যতই ভাবি না কেন ডাক্তার হবার জন্য মৃত্যু আমার ওপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারবে না কিন্তু বারবার কিছু মৃত্যু এসে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। বিষণ্ণ করে। যত বয়স বাড়ছে বলতে দ্বিধা নেই ভীত করে তোলে কখনও কখনও। আরো মারাত্মকভাবে কখনও নিজের মধ্যে চরম পাপবোধ চাগিয়ে তোলে। যেসব মৃত্যুগুলো ঘটে গেল তাদের থেকে আমি নিজেকে কখনও মুক্ত করতে পারি না। মনে করতে পারি না তাদের মৃত্যুতে একটু হলেও আমার কোনো ভূমিকা ছিল না।
এ শুধু আমিই নই প্রতিটি ডাক্তারবাবুর কাছে যা রাতের ঘুম কেড়ে নেয় তা তাদের রুগিদের মৃত্যু। পার্থিবভাবে বলতে গেলে জীবনের থেকে মূল্যবান কিছু আর হতে পারে না। আর মানুষেরা আমাদের কাছে এসে মনে করে ডাক্তারবাবু আমাদের জীবিত রাখবেন। রুগির সাথে ডাক্তারবাবুর যত যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা বাড়ে ততই পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলে এই নির্ভরতার মাত্রা।
এর খারাপ ভালো দুটো দিকই আছে।
ভালো দিক মানে এই নির্ভরতা একটা মানসিক টনিকের কাজ করে। ডক্টর বিধান রায় নাকি বলতেন ডাক্তার হিসেবে ওনার সাফল্যের প্রধান কারণ উনি রুগিকে চিকিৎসা করার আগে তাদের মনোজগৎ বোঝার চেষ্টা করতেন। সেইভাবে চিকিৎসা করলে চিকিৎসা সামান্য ওষুধেই সেরে যায়। লোকেরা মনে করে ডাক্তারবাবু সাঙ্ঘাতিক কিছু করলেন। আসলে ব্যাপারটা তেমন কিছু নয়।
যেসব রুগিরা দীর্ঘদিন একই ডাক্তারবাবুকে দেখাচ্ছেন তাঁদের মধ্যে এক বিশ্বাস জন্মে যায় যে ওনার কাছে গেলেই আমি সুস্থ হয়ে যাবে। অনেক ক্ষেত্রে এটা সত্যিই অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করে দেয়। নিরাময় অনেক সহজ হয়ে যায়। রুগিকে মানসিক জোর ডাক্তারবাবুকে আলাদা ভাবে দিতে হয় না। রুগি ডাক্তারবাবুর কাছে এলেই সেটা পেয়ে যায়। এও অনেকটা গুরু-শিষ্যের বোঝাপড়ার মত ব্যাপার।
অসুবিধে হয় যখন এই নির্ভরতার মাত্রাছাড়া প্রভাবে ডাক্তারবাবুকে সেই রুগি প্রায় ওপরওলার আসনে বসিয়ে দেয়। তার মনে হয় আগের অনেকবারের মত এবারও তাকে ডাক্তারবাবু ঠিক উৎরে দেবেন। ডাক্তারবাবুও কখনও বা মনে ভাবতে শুরু করেন আরেকটু দেখাই যাক না। এই ‘ধীরে চল’ নীতিতে অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে যায়।
ভদ্রলোক আমাকে দেখাচ্ছেন প্রায় দশ বছর। এল আই সি-এর এজেন্ট। খুব বেশি রোজগার নেই। মায়ের পেনসন আছে। সব মিলে চলে যায়। অনেক বেশি বয়সে বিয়ে করেছেন। ছেলে হবার পর জানিয়ে গেছেন, ডাক্তারবাবু বাবা হয়েছি। পারিবারিক শ্বাসকষ্টের অসুখ। মায়েরও তাই। ইনহেলার, নেবুলাইজার সবই চলে। তবু এ অসুখ তো আর পেছনে যায় না। শুধু সামনেই এগিয়ে যায়। যত দিন যায় রুগিরা তত খারাপ হয়। একেকজনের খারাপ হবার মাত্রা একেকরকম। উনিও তাই। হাঁপানি বেড়েই যায়। সিজন চেঞ্জের সময় তা বাড়ে-কমে। তখন আমার কাছে আসেন। আবার ওষুধ খেয়ে স্বাভাবিক হন। আবার ইঞ্জিন চলতে থাকে।
