আজ ডক্টর্স ডে।
ডাক্তারদের নিয়ে ভালো ভালো কথা বলার দিন। ডাক্তারবাবুদেরও নিজেদের মহান ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভের দিন।
দুটিই বাড়াবাড়ি এবং ভ্রান্ত। কেননা, স্রেফ একটি বিশেষ পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে বা একটি বিশেষ বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করার কারণে কেউ মহান হয়ে যায় না।
ডাক্তাররাও একটি সমাজব্যবস্থার ফসল। যে সমাজ থেকে উঠে আসে সৎ পুলিশ অফিসারের মতোই ঘুষখোর পুলিশ – এবং শেষোক্তদের দাপটে প্রথমোক্তরা কোণঠাসা হয়ে যান। যে সমাজের গরিষ্ঠ অংশের ভোটে ঘুষখোর তোলাবাজরা বিপুল ব্যবধানে জেতেন ও সৎ রাজনীতিকের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। যে সমাজে সুবিচার পাওয়া বা না পাওয়া আর্থিক সামর্থ্যের উপর নির্ভর করে, কেননা সপক্ষে দুঁদে উকিল খাড়া করাতে পকেটের জোর লাগে।
সেই সমাজব্যবস্থা থেকে উঠে এসে কিছু তরুণ-তরুণী একটি বিশেষ বিষয় নিয়ে পড়লেন বলেই – এবং যে সমাজব্যবস্থা বিষয়ে সম্যক ওয়াকিবহাল ও অভিজ্ঞতাপ্রাপ্ত কিছু মধ্যবয়েসী একটি বিশেষ পেশায় নিয়োজিত বলেই – আচমকা ধোয়া তুলসীপাতা হয়ে উঠবেন, এমন আশা বাতুলতা মাত্র।
অতএব ডাক্তারদের মধ্যেও সৎ মানুষ থাকবেন, অসৎ মানুষও থাকবেন। নির্লোভদের মতো লোভীরাও থাকবেন। আছেন। ছিলেনও। অনুপাতের বদল ইদানীং ঘটলেও ঘটতে পারে, কিন্তু যে সমাজে টুকটাক চুরিচামারি ঘুষটুষকে আর তেমন দোষাবহ বলে ধরা হয় না, সেখানে এমন ঘটলে অবাক হওয়ার কিছু আছে কি?
আজ যাঁর জন্মদিন ও মৃত্যুদিন, সেই ডা বিধানচন্দ্র রায়, সফল রাজনীতিক ও কিংবদন্তী চিকিৎসক, তাঁর ব্যক্তিজীবন ও জীবনদর্শনের সঙ্গে এখনকার ‘সফল’ চিকিৎসক-রাজনীতিকদের সামগ্রিক প্যাকেজের তুলনা করলেই খানিকটা আন্দাজ পাওয়া যাবে।
তারপরও আমার মত, চিকিৎসক দিবস ব্যাপারটা তাৎপর্যহীন নয়। ঠিক যেমন আমার দৃঢ় বিশ্বাস, চিকিৎসকের শপথগ্রহণ – যা পেশাজীবনে পালনীয় কর্তব্যের কথা মনে করিয়ে দেওয়া – তার গুরুত্ব কম নয়। কেননা দায়দায়িত্বের কথা যত বেশিবার মনে করিয়ে দেওয়া যায়, ততই ভালো।
কিন্তু শুধু চিকিৎসকদের ক্ষেত্রেই এত কথা কেন?
