অনেক দিন আগের কথা। অনেক, অনেক দিন আগের কথা। তখনও আকাশে দিনে সূর্য উঠত, রাতে চাঁদ। কিন্তু আকাশে তারা ছিল না। চাঁদ না থাকলে রাতের আকাশ থাকত কালো। অন্ধকার।
সাগরপারে একটা গ্রাম ছিল। গ্রামের সবাই জেলে। বুটুর বাবাও জেলে। যায় মাছ ধরতে। বুটু বাড়িতে থাকে। মা’র সঙ্গে। ঘরের কাজ করে। ঝাঁট দেওয়া, বাসন মাজা, রান্না করা। গ্রামের ছেলেরা পড়াশোনা করতে পাঠশালা যায়। মেয়েরা একটু পড়াশোনা শেখে মায়েদের কাছে। শেখে রান্নাবান্না, ঘরকন্না।
বুটুও শেখে। বুটুর ভাই নেই। বাবা ওকে মাছ ধরাও শেখাতে চায়। মা বলে, দরকার নেই। বুটু মাছ ধরবে? তাও বাবা ওকে জাল বানাতে, মাছ ধরতে শেখায়। মাঝে মাঝে সমুদ্রে নিয়ে যায়।
বুটুর বোনও নেই। মা ওকে ঘরের কাজ শেখায়।
সেবার বুটুর মা’র বৃষ্টিতে ভিজে সর্দি হল। জ্বর। কাশি। গ্রামের বদ্যি ওষুধ দিল। বলল, বুকে গরম আটার পুলটিশ দিতে। গরম মধু খাওয়াতে।
সারল না। জ্বর বাড়ল। বুটু পাশে বসে জলপটি দিল। বাবা গেল মাছ ধরতে।
বাবা ফিরে এল। গ্রামের লোক ভীড় করে আছে বুটুর বাড়িতে। বুটু কাঁদছে। মা মরে গেছে।
– দুই –
বুটুকে বাবা একা রেখে সাগরে যায় না। নিয়ে যায়। বারণ করার কেউ নেই। বুটু মাছ ধরা শেখে। জাল বানানো, জালের ফুটো সারানো, মাছের পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি দিয়ে টোপ তৈরি করা। সকাল থেকে বাবা-মেয়ে বেরিয়ে পড়ে।
গ্রামের ছেলেরা হাসে। ওদের মতো মাছ ধরছে একটা মেয়ে। হাঃ, হাঃ, হাঃ।
কিন্তু তারপরে হাসি বন্ধ হয়ে গেল। বুটু মাছ ধরা, জাল বানানো শিখে নিল। তারপর শিখতে শুরু করল নৌকো চালানো। ছোটো ছোটো হাতে দাঁড় টানতে পারে না। কিন্তু হাল ধরতে শিখছে। রোজ অনেক মাছ নিয়ে ফেরে। গ্রামের ছেলেরা বলে, কেউ বিয়ে করবে না তোকে। বুটু বলে, আমিই বিয়ে করব না তোদের কাউকে। বয়ে গেছে।
সেবার বর্ষার আগে প্রবল ঝড় হচ্ছে। গ্রামের লোকে নৌকো নিয়ে সাগরে যেতে ভয় পাচ্ছে। বুটুর বাবা বলল, একবার যাই। চল। আবার কবে যেতে পারব তো জানি না…
দুজনে বেরোল নৌকোয়। সমুদ্র উত্তাল। বড়ো-বড়ো ঢেউ। বুটুর একটু ভয় ভয় করছে। কিন্তু বাবা রয়েছে, ভয় কী? কয়েকটা মাছ ধরে বাবা বলল, এবারে ফেরা উচিত। নৌকোর মুখ ঘোরাল গ্রামের দিকে।
কিন্তু নৌকো চলে না। ঢেউ টেনে নিয়ে যায় বা’র সাগরে। দাঁড় টেনে টেনে বাবা ক্লান্ত। সন্ধে হয়। দূরের আকাশের লাল মেঘ ছুটে আসে ঝড় হয়ে। ঝড় না থামলে ফেরা যাবে না। নৌকোর মধ্যে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ে ক্লান্ত বুটু। বাবা লড়ে চলেছে সমুদ্রের সঙ্গে। আকাশছোঁয়া ঢেউয়ের ওপর খোলামকুচির মতো নৌকোটা ভাসতে-ভাসতে, উঠতে-নামতে, কাত হয়ে-সোজা হয়ে আরও আরও দূরে চলে যেতে থাকে…
– তিন –
সকালে বুটুর ঘুম ভাঙল। ঝড় নেই। নৌকোটা একটা ছোট্ট দ্বীপের সমুদ্রতীরে বালিতে এসে আটকেছে। আকাশ নীল। সাদা মেঘ। সাদা ঢেউ হলুদ বালিতে আছড়ে পড়ছে। বাবা শুয়ে আছে নৌকোয়। চোখ বন্ধ।
বুটু ডাকল, বাবা, ডাঙায় এসে গেছি আমরা। গ্রাম কি এখান থেকে অনেক দূর?