দশ বছরের এই বোঝাপড়ায় তাঁর আমার প্রতি ভরসা ক্রমেই বেড়ে যায়। সেদিন খুব বাড়াবাড়ি। কিন্তু আমি মালদায়। অন্য একজনকে দেখাতে বাধ্য হয়েছেন। আমি আসতেই সব রিপোর্ট নিয়ে ফের আমার চেম্বারে। দেখলাম চেস্ট এক্স-রেতে ছোপ-ছোপ। পা ফুলছে। শ্বাসকষ্ট বেড়েছে। কোভিড করিয়েছেন। নেগেটিভ। রক্ত পরীক্ষার সব রিপোর্ট ভালোই আছে। বুঝলাম দীর্ঘদিন শ্বাসকষ্টে ভোগার জন্য হার্টের ওপর চাপ পড়ছে, ফেইলিওর হচ্ছে। অক্সিজেন স্যাচুরেশন ঠিকই আছে। হার্টের পরীক্ষা করাতে দিয়ে কিছু ওষুধ দিয়ে আবার দেখা করতে বললাম। দিন কয়েক বাদেই আবার চেম্বারে এলেন। এবার একা আসেন নি। সঙ্গে তার স্ত্রীও এসেছেন। এই প্রথম ওনার স্ত্রীকে দেখলাম। কিন্তু অর্থাভাবে রিপোর্ট করানো হয় নি।
“ডাক্তারবাবু উনি সব কথা আপনাকে খুলে বলেন না। তাই আমি আজ এসেছি। রাতের বেলা কিছুতেই উনি বিছানায় শুয়ে ঘুমোতে পারেন না। চেয়ারে বসে ঘুমোবার চেষ্টা করেন। কত কয়েকদিন ধরে সেটাও পারছেন না”।
“সর্বনাশ, তাই নাকি!”
কিন্তু ওনার সেই এক কথা। “না ডাক্তারবাবু এই দুদিন আপনার ওষুধ খেয়ে আমি আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি”। এই একই কথা উনি গত দশ বছর ধরে বলে নিজেকে আর আমাকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন। তবে এবার কিন্তু আমার লক্ষণ ভালো ঠেকল না। এত বছর ধরে ডাক্তারি করতে করতে আমি মাঝে মাঝে কেমন যেন অশনি সংকেত পাই। এক্ষেত্রেও তাই পেলাম। আবার কোভিড বেড়ে যাবার জন্য সবাইকে বিশেষত সন্দেহজনক রুগিদের খুব কাছাকাছি গিয়ে দেখছি না। এক্ষেত্রে না দেখে উপায় নেই।
দেখলাম জিভ নীলচে হয়ে আসছে। বুকের ঘরঘরানি কিছুই কমে নি। স্যাচুরেশন দেখলাম নব্বইয়ের অনেক নীচে। আর ভাবার প্রশ্নই নেই। বললাম, ‘এখুনি হাসপাতালে ভর্তি করান। না হয় বাঁচাতে পারবেন না’। এতদূর বলতেই হল।
“ডাক্তারবাবু আমরা সবাই তাই বলছি। উনি কিছুতেই যাবেন না। উনি ভাবেন উনি হাসপাতালে গেলেই মরে যাবেন”।
“আপনি ওষুধ দিন ডাক্তারবাবু। আমি ঠিক ভালো হয়ে যাব। আমি বাড়িতে অক্সিজেন নেব। আপনি ইঞ্জেকশন লিখে দিন”।
অনেক বোঝালাম। দেখুন আপনার যা অবস্থা বাড়িতে ভালো হবার নয়। বাড়িতে অক্সিজেন নিলেও নয়। আমি অত বড় ডাক্তার নই যে আপনাকে বাড়িতে চিকিৎসা করে সুস্থ করে দেব। উনি শুনবেন না। তাই প্রেসক্রিপশনে হসপিটালে ভর্তি করার অ্যাডভাইস লিখে নিজের দায়িত্ব এড়ালাম।
তারপর দিন তিনেক ফোন নেই। ভুলেই গেছি। একদিন দুপুরে হঠাৎ বাড়িতে ওনারই পাড়ার আমার এক রুগি এসে বললেন, আধঘন্টা আগে হাসপাতালে নেবার পথেই উনি মারা গেছেন। ডেথ সার্টিফিকেট দিতে হবে। উনি হাসপাতালে যেতে চাইছিলেন না মৃত্যুভয়ে। হাসপাতালে পৌঁছনোর আগেই মারা গেছেন। বেশি বয়সে বিয়ে করেছেন। ছোট বাচ্চা। সংসার কিভাবে চলবে? গত দশ বছরে এতবার আমার কাছে এসেছেন যে চোখ না বুজলেও ওনার মুখ দেখতে পাই। আমার ওপর এত নির্ভরতা এত আস্থা- তাই তার মৃত্যুটা খুব কষ্ট দিল।