কেননা, চিকিৎসা পেশাটা আর পাঁচটা পেশার থেকে আলাদা। অনেকাংশে ইউনিক।
ইউনিক কেন? কেননা, আরোগ্য বা সুস্থতা ব্যাপারটার সঙ্গে হুবহু তুলনীয় কিছু নেই।
এক বাস্তুকার আপনার বাড়িটি বানিয়ে দিলেন অত্যন্ত যত্নসহকারে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হলে এক ইঞ্জিনিয়ার মাঝরাত্তিরে দৌড়ে এসে কাজটা করে দিলেন। দুটিই গুরুত্বপূর্ণ। এরকম হাজারটা কাজে হাজারজনের সাহায্য ছাড়া আমাদের বেঁচে থাকা সম্ভবই হয় না। প্রতিটি কাজেই সংশ্লিষ্ট পেশাদারের দায়বদ্ধতা লাগে, কাজটা ঠিকঠাক হলে তাঁদের পারিশ্রমিক মিটিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি তাঁদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতাও জন্মায়, অন্তত ক্ষেত্রবিশেষে।
কিন্তু আপনার অতি প্রিয়জন শারীরিক কষ্টে ভুগছেন – তাঁকে সেই কষ্ট থেকে সারিয়ে তোলা – বা সম্পূর্ণ সারিয়ে তুলতে না পারলেও সারানোর যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া, যাতে কষ্ট লাঘব না হলেও প্রিয় মানুষটি স্বস্তি পেয়েছিলেন – তার সঙ্গে বাকি আর কিছুর হুবহু মিল নেই।
আর এজন্যই সুস্থতা বা আরোগ্য কোনও প্রোডাক্ট নয়।
চিকিৎসক আরোগ্য বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। আপনার বা আপনার প্রিয়জনের অসুস্থতার মুহূর্তে তিনি সেই অধীত বিদ্যার যথাসম্ভব প্রয়োগ করবেন, সেটুকু প্রত্যাশিত। সেই প্রয়োগ ও তাঁর সময় ব্যয়ের জন্য তিনি উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাবেন, সেও প্রত্যাশিত।
কিন্তু মনে রাখুন, আরোগ্য বা সুস্থতা কোনও পণ্য বা প্রোডাক্ট নয়। আরোগ্যের জন্য ডাক্তারের চেষ্টা বা সময়, অর্থাৎ সার্ভিস, তাকে আপনি প্রোডাক্ট ভাবলেও ভাবতে পারেন – কিন্তু আরোগ্য কোনও প্রোডাক্ট নয়।
মাস্টারকার্ডের বিজ্ঞাপন মনে করুন। দেয়ার আর সাম থিংস মানি ক্যান্ট বাই, ফর এভরিথিং এলস, থেয়ার ইজ মাস্টারকার্ড। যা যা টাকা দিয়ে কেনা যায় না – যেমন প্রেম-ভালোবাসা-স্নেহ-মমতা ইত্যাদি – তার মধ্যে সুস্থতা ও আরোগ্যও পড়ে।
সরকারবাহাদুর চিকিৎসা ব্যাপারটাকে ক্রেতা সুরক্ষার আওতায় এনে খানিকটা কনফিউশন তৈরি করে ফেলেছেন। আজকাল সবই কেনাবেচার হিসেবে বিচার করা হয়, সে শিক্ষাদানই হোক বা চিকিৎসা – কিন্তু যথাসাধ্য পড়ানোর পর পড়ুয়া শিখল কিনা বা যথাসাধ্য চিকিৎসার পরেও রোগী সেরে উঠলেন কিনা, তাকে অর্থব্যয়ের সাপেক্ষে ভাবতে চাইলে মুশকিল। ‘সার্ভিস’ অংশটিকে কেনাবেচার অংশে ধরতে পারেন অবশ্যই – অর্থাৎ টাকা নিয়ে শিক্ষক/ইশকুল সাধ্যমতো পড়ালেন কিনা বা টাকা নিয়ে ডাক্তার/হাসপাতাল সাধ্যমতো সারিয়ে তোলার চেষ্টা করলেন কিনা – কিন্তু তার বেশি ভাবতে গেলেই মুশকিল। অর্থাৎ সারিয়ে তোলা গেল কিনা, এটা ক্রেতা সুরক্ষায় বিচার্য হওয়া উচিত নয়। ক্রেতা সুরক্ষায় বিচার্য নয়ও। কিন্তু যেহেতু চিকিৎসা অংশটি ক্রেতা সুরক্ষার অন্তর্ভুক্ত, একটা প্রচ্ছন্ন বার্তা পৌঁছে যায়, প্রত্যাশা জন্মে যায় – টাকা দিলে সেরে ওঠা উচিত, সেরে না ওঠার অর্থ টাকা নিয়েও চিকিৎসা করা হয়নি। যে ভাবনা বিপজ্জনক।
ঠিক যেমন উকিল পয়সা নিয়ে আপনার মামলা যথাসাধ্য লড়লেন কিনা, সে নিয়ে আপনি ভাবতেই পারেন – না লড়লে ক্ষুব্ধও হতে পারেন – কিন্তু সেই লড়াইটরাইয়ের শেষে মামলার রায় আপনার পক্ষে না গেলে উকিলের উপর চটে যাওয়াটা অনুচিত। যদিও – খুবই কিউট ব্যাপার – উকিলের কাছে পয়সা দিয়ে প্রত্যাশানুরূপ ‘সার্ভিস’ না পেলে, অর্থাৎ উকিলবাবু মামলায় গা না লাগালে, আপনি ক্রেতা-আদালতে যেতে পারেন না। অথচ, চিকিৎসক ঠিক করে চেষ্টা করেছেন কিনা, সে নিয়ে আদালতের লড়াই উকিলবাবুরাই লড়ে থাকেন। কিন্তু সে আলোচনা এক্ষেত্রে অবান্তর।
তো কথাটা হলো, চিকিৎসাকে যদি সার্ভিস ভাবেন, এবং পয়সা ফেলে আপনি সার্ভিস কিনছেন বলে ভাবেন – সে আপনি ভাবতেই পারেন। কিন্তু পয়সা ফেলে আরোগ্য বা সুস্থতা কিনছেন, এমনটা ভাবার অধিকার আপনার নেই।
দ্বিতীয়ত, চিকিৎসাকে যদি সার্ভিস ভাবেন, এবং পয়সা ফেলে আপনি সার্ভিস কিনছেন বলে ভাবেন – তাহলে হ্যাপি ডক্টর্স ডে ইত্যাদি বলবেন না। কেননা হ্যাপি প্যান্টালুন্স ডে বা হ্যাপি বিগ বাজার ডে ইত্যাদি হয় না।
সমাজে দুরকম সম্পর্ক হয় – একটি সামাজিক নিয়ম মেনে চলে, আরেকটি বাজারের নিয়ম। সোসাইটাল নর্মস এবং মার্কেট নর্মস। আপনার শাশুড়ি জামাইষষ্ঠীতে যত্ন নিয়ে খাওয়ানোর পর আপনি ইলিশ-চিংড়ির বাজারদর অনুযায়ী তাঁকে পয়সা বুঝিয়ে দেন না, কেননা সম্পর্কটা সোসাইটাল নর্ম মেনে চলে। আবার পাড়ার মুদিখানার সঙ্গে হাসিঠাট্টা গল্পগুজবের সুসম্পর্ক রেখেও আপনি জানেন, ওজনটা দেখে নিতে হবে – মার্কেট নর্ম।
সরকারবাহাদুর মোটামুটি চার হাতেপায়ে দৌড়াচ্ছেন, যাতে চিকিৎসা ব্যাপারটা বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া যায়। বেসরকারি বলতে মুনাফাভিত্তিক, এমনকি মুনাফাকেন্দ্রিক, চিকিৎসা। সেক্ষেত্রে চিকিৎসা ব্যাপারটা মার্কেট নর্মস-এ বিচার্য হওয়ার দিকেই এগোচ্ছে। এগিয়ে গিয়েওছে। এমতাবস্থায় ডাক্তারবাবু হীরের চচ্চড়ি খেতে চাইলে রাগারাগি বা শ্লেষের কিছু নেই, শুধু দেখে নিতে হবে তিনি পয়সা নিয়ে ‘সার্ভিস’ দিলেন কিনা।