বাবা উত্তর দিল না।
বুটু আবার ডাকল। সাড়া নেই।
বুটু চিৎকার করে ডাকল, ধাক্কা দিল। বাবা চোখ খুলল না।
দ্বীপে থাকত একটা রাক্ষস। পাহাড়ের গুহায় ঘুমোচ্ছিল। বুটুর চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙল। গুহা থেকে বেরিয়ে সাগরপাড়ে এল। দুপ দুপ করে পা ফেলে, মাটি কাঁপিয়ে।
কী বিশাল উঁচু! যেন পাহাড়ের মতো। কী ভয়ানক দেখতে! বুটু ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। কিন্তু রাক্ষসটা কাছে এসে মিষ্টি হাসল। কী হয়েছে?
বাবা কথা বলছে না।
রাক্ষস ঝুঁকে দেখল। তারপরে বুটুর দিকে তাকাল। আর হাসছে না। বলল, তোমার বাবা তো আর নেই। মরে গেছে।
বুটুর মনে পড়ল, এক দিন ওর মা মরে গিয়েছিল। চোখ জলে ভরে এল।
রাক্ষস ওকে হাতে তুলে নিল। বলল, চলো। আগে আমার ঘরে চলো। পরে ফিরে আসব।
গুহায় বুটুকে খেতে দিল রাক্ষস। জল, দুধ, ফল-মূল। তারপরে বুটুকে নিয়ে ফিরে এল সাগরপারে। জানতে চাইল, ওদের গ্রামে কেউ মারা গেলে কী করে? বুটু বাবাকে প্রথমে সমুদ্রের জলে চান করাল। তারপরে রাক্ষস আর ও ধরাধরি করে নৌকোয় টানটান করে শুইয়ে দিল। জঙ্গল থেকে দুজনে নিয়ে এল শুকনো কাঠ। নৌকোয় রাখল সাজিয়ে। বুটুকে কাঁধে নিয়ে রাক্ষস নৌকোটাকে টেনে টেনে নিয়ে গেল সমুদ্রের মধ্যে অনেকখানি। চকমকি পাথর দিয়ে ঠুকে ঠুকে আগুন জ্বালিয়ে দিল। তারপরে আবার তীরে ফিরে এসে দুজনে দেখল কেমন করে নৌকোটা জ্বলে জ্বলে আস্তে আস্তে সাগরে মিশে গেল।
কাঁধ থেকে বুটুকে নামিয়ে রাক্ষস জানতে চাইল ওর গ্রাম কোথায়? কত দূর? কী করে যেতে হয়?
বুটু জানে না। রাক্ষস বলল, চলো, খুঁজে দেখি।
বুটু মাথা নাড়ল। গ্রামে ওর কেউ নেই। বাবার নৌকোটাও নেই। কী করবে গিয়ে?
বলল ও রাক্ষসের সঙ্গেই থাকবে। রাক্ষসের দেখাশোনা করবে। ঘর সাফ করবে। বাসন মাজবে। মাছ ধরবে। রান্না করে দেবে।
রাক্ষস হাসল। ও রান্না করা খাবার খায় না। কাঁচা খায়। ঘরদোর ও-ই সাফ করে। মানুষ লাগবে না।
বুটু বলল, রাক্ষস মরে গেলে ওকেও অমন আগুন-জ্বলা নৌকোয় ভাসিয়ে দেবে, বাবার মত। রাক্ষস আবার হাসল। বলল না, রাক্ষসরা বাঁচে অনেকদিন। বুটু বড়ো হবে। বুড়ো হবে। মরে যাবে। রাক্ষস তখনও থাকবে।
তারপরে ভাবল, ও-ও একা, বুটুও একা। থাক।
বুটু থেকে গেল।
– চার –
বুটু রাক্ষসের গুহায় থাকে। দুজনে গুহা পরিষ্কার করে। দুজনেই ফলমূল কুড়িয়ে আনে। দুজনে মিলে রাক্ষসের ক্ষেত-খামার দেখাশোনা করে। বুটু রান্না করে। নিজের জন্য। রাক্ষস কাঁচা খায়। রাক্ষস বুটুকে একটা নৌকো বানিয়ে দিয়েছে। বুটু বাবার জালটা রেখে দিয়েছিল। সেটা নিয়ে মাছ ধরে। বুটু মাছ রান্না করে। একাই খায়। রাক্ষস খায় না। নিরামিষ খায়। বলে, মাছ-মাংস ভালো লাগে না।
বুটুকে রাক্ষস লেখাপড়া শেখায়। রাক্ষসরা অনেক কিছু জানে। ওরা মানুষের চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞানী। পৃথিবী সম্বন্ধে, সমুদ্র সম্বন্ধে, আকাশ সম্বন্ধে…
বুটু জানতে চায় রাতের আকাশ এত অন্ধকার কেন?