এরকম কেউ মারা গেলে মনে হয় নিজের কেউ মারা গেছেন। বাড়ির লোকের কোনো অভিযোগ নেই। কেউ আমার দিকে আঙ্গুল তুলছে না। কিন্তু আমার মনে হল আমি হয়ত ওনার রোগের গুরুত্বটা, সেই সময়ে ভর্তি করার গুরুত্বটা ওনাকে ঠিকভাবে বোঝাতে পারি নি। এটা হয়। রুগির চাপে একজনকে অনেক সময় বেশি সময় দেওয়া যায় না। মানসিক ক্লান্তিও কাজ করে। বলার মধ্যে তেমন জোর আসে নি হয়ত। তখন হাসপাতালে গেলে হয়ত আরো বছর দুয়েক বাঁচতেন।
আমার তো খোঁজ নেওয়াও উচিত ছিল। উনি কেমন আছেন? কাউকে কাউকে কখনও কখনও নিই। তবে নিজের শেখার প্রয়োজনেই বেশি। জীবন-মরণের প্রশ্নে ততটা নয়। ফোন নাম্বার নিয়ে রেখে ফোনে জোর করলে হয়ত ভর্তি হতেন। আমাকেও এই তিনদিনে একবার ফোন করেন নি। ফোন করলে জোর করা যেত।
এই হল অবস্থা। এই হল তুচ্ছ ডাক্তারের ভগবত্তলাভের ফল। শুধু কি তাই? আজ আরেকটা জিনিস খুব লক্ষ্য করি কেউ কিছুতেই এখন হাসপাতালে ভর্তি হতে চায় না। কোভিড পরিস্থিতি বলে নয়। তার আগের থেকেই এটা চলছে। সরকারি হাসপাতালগুলোর অধিকাংশেরই অনেক উন্নতি হলেও প্রচুর রুগির চাপে তাদের বাসযোগ্যতা এত খারাপ যে সাধারণ মানুষ সেখানে যেতে চাইছে না। যাদের টাকা আছে তারা না হয় প্রাইভেটে যাচ্ছে কিন্তু যাদের সংসার সামলে ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স হয়ত কয়েক লাখ মাত্র আছে তারাও নিজেদের বাড়িতে পরিষ্কার পরিবেশেই বাস করেন। তারাও সেখানে থাকতে পারছেন না। কলকাতায় যাও বা আছে প্রান্তিক হাসপাতালগুলোর অবস্থা খুব খারাপ। তাই তারা বাড়িতেই অক্সিজেন, নেবুলাইজার নিয়ে পার্থিব ও অপার্থিব জগতের মধ্যে ডিঙি নিয়ে পারাপার করেন।
তবু এখনও আমার মনে হয় মৃত্যু একটা অত্যন্ত অনিশ্চিত ঘটনা। একে সঠিকভাবে অনুমান করা সহজ নয়। কতবার এমন হয়েছে রুগিকে হাসপাতালে পাঠাবার পর মনে হয়েছে ঘন্টা দুয়ের মধ্যেই মারা যাবে। এক হপ্তা বাদে হেঁটে দেখাতে চলে এসেছে। কাউওকে দেখে তেমন কিছু মনেই হয় নি, হঠাৎ শুনেছি মারা গেছেন। পরে জেনেছি। অন্য লোকের মুখে।
“ডাক্তারবাবু উনি তো মারা যাবার আগে অবধি আপনার ওষুধই খেতেন”। “ডাক্তারবাবু উনি তো শেষবার আপনাকেই দেখিয়ে গেছেন”। এই কথাগুলো খুব সাঙ্ঘাতিক। এগুলো আমার আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয়। ডাক্তারবাবুর আত্মবিশ্বাস যত কমে যায় তত তিনি ঝুঁকি নিতে ভয় পান।
আমার ভয় বাড়ুক। নাভির চারপাশে শিরশিরানি বাড়ুক। লোকে আমাকে ভীতু বলে গালাগালি দিক। তবু মানুষ যেন বেঁচে থাকে। আমার ভরসায় হাসপাতালে না গিয়ে মরে যেন না যায়। আমিও যেন তাদের হাসপাতালে পাঠাবার সময় আরও রূঢ় হতে পারি। সবার দায় নেওয়া আমি ছেড়ে দিয়েছি। তবে যাদের দায় নিয়েছি তাদের যেন সঠিক উপদেশটুকু দিতে পারি।
দারুন।