড় করে স্কুলে পৌঁছোতাম। শ্যামনগর থেকে মিডলটন রো — একটা এবড়োখেবড়ো রেখায় আঁকা বৃত্ত সম্পূর্ণ হতো রোজ।
স্কুলটা ভাল না খারাপ, বুঝবার অবকাশ হয়ে ওঠেনি আমার। হুড়মুড় করে শুরু হয়ে যেত একটার পর একটা ক্লাস। হাতে এক বছর ন’মাস। আর তারই মধ্যে উচ্চমাধ্যমিকের ইলেভেন টুয়েলভের সিলেবাস শেষ করার তাড়া। সেই সঙ্গে লক্ষ্যভেদের মৎস্যচক্ষুর মতো, জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা।
লরেটো হাউসে ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ডের উচ্চমাধ্যমিকে, ইংরেজি ছিল ফার্স্ট ল্যাংগোয়েজ, আর দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ছিল বাংলা/হিন্দি। এই ব্যাপারটা ভবিষ্যতে আমার কাছে আশীর্বাদের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে প্রসঙ্গ এখন থাক।
আমি ইংরেজি আর বাংলা বাড়িতে পড়ার সময় পেতাম না। পড়তাম ট্রেনে। অতদূর থেকে স্কুলে আসার ফলে আমার সহপাঠী যাত্রাসঙ্গিনী কাউকে পাইনি কোনোদিন। বেশ নির্ঝঞ্ঝাটে দুটো সাবজেক্টের পড়া হয়ে যেত আমার।
এখন ভাবি, ভাগ্যিস সে সময় ইলেকট্রনিক মিডিয়া ছিল না — নচেৎ ব্যস্ত সময়ের লোকাল ট্রেনের কামরায়, স্কার্ট ব্লাউজ পরিহিতা বিনুনি ঝোলানো এক কিশোরীর সিটের উপর হাঁটু মুড়ে বসে, উচ্চস্বরে দুলে দুলে ইংরেজি সাহিত্যের অ্যাংলো স্যাক্সন এবং কেল্টিক যুগের তুলনামূলক আলোচনা কিংবা রবীন্দ্রনাথের ‘অনধিকার প্রবেশ’-এর সারাংশ আলোচনা(নিজের সঙ্গেই নিজের) টেলিকাস্টের জন্য বুম হাতে শিয়ালদার এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে ঘোরাঘুরি করত নবিশ রিপোর্টার — দুটো পঞ্চান্ন-র নৈহাটি লোকাল এক নম্বর থেকেই ছাড়ত কিনা!
স্কুল থেকে শিয়ালদা ফেরার পথে আমি স্কুলবাসেই আসতাম। আমার সহপাঠিনী এবং প্রাণের বন্ধু শুক্তি বসতো আমার পাশে।
‘বায়োলজির মিসেস কুন্ডুর গলাটা কেমন ভাঙা ভাঙা — বকলেও কি হাসি পায়, না রে?’
‘কেমিস্ট্রির মিসেস ঘোষ অমন উদ্ভট সেজে আসেন কেন বল তো? ঝোলা দুল, টকটকে লাল লিপস্টিক, মোটা করে কাজলপরা চোখে, টাইট্রেশন ভুল করলে এমন কটমট করে তাকান না — হিহিহি, ঠিক মনে হয় উইচ’ —
‘জানিস, মুনমুন সেনের মেয়ে দুটো এখানেই প্রেপ সেকশনে পড়ে, সেদিন তুই আসিসনি, মুনমুন ওর মেয়েদের নিতে এসেছিল — বাব্বা, পুরো হিস্ট্রি জ্যোগ্রাফি সেকশন ভেঙে পড়েছিল করিডোরে ওকে দেখার জন্য। আমরা সায়েন্সের মেয়েরা বেরোইনি বাবা, তখন মিসেস দাশগুপ্তের ইংলিশ ক্লাস চলছিল, উনি যা স্ট্রিক্ট — পরে এমন বিলো দ্য বেল্ট হিট করে বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে কথা শোনাবেন, কে শুনবে বল?’
‘অ্যাই, আমাদের পিয়া প্রতি সোমবার অ্যাবসেন্ট করে, লক্ষ্য করেছিস? ও নাকি কোথায় জয়েন্টের স্পেশ্যাল কোচিং নিতে যায় — এরকম করলে তো অ্যাটেন্ডেন্সের পার্সেন্টেজই থাকবে না — আমার বাবা অত সময় নেই, তাছাড়া এইচএসটা তো ভালভাবে উৎরোতে হবে, তাই না?’
‘হ্যাঁ রে, এবার কমিউনিকে-তে কুইজে ব্যারি ওব্রায়েন আসবে শুনলাম? কি হ্যান্ডসাম, না? আমি টিভিতে দেখেছি তো — তুই ওইদিন শাড়ি পরবি? প্লিজ পরিস, না হলে তো আমারও পরা হবে না!’
এমন টুকরো আলাপের মধ্যেই বাস মৌলালি ছাড়াতো। আমি ঢাউস ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ওঠার তোড়জোড় করতাম। শুক্তি যাবে সেই সল্টলেক। বাকি পথটা ওকে একাই যেতে হবে। আমাকেও।
আমি উঠে দাঁড়াবার মুহূর্তে শুক্তি আমার হাত খামচে ধরতো। ওর স্বপ্নালু দৃষ্টি জানলার বাইরে — দেখতাম, উপরপানে তাকিয়ে কি যেন বিড়বিড় করছে ও। আমি জানতাম ও কি দেখছে! ছ-সাততলা বিল্ডিংএর মাথায় নিওন বোর্ড। পশ্চিমের সূর্যের আলো মেখে ঝকঝক করছে লেখাটা — নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল।
আমি জানতাম, শুক্তি বিড়বিড় করছে —‘ঐ দ্যাখ সুকন্যা, আমাদের গোল, আমাদের স্বপ্ন, দেখতে পাচ্ছিস? আর তো মাত্র দেড়টা বছর।’
আমি হেসে হাত ছাড়িয়ে নিতাম। হ্যাঁ, ডাক্তার বাবার মেয়ে তুই, তোর স্বপ্ন তো নিশ্চয়ই। কিন্তু আমারও কি? আমি তাহলে কেন তোর মতো আবেগঘন হতে পারি না রে?
হালকা হেসে কেজো গলায় বলে উঠতাম — ‘এবার নামতে হবে। আসি রে। কাল দেখা হবে আবার। বাই’।
একদিন স্কুল শুরু হওয়ার ঘন্টা দুয়েকের মাথায়, আমরা একটা চাঞ্চল্য লক্ষ্য করলাম স্কুলের মিসদের মধ্যে। থার্ড পিরিয়ডে ফিজিক্সের মিসেস নাগ অফিসের বেয়ারার হাতে চিরকুট পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন। অফিস থেকেও একটা হট্টগোলের আওয়াজ আসছিল। যা-ই ঘটুক, আমাদের ক্লাস ছাড়ার পারমিশন ছিল না।
আমরা আরো কিছুক্ষণ মূর্তিমান জিজ্ঞাসা চিহ্ন হয়ে বসে থাকার পরে, আমাদের ক্লাস টিচার মিসেস কুন্ডু এলেন। ধরা গলায় বললেন —“মেয়েরা, একটি দুঃসংবাদ আছে। আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী একটু আগেই দিল্লিতে তাঁর দেহরক্ষীর হাতে খুন হয়েছেন। কলকাতায় হাঙ্গামা শুরু হয়ে গেছে। কার্ফিউ ডিক্লেয়ার্ড হবে হয়ত। ডোন্ট বি অ্যালার্মড। অল ইয়োর গার্জিয়ান্স আর বিইং ইনফর্মড ওভার টেলিফোন টু টেক ইউ ব্যাক হোম। সিস্টার আরসুলা নিজে ব্যাপারটা দেখছেন। স্কুল আপাতত বন্ধ থাকবে।”
তারপর একটু থেমে বললেন, “ইটস অলরেডি রিসেস টাইম। ফিনিশ ইওর লাঞ্চ হিয়ার। তারপরে অফিসের সামনে চলে এসো সকলে।”
আমার মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল যেন। মিস তো বললেন, ট্রেন চলছে না। তাহলে শ্যামনগর থেকে বাবা কি করে আসবে আমাকে নিতে?
এদিকে এক এক করে গার্জেনরা এসে মেয়েদের নিয়ে যেতে শুরু করেছেন। বেশির ভাগ মেয়েই কাছাকাছি থাকে। হিস্ট্রি সেকশনের একটি মেয়ের বাড়ি সোদপুরে। তার মা শিয়ালদা লরেটোর শিক্ষিকা। তিনি শিয়ালদা থেকে হেঁটে চলে এসেছেন। মেয়েকে নিয়ে শিয়ালদা স্টেশনেই যাবেন ফের। অনন্তকাল তো আর ট্রেন বন্ধ থাকতে পারে না। আর নেহাত যদি বিকেলের মধ্যেও ট্রেন চালু না হয়, বাসে বাসে ফিরতে চেষ্টা করবেন। আমি ঐ কাকিমার সঙ্গে ভিড়ে যেতে চেয়েছিলাম। বাধ সাধলেন সিস্টার আরসুলা। আমাদের প্রিনসিপ্যাল। লিগাল গার্জেন ছাড়া আর কারো হাতে কোনো ছাত্রীকে তুলে দেবেন না তিনি।
আস্তে আস্তে ভিড় পাতলা হতে আরম্ভ করল। ঊষা বলে আমার এক সহপাঠিনীর বাড়ি লিলুয়ায়। ওর বাবা কোনো যানবাহন না পেয়ে, সেই লিলুয়া থেকে সাইকেল চালিয়ে মিডলটন রো-য়ে এসে হাজির হয়েছেন।
ঊষা চলে যাবার পরে আমি এক্কেবারে একা হয়ে গেলাম। মায়ের দেওয়া টিফিন কখন হজম হয়ে গেছে। শুধু ফিরতি ট্রেনে খাবার জন্য শুকনো খাবার রয়েছে কিছু তখনো। আমার খিদে পাচ্ছিল। তার চেয়ে বেশি পাচ্ছিল কান্না।
এরই মধ্যে শুনতে পেলাম, অফিস বয়-রা বলাবলি করছে, যে মেয়েদের গার্জেন আসতে পারবে না, তাদের ইমার্জেন্সি কেস হিসেবে স্কুলের হোস্টেলে রাখা হবে, যতদিন না পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। আমি একটু স্বস্তি পাচ্ছিলাম সেটা শুনে — যাক বাবা, তবু হোস্টেল — কি ভাগ্যিস, থানা নয়।
গত জন্মদিনে উপহার পাওয়া, কবজিতে বাঁধা সস্তার হাতঘড়ি যখন বলছে দুটো পঁচিশ, আমার ধৈর্য যখন প্রায় ফুরিয়ে এসেছে, অফিসের দরজা দিয়ে এক দীর্ঘদেহী মানুষকে ঢুকতে দেখলাম আমি। দেখেই চিৎকার করে উঠলাম —“মামা!”
আমার মেজাজি, কিছুটা উন্নাসিক, রুক্ষভাষী মামাকে দেখে আমি আগে আর কখনো এত উদ্বেলিত হয়েছি বলে মনে পড়ল না। বিপদ অনেক কিছু ভুলিয়ে দেয়।
হ্যাঁ, বাবার ট্রাঙ্ককল পেয়ে (সেই ১৯৮৪ সালে শ্যামনগর- কলকাতা ট্রাঙ্ককল করতে হতো), মামা সোজা আমার মামাতো দাদাকে সঙ্গে নিয়ে, সেই বৌবাজার থেকে হাঁটতে হাঁটতে আমাকে নিতে আমার স্কুলে চলে এসেছিল। মামা সেদিন হিন্দমোটর, নিজের অফিসে যায়নি কোনো কারণে। ভাগ্যিস যায়নি।
তারপর আমার সে এক অচেনা কলকাতা দেখতে দেখতে মামার বাড়ি ফেরা। রয়েড স্ট্রিটের মুখে আস্ত একটা পোড়া ট্রামের কঙ্কাল দেখলাম। ওয়েলিংটনের মোড়ের কাছে আমার আতঙ্কিত চোখের সামনে একদল লোক লাঠিসোটা নিয়ে একটা সরকারি বাসের উইন্ডস্ক্রিন, জানলা, দরজার কাঁচ ভাঙতে শুরু করল। দাদা বলল —
“বাবা চলো, এপাশের গলি দিয়ে চলে যাই। বড় রাস্তা অ্যাভয়েড করাই ভাল।”
তারপর, দাদার মুখেই সব শুনতে শুনতে গেলাম — কোথায় ওর এক শিখ বন্ধু খবরটা শোনা মাত্র চুলদাড়ি সব ছেঁটে ফেলেছে, ভবানীপুরে কতজন পাঞ্জাবি ট্যাক্সি ড্রাইভার নাকি কচুকাটা হয়ে গেছে, বিবিসি নিউজে না কি বলেছে দিল্লিতে সমস্ত শিখদের মেরে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে, গোটা রাজধানীতে না কি আর একজনও শিখ বেঁচে নেই — এমনি সব সম্ভাব্য অসম্ভাব্য খবর বকবক করতে করতে যাচ্ছিল দাদা। মাঝে মাঝে কানে আসছিল দুমদাম বোমা পড়ার বিকট আওয়াজ। কখনো বা পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, ক্যালকাটা পুলিশের টহলদার জিপ। আর আমরা তিনজন যথা সম্ভব দ্রুতগতিতে আমার মামার বাড়ির নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছোবার জন্য হাঁটছিলাম — আমার মামার বজ্রমুষ্টিতে ধরা ছিল আমার হাত। সত্যিই, বিপদ অনেক কিছু ভুলিয়ে দেয়। ভিন্ন মেরুর মানুষদের এনে দেয় একই আপসের মাটিতে।
সেই মুহূর্তে আমার মনে হলো, প্রচন্ড বিপর্যয়ের দিনে, হয়ত ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও, আমার বাবার নোয়ার নৌকোটিতে আমি ঠিক তুলে নেব মামাকে। নেবই।
(ক্রমশ)