রাক্ষস বলে, চাঁদ থাকলে আলো থাকে।
বুটু বলে চাঁদ রোজ থাকে না। অনেক দিন এক চিলতে নখের মতো থাকে। আলোই দেখা যায় না।
রাক্ষস বলে, দিনে রাতে সূর্য থাকলে ঘুমনো দায় হবে।
বুটু বলে, রাতে সূর্য লাগবে না। সাগরতীরের বালির দিকে দেখায়। ওরকম চিকমিকে ছোটো ছোটো আলো থাকলেই হবে।
রাক্ষস হাসে। ওগুলো অভ্র আর স্ফটিক। রোদ পড়লে চিকচিক করে। পাহাড়ি নদীর জলে ধুয়ে ধুয়ে নেমে আসে সাগরপাড়ে।
বুটু বলল, ওগুলো নিয়ে গুহায় গেলে আলো জ্বলবে রাতে।
রাক্ষস এবারে খুব হাসল। জ্বলবে না। ওগুলোতে আলো না পড়লে জ্বলে না।
বুটু মানল না। সারা দিন ধরে ছোটো বড়ো স্ফটিক আর অভ্রর টুকরো তুলে আনল থলে করে। রাতে থলে খুলে ভাবল অন্ধকার গুহায় আলো হবে। হলো না। মন খারাপ করে বসে রইল বুটু।
পরদিন রাক্ষস একটা বড়ো ঝোপ তুলে আনল জঙ্গল থেকে। গুহার মুখে গর্ত করে পুঁতে দিল। জোনাকির আলোয় সেদিন থেকে ওদের গুহায় রাতে আলোর অভাব নেই।
বুটু অবশ্য অভ্র আর স্ফটিক কুড়োনো থামাল না। ওর ছোটো থলেটা ভরে গেলে রাক্ষস ওকে একটা মস্তো থলে এনে দিল। কখনও সূর্য যখন বিকেলে হেলে পড়ে বুটু স্ফটিক আর অভ্রের টুকরোগুলো গুহার সামনে রেখে দেয়। পড়ন্ত আলোয় ঝকঝক করে – বুটু বলে, এগুলো আমার চিকমিক। এমন যদি আকাশে থাকত?
রাক্ষস হাসে।
– পাঁচ –
সেদিন রাতে আবার ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু সূর্য উঠেছে পরিষ্কার আকাশে। ভোরবেলা বুটুর ঘুম ভেঙে মন কেমন করছিল। এমন একটা ভোরবেলা ওর বাবা মরে গেছিল। মন কেমন কমানোর জন্য চুপিচুপি, রাক্ষসকে না জাগিয়ে বুটু বেরিয়ে গেল সমুদ্রের ধারে। ছোটো থলেতে অভ্র ভরে নিয়ে আসতে।
ঝড়ে এক রাজপুত্রের জাহাজ পথ হারিয়ে ভেসে এসেছে দ্বীপের কাছে। সকালের আলোয় দ্বীপ দেখে রাজপুত্রের ইচ্ছে হয়েছে সাগরপাড়ের বালিতে চড়ুইভাতি করবে। নৌকো নেমেছে জাহাজ থেকে।
বুটু দেখেনি। ওর নজর বালির দিকে।
নৌকোয় করে দ্বীপের দিকে যেতে যেতে রাজপুত্র দেখে, আরে, কী সুন্দর একটা মেয়ে! নাবিকদের বলল মেয়েটাকে ধরে দেশে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করবে।
আস্তে আস্তে নৌকো গেল পাড়ে। সৈন্য-সামন্তরা চুপিচুপি পেছন থেকে বুটুকে চেপে ধরেছে নিয়ে যাবে বলে।
পরিত্রাহী চিৎকার করে উঠেছে বুটু।
রাক্ষসের ঘুম ভেঙে গেছে। দেখে কতগুলো লোক বুটুকে ধরে টানাটানি করছে। রাগে গর্জন করেছে রাক্ষস।
শুনে রাজপুত্র আর ওর লোকজনের মুখ শুকিয়ে গেছে।
গুহা থেকে বেরিয়ে এসেছে রাক্ষস। লাফিয়ে লাফিয়ে আসছে বুটুকে বাঁচাতে।
দেখে সবাই বুটুকে ছেড়ে পালিয়েছে নৌকোয়, হুড়মুড়িয়ে দাঁড় টেনেছে জাহাজের দিকে।
রাক্ষস বুটুকে তুলে নিয়েছে কোলে। বুটু বলছে, ওদের ধরো। রাক্ষস আবার গর্জন করেছে। ওরা প্রাণপনে দাঁড় টেনে জাহাজে পৌঁছে পাল তুলে দিয়েছে।
বুটু অবাক হয়ে জানতে চাইল রাক্ষস কেন ওদের তাড়া করল না? কেন জাহাজটা ডুবিয়ে দিল না?
রাক্ষসরা ