পুজো শেষ হলো। মহালয়ার সাতসকালে মাইকে তারস্বরে মাইকে মহিষাসুর-মর্দিনী দিয়ে শুরু, তার পর দুর্গাপুজো – এমনকি লক্ষ্মীপুজো-ও, যাতে নাকি জোরে শব্দ নিষেধ – কালীপুজো, কার্তিকপুজো, ছটপুজো – মাঝে ভাসান-বিসর্জন তো আছেই, শব্দবাজি থুড়ি গ্রিন ক্র্যাকার-এর কথা না হয় বাদ-ই দিলাম – সবকিছুরই অনিবার্য অনুষঙ্গ যে মাইক, তারা আপাতত একটু বিশ্রামে। তবে এ বিশ্রাম নেহাতই তাৎক্ষণিক। সারাবছর কত উপলক্ষই তো আছে। জলসা – সে জলসা সন্ধেয় হলেও সারাদিন ধরে মাইকে জানান দেওয়া আছে – রক্তদান শিবির, অমুকের অনুপ্রেরণায় নতুন অটো রুট চালু হলো, সে বাবদে অনুষ্ঠান, পাড়ার রাস্তা সারাই হলো, সে রাস্তা দেখতে আসবেন স্থানীয় কাউন্সিলর, সে বাবদে অনুষ্ঠান, এরকম আরও কতো! কমন ফ্যাক্টর বলে যদি কিছু থাকে, সে ওই মাইক-ই।
এক বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাদের পাড়ার ক্লাবের সহৃদয় সদস্যবৃন্দ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালের ধারাভাষ্যটিও মাইকে চালিয়ে রেখেছিলেন, যাতে কেউ অযথা বঞ্চিত না হন।
না, শুধুই শব্দদূষণ ও তার বিপদ নিয়ে লিখতে বসিনি। সে বিপদের কথা সবাই জানেন, কেউ কেউ ইশকুল-জীবনে ও নিয়ে বাংলায় রচনাও লিখেছেন, আর বাড়িতে অসুস্থ মানুষ যদি কেউ থাকেন, তাহলে সমস্যাটা শুধু তাত্ত্বিকভাবে নয়, একেবারে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন।
এসব কথা বলতে গেলে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বা উচ্চ-মধ্যবিত্তদের একাংশ বলে থাকেন, এই চড়া মাইক বাজানোর প্রবণতা মূলত নিম্নবর্গের লোকজনের – যাঁদের সম্বন্ধে তথাকথিত সমাজসচেতন মানুষও অশিক্ষিত ছোটলোক বস্তির কালচার জাতীয় শব্দবন্ধ ব্যবহার করে থাকেন – কিন্তু তাঁরা নিজেদের মুখ আয়নায় দেখেন কি? চাইলে তাঁরা দেখতে পেতেন, উচ্চ-মধ্যবিত্ত আবাসনেও মাইক বাজানোর প্রবণতা কিছু কম নয়। পুজোর মন্ত্রোচ্চারণই হোক বা ঢাক বাজানো, কোনও কিছুই মাইক ছাড়া চলে না। উৎসব-পার্বণে দিনভর গান তো আছেই, পাড়ার ক্লাবের গুরুদক্ষিণা-র জায়গায় হাউজিং-এ রবীন্দ্রসঙ্গীত বা পান্নালাল, কিন্তু মাইক ব্যাপারটা কমন – কারণে-অকারণে ‘ঘোষণা’ তো সর্বত্রগামী, পাড়ার ক্লাবের তুলনায় শালীন উচ্চারণ হলেও হাউজিং-এ উচ্চকিত ঘোষণা কি কম বিরক্তিকর?
শুধু এরকম সর্বজনীন অনুষ্ঠানই নয়, একান্ত ব্যক্তিগত বা পারিবারিক অনুষ্ঠানেও ইদানীং মাইক বাজানোর চল। নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলি। যে ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকি, তার উপরের দিকে একটি ফ্ল্যাটের মালিক জনৈক অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। তিনি এমনিতে এই ফ্ল্যাটে থাকেন না, কিন্তু স্ত্রীর প্রয়াণের দিনটিতে, নিয়মিতভাবেই, একটি বাৎসরিক শান্তি-স্বস্ত্যয়ন-শোকজ্ঞাপন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন, এবং সেই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন খ্যাতিমান ব্যক্তিও আমন্ত্রিত হতেন। সম্ভবত স্ত্রীর প্রয়াণে প্রফেসরসাহেব যে কতখানি শোকাহত, তা বাকিদের মাথায় গজাল মেরে গোঁজানোর উদগ্র বাসনায়ই, ওইদিন করিডোরে সাউন্ডবক্স লাগিয়ে সকলকে তারস্বরে ভজন-কীর্তন শোনানোর ব্যবস্থা থাকত। প্যাকেজটা ছিল আমাদের বার্ষিক আতঙ্কের দিন। এরকম এক শোকোৎসবের দিন আমার দেড় বছরের ছেলের ধূমজ্বর। উচ্চকিত কীর্তনের শব্দ প্রয়াত ভদ্রমহিলার বিদেহী আত্মাকে শান্তি দিচ্ছে কিনা জানি না, কিন্তু পুরো ফ্ল্যাটবাড়ি থরথর করে কাঁপছে, আমার ছেলেটিও শব্দের চোটে কেঁপে কেঁপে উঠছে। আয়োজকের কাছে মাইক বন্ধের আর্জি পেশ করলাম, হাউজিং সোসাইটির হোমরাচোমরাদের ফোনে অনুরোধ করলাম, কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা! শেষমেশ এখুনি থানায় জানাতে চললাম বলায় মাইক থামল, কিন্তু প্রফেসরসাহেব তো বটেই, প্রতিবেশীদের মধ্যে যাঁরা সেদিন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন, তাঁরা, অনেকদিন অবধি, আমাকে দেখলেই মুখটা থমথমে করে রাখতেন।
তো পরিস্থিতি এই। কারণে-অকারণে মাইক বাজানোর কুঅভ্যেস স্রেফ হিমশৈলের চূড়া মাত্র, মূল সমস্যা হলো প্রবণতা। সরকার কেন কিছু করছে না, এ কথা যাঁরা বলবেন, তাঁদের মনে করিয়ে দেওয়া ভালো, পাব্লিক সে সরকারই পায়, যা তারা ডিজার্ভ করে এবং সামাজিক সংস্কৃতি (বা অপসংস্কৃতি) রাতারাতি বদলে দেওয়ার সাধ্য, খুব সিরিয়াসলি জনকল্যাণমুখী সরকার না হলে, সব সরকারের থাকে না। সত্যিটা হলো, চড়া শব্দ আমাদের সামাজিক কুঅভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের যাবতীয় উদযাপন উচ্চকিত না হলে হয় না, আমাদের শোক-আবেগ-আনন্দের প্রকাশ সশব্দ ও উচ্চকিত না হলে চলে না। এবং এ বাবদে আমাদের দ্বিচারিতাও কিছু কম নয়। পুত্রশোকগ্রস্ত মা বুক চাপড়ে কাঁদলে তা আমাদের চোখে গ্রাম্যতা, কিন্তু শ্রাদ্ধে মাইক চালিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ শোনানোটা অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না। জোরে জোরে লারেলাপ্পা চললে তা দেখে নাক কুঁচকালেও মাইকে তারস্বরে রবীন্দ্রসঙ্গীত চললে তার প্রতিবাদ করতে পারি না, পাছে কেউ আনকালচারড ভেবে বসেন!!
আসলে সমস্যা তো আরও গভীরে। অদৃশ্য মাইক আমাদের নিত্যসঙ্গী। চড়া সুরে কথা বলা ও শোনাটাই আমাদের অভ্যেস হয়ে গেছে। দুর্ঘটনায় পঞ্চাশজনের মৃত্যুর খবর বা ক্রিকেটম্যাচে ভারতের জয়, সংবাদপাঠক ঠিক কোন পর্দায় খবরটি শোনান? সোশ্যাল মিডিয়ার কমেন্টবক্সে মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য ঠিক কোন পর্দায় বাঁধা থাকে? আনন্দ বা বিষাদ, খুশি বা ক্রোধ – অনুভূতি ভিন্ন হলেও, প্রকাশের সুর কি একইরকম চড়া নয়? কিন্তু এই প্রবণতা শুধুই বিরক্তিকর? শব্দদূষণের বাইরেও এমন প্রবণতার কি কোনও দীর্ঘমেয়াদি বিপদ-ই নেই?
চড়া আওয়াজের মধ্যে অনেকদিন থাকলে মানুষ বধির হয়ে যান। তখন তিনি চড়া বা সূক্ষ্ম, কোনও শব্দই আর ঠিক করে শুনতে পান না। সেরকমই, চড়াসুরে আবেগের প্রকাশ শুনতে শুনতে, একদিন, মানুষ কি অপরের আনন্দ-দুঃখ-ভালোবাসায় নিরুত্তাপ হয়ে যাবে? এমনকি, হয়ত, নিজের আবেগ বিষয়েও?