প্রখ্যাত রসসাহিত্যিক হিমানীশ গোস্বামী কখনো বলেছিলেন — “ভাবী হাসির গল্প লিখিয়েদের কাছে আমার একটি বিশেষ ঘোষণা রয়েছে — তাঁরা প্রথমেই জেনে রাখুন যে শুধুমাত্র হাসির গল্প লিখে সাহিত্যসভায় কলকে পাওয়া যাবে না। তার হাতে গরম প্রমাণ, হাসির গল্প লিখিয়েরা কেউ কোনোদিন নোবেল, জ্ঞানপীঠ, আকাদেমি এমনকী রবীন্দ্র পুরস্কারটুকুও গলায় ঝোলাতে পারেননি। কারণ আমাদের জাতীয় চর্চা হচ্ছে কান্না। কান্না দিয়ে পাঠক সহ পুরস্কার দানকারীদের মন-প্রাণ যতটা সহজে চবচবে করে ফেলা যায়, হাসি দিয়ে তার বিন্দুমাত্রও নয়।”
বিতর্কিত মন্তব্য। ভোটযুদ্ধের চাপানউতোরের বাজারে নতুন তর্ক উসকে দেবার স্পৃহা নেই, তবু কিছু কথা মনে এলো। বলেই ফেলি।
বাংলা ভাষায় ব্যঙ্গাত্মক, শ্লেষধর্মী রম্যরচনা হুতোমের কাল থেকে আরম্ভ করে পরশুরাম, ইন্দ্রমিত্র, তারাপদ রায় হয়ে অধুনা চন্দ্রিল পর্যন্ত সগৌরবে বিরাজ করছে ঠিকই, তবে নির্ভেজাল হাস্যরসের লেখা শিব্রাম পরবর্তী সাহিত্যে শূন্য না হলেও বেশ কম। আমি এখানে ছাপাখানার হার্ডল পেরোনো প্রকাশিত লেখার কথাই বলছি অবিশ্যি — ফেসবুকের, এবং কেবলমাত্র ফেসবুকের লেখার কথা বলিনি।
মুখবইয়ের প্রায় সমস্ত লেখাই আনন্দ এবং হাস্যমন্ডিত, সরস, সজীব, ফুল্ল — পড়তে পড়তে পাঠকের অজ্ঞাতসারেই ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি অবধারিতভাবে উঁকি দিয়ে যায়।
ব্যতিক্রম কি নেই? আছে। জলজ্যান্ত ব্যতিক্রম আমি।
ফেসবুকে আমি মূলত ডায়েরি জাতীয় অথবা ‘এসে’ রাইটিংএর মতো বর্ণনাবহুল, কল্পনাশ্রয়ী লেখা লিখে থাকি। ইদানীং সেই লেখা এতই অশ্রুভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে, যে মুষ্টিমেয় পাঠকবন্ধুরা আমার মানসিক স্থৈর্য্য নিয়ে রীতিমত চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। (আমার অসীম সৌভাগ্য যে এই ধেড়ে নবিশ কলমচিকে তাঁরা তাঁদের সিরিয়াস ভাবনাচিন্তার মধ্যে এতখানি জায়গা দিয়েছেন)।
ইদিকে আমি তো প্রাতঃস্মরণীয় বরেণ্য সাহিত্যিক জগদীশ গুপ্ত মশাইয়ের লেখালেখির অক্ষম এবং স্পর্ধিত অনুসরণের চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম, কিন্তু চিন্তিত সুহৃদবর্গের দুর্ভাবনা নিবৃত্তির জন্য একটু অন্যরকম লেখার প্রবৃত্তি হলো আজ।
আমি এমন ‘পয়দাইশি’ গোমড়া হলে কি হবে, আমার পিতৃ-মাতৃকুলের অনেক বুজুর্গ কিন্তু দস্তুরমতো কৌতুকপ্রিয় ছিলেন। দু’চারকথায় সেই স্মৃতিচারণ করতে চেষ্টা করলাম।
আমার ন’জ্যাঠা (বেঁচে থাকলে নব্বই হতেন) যখন ম্যাট্রিকের ছাত্র, একবার বাংলা পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছিল, ‘অপু’ এবং ‘নবকুমার’এর তুলনামূলক চারিত্রিক বিশ্লেষণ করো।
জেঠু কম কথার মানুষ, বিষয়বস্তু ফেনাতে আদৌ পছন্দ করতেন না। তিনি ফুলস্ক্যাপ কাগজের মাঝ বরাবর একটি লম্বা লাইন টানলেন, লাইনের একদিকের শিরোনামে লিখলেন অপু, অন্যদিকে নবকুমার। তারপর ১,২,৩,৪ করে পয়েন্ট ধরে ধরে কোন বইয়ের চরিত্র, লেখকের নাম, চরিত্রের বয়স, ঠিকানা, পরিবেশ, পারিপার্শ্বিক সময়কাল ইত্যাদি চুলচেরা পার্থক্য লিখে এলেন সংক্ষেপে। সাকুল্যে বারোটি পয়েন্ট লিখেছিলেন। শোনা যায়, পাশ করেছিলেন, তবে কানমলা সহযোগে।
আমার ছোটপিসি থাকতেন চেতলায়। যতদিন আঙুল ও কলম সচল ছিল, নিয়মিত পত্রাঘাত করতেন বাবাকে, কুশল সংবাদের জন্য। ছোটপিসি স্কুলের মুখ দেখেননি, ভাইদের কাছেই অক্ষর পরিচয় — নিজেদের খেলাধূলাপ্রীতির কারণে ভাইয়েরা সম্ভবত ছোড়দির গৃহশিক্ষায় খুব বেশি যত্নবান হতে পারেনি।
একবার বিজয়ার পরে পিসির পোস্টকার্ড হাতে নিয়ে বাবা চেঁচিয়ে উঠল — “একি, বুজার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি? আমার আমাদের কারুর তো ফোঁড়া টোড়া কিছু হয়নি কোথাও, এসব কি জানতে চেয়েছে?” (বুজা আমার ছোটপিসির ডাকনাম।)
মা এসে পোস্টকার্ডে একবার চোখ বুলিয়েই রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলে গেল — “নিজেরই তো দিদি, স্বরবর্ণটুকুও ভাল করে শেখাতে পারোনি? ছি ছি!”
বলা বাহুল্য, পোস্টকার্ডের প্রথম লাইনে লেখা ছিল — পুজ কেমন কাটল?
বাবা যে পুজোকে পুঁজ পড়বে, এটা তার প্রারব্ধ।
ছোটপিসি আবার আমার মায়ের রান্না তেমন পছন্দ করতেন না। অথচ প্রবল ব্যক্তিত্বময়ী মাকে সে কথা সরাসরি বলে উঠতে পারেননি কখনো। একবার আমাদের বাড়িতে কাবলি ছোলার তরকারি খেয়ে কেমন লাগল জিজ্ঞেস করায় ঘাড়টি নেড়ে বলেছিলেন — ”ওঃ, দারুণ খেলাম! আহা ছোলা তো নয়, যেন বুলেট!”
বলা বাহুল্য ছোলা সেদ্ধ করার সময় প্রেশার কুকারে সিটি কয়েকটা কম পড়েছিল সেদিন।
আমার অতি গোঁড়া মামার বাড়িতে পুরুষদের লুঙ্গি আর মেয়েদের হাতাকাটা ব্লাউজ পরা নিষিদ্ধ ছিল। একবার আমার দিদা দমদমে ন’মাসীমার বাড়ি বেড়িয়ে এসে মামার বাড়িতে ফিরে মাইমার কাছে ন’মেসোমশায়ের প্রশংসা করেছিলেন –”আহা ছোটবৌমা, হৃষিকেশ আমার সোনার টুকরো জামাই! কেমন ঠান্ডা, শান্ত ছেলে ভাবো — আপিস থেকে বাড়ি ফিরে গা-টা ধুয়ে অনিতার একখানি শাড়ি পরে বইখাতা নিয়ে ছেলে পড়াতে বসে যায়, কোনো জ্বালা নেই!”
মাইমা প্রথমে আঁতকে উঠলেও, পরে ঠান্ডা হয়ে আবিষ্কার করেছিলেন হৃষিকেশ মেসোমশাই বাড়িতে বাটিকের লুঙ্গি পরেন, পাজামা/ধুতি চলে না — বিয়ের আগে সেইটে যাচাই করার কথা কারুর মনে হয়নি।
আমাদের ছেলেবেলায়, মামার বাড়ির শতাব্দীপ্রাচীন জগদ্ধাত্রী পুজোয় অন্তত পাঁচশো লোকের পাত পড়ত। বাড়ির দোতলার বারান্দার কোণে ডাঁই করে রাখা থাকত ধোয়া, কাটা কলাপাতা — ভোগপ্রসাদ বিতরণ হতো তাতেই। বারান্দায় জল যাবার ছোট নালি ছিল একটা, তাই ধোয়ার অসুবিধে হতো না। আমার ছোটমাসীর ছেলে গুটু ছিল পগেয়া বিচ্ছু, তায় মারধোরের হাতও ছিল খুব পাকা। ন’মাসীর রোগাসোগা ভালমানুষ ছেলে দীপটু আর ভেবলি আমি ছিলাম তার খেলুড়ে সাথী এবং অত্যাচারিত প্রজা, দুই-ই। একবার সকলে যখন অষ্টমী পুজোয় ব্যস্ত, দীপটু আর আমাকে গাঁট্টা আর কিল-চড়ে নাস্তানাবুদ করে গুটু আমাদের ঐ বারান্দার কোণের নালির মুখে হিসি করতে বাধ্য করে — সেখানেই তখন কলাপাতার বোঝা রাখা ছিল। ব্যাপারটা অন্যায় হচ্ছে বুঝেও প্রতিবাদ করার সাহস হয়নি।
আমি তখন বছর ছয়েক, গুটু-দীপটু সাড়ে চার, ওরা সমবয়সী ছিল।
তারপর তো যথারীতি ভোগ খাওয়া চুকল — ঐ কলাপাতাতেই।
খাওয়ার পরে মা-মাসীদের বড়মামা হাসতে হাসতে সকলকে ডেকে বলেছিলেন — “শোনো, তোমরা আজ কি খেয়েছ জানো? হাহা — চরণামৃত নয় হে, শিশু প্রস্রাবামৃত খেয়েছ!” বলেই আরো একদফা অট্টহাস্য!
বুড়ো যে পাশের ঝুলবারান্দা থেকে সবটা নজর করেছে, কে জানত! এরপর গুটুর কপালে যা জুটেছিল, সে আর না-ই বা বললাম!
তবে অভাবিত হাস্যরসের সাক্ষী হয়েছিলাম বড়বেলায় — তার সঙ্গে অবিশ্যি আমার পরিবারের যোগ নেই।
আমি তখন কল্যাণীর জওহরলাল নেহরু হসপিটালে (তখন সেটা মেডিক্যাল কলেজ হয়নি, সালটা ১৯৯৫) প্লাস্টিক সার্জারির হাউসস্টাফ। সপ্তাহে একদিন জেনারেল সার্জারির চব্বিশ ঘন্টা অনকল থাকে। তেমনই এক অনকলের রাত পেরিয়ে ভোরের মুখে হাউস স্টাফ রুমের দরজায় মুহূর্মুহূ ধাক্কার শব্দ বাজল। বেরিয়ে শুনলাম, অ্যাকসিডেন্ট কেস — সামনেই চৌত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়কে দুর্ঘটনা ঘটেছে।
“শিগগির চলুন, স্যার আপনাকে শিগগির শিগগির যেতে বলেছেন” — গ্রুপ ডি দাদাটির উত্তেজনা একটু অস্বাভাবিক লেগেছিল। আরে, অ্যাকসিডেন্ট তো হামেশা হচ্ছে, এত উত্তেজনা কেন? অনকল ডিউটিতে ছিলেন সার্জারির পাঁচ নম্বর ইউনিটের হেড ডাক্তার ব্যানার্জি —উত্তর চব্বিশ পরগণার স্বনামধন্য শল্যচিকিৎসক। তাঁর হিমশিম খেয়ে আমা হেন ‘ফালতু’ হাউসস্টাফকে জরুরি তলব করা যথেষ্ট অস্বাভাবিক লেগেছিল আমার।
প্রায় দৌড়তে দৌড়তে ইমার্জেন্সি রুমে পৌঁছে দেখি একজন পেশেন্টের ড্রেসিং সমাপ্ত, অন্য আরেকজনের মাথায় অভ্যস্ত হাতে স্টিচ করছেন ডঃ ব্যানার্জি। দুই পেশেন্টই সজ্ঞান এবং আপাতদৃষ্টিতে স্থিতিশীল বলে মনে হলো আমার। নিশ্চিন্ত হয়ে স্যারের দিকে চাইতে উনি স্টিচ করতে করতেই বিপন্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন — ”ওঃ, তুমি এসে গেছো! যাক, বাঁচালে”!
বিমূঢ় প্রশ্ন রাখি —“কেন স্যার, আপনি তো ট্রিটমেন্ট কমপ্লিট করেই এনেছেন — আবার ওটিতে নিয়ে যেতে হবে নাকি?”
স্যার অসহিষ্ণু হয়ে বলে ওঠেন —“আরে না না, ধুর, চিকিৎসার জন্য তোমাকে থোড়াই ডেকেছি? ইংরেজি বলার জন্য ডাকলাম। শিগগির শিগগির জিজ্ঞেস টিজ্ঞেস করে ইনজুরি রিপোর্টটা লিখে ফেলো তো! ব্যাটারা কি বলছে, বিন্দুবিসর্গও বোধগম্য হচ্ছে না। তোমার তো শুনেছি ইংলিশ মিডিয়াম — লেগে পড়ো, শিগগির শিগগির লেগে পড়ো” —
স্তম্ভিত হয়ে মুখ ফিরিয়ে দুর্ঘটনাগ্রস্ত রোগীদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, দুই ব্যান্ডেজবদ্ধ স্বর্ণকেশ শ্বেতাঙ্গ অত্যন্ত করুণ, মিনতিপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রয়েছে।
পরিশেষে মার্ক টোয়েনের দু’টি লাইন দিয়ে দীর্ঘ, ক্লান্তিকর হাস্যপ্রচেষ্টার ইতি টানি —
Everything human is pathetic. The secret source of humor itself is not joy but sorrow. There is no humor in heaven.