এবং এও মাথায় রাখতে হবে, মার্কেট নর্মস-ই যদি শিরোধার্য করেন, তাহলে ডাক্তারের চেম্বারে – হিপোক্রেটিক ওথ বা চরক শপথ জাতীয় কোনও উচ্চমার্গের আদর্শের প্রতিশ্রুতি নয় – একেবারে দোকানের স্টাইলে ‘আমি একজন ব্যবসায়ী, ব্যবসা আমার ধর্ম, ক্রেতা আমার ঈশ্বর ইত্যাদি প্রভৃতি’ জাতীয় ‘বাণী’ টাঙিয়ে রাখাই কর্তব্য।
সরাসরি টাঙিয়ে না রাখলেও, যাঁরা অন্তত এই কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারছেন – এবং রোগী-পরিজনকে ব্যবসার ক্রেতা-তুল্য ঈশ্বরজ্ঞানে সার্ভিস দিতে পারছেন – সময়ের বিচারে তাঁরাই শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক।
আর যাঁরা চিকিৎসা ব্যাপারটার সঙ্গে জনসেবা ইত্যকার ধ্যানধারণাকে গুলিয়ে ফেলছেন, তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। কেননা, চিকিৎসকের ভালোমন্দ – বা সাফল্য – মাপা হবে তাঁর ব্যাঙ্ক ব্যালান্স বা চেম্বারে মাপ বা তিনি যে হাসপাতালের সঙ্গে ‘অ্যাটাচড’ তার ঝাঁ-চকচকেপনা দিয়ে। যাঁরা পুরোনো আদর্শ ধরে বাঁচছেন, তাঁরা, আর পাঁচটা পুরোনো জিনিসের মতোই, বাতিল। মায়া থাকলেও, বাতিলই।
আর আপনি?
অর্থাৎ যিনি চিকিৎসক নন? চিকিৎসকের কাছে আপনার ঠিক কী প্রত্যাশা, সেই ব্যাপারে কনফিউশন কাটিয়ে উঠুন, প্লিজ।
চিকিৎসাকে যদি মার্কেট নর্মস-এ ফেলতে চান, তাহলে ওইসব কত-ফিজ-হীরের-চচ্চড়ি ইত্যাদি কথাবার্তা বন্ধ করুন। সার্ভিস ঠিকঠাক পাচ্ছেন কিনা, এটুকুই বিচার্য।
আর চিকিৎসাকে যদি সোসাইটাল নর্মস-এ ফেলতে চান, তাহলে চিকিৎসকের দায়দায়িত্ব প্রসঙ্গে কথায় কথায় কত টাকা খরচা হলো সে কথা মনে করাবেন না – কেননা, সেক্ষেত্রে, চিকিৎসকের দায় সবরকম টাকাপয়সার হিসেবের উর্দ্ধে। এবং সেক্ষেত্রে সরকারকেও বলুন, চিকিৎসা ব্যাপারটাকে মুনাফার আওতার বাইরে রাখতে। চিকিৎসক পারিশ্রমিক পাবেন, অবশ্যই – শ্রম ও সময়ের বিনিময়ে পারিশ্রমিক তাঁর প্রাপ্য – কিন্তু চিকিৎসা যেন মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্র না হয়ে দাঁড়ায়।
মাঝামাঝি কিছু হয় না।
ডক্টর্স ডে দিনটা বছরের ঠিক মাঝখানে।
কিন্তু চিকিৎসা ব্যাপারটাকে কীভাবে দেখবেন, সে নিয়ে মধ্যপন্থা নেওয়াটা খুবই গোলমেলে কাজ। আপনার পক্ষেও, চিকিৎসকের পক্ষেও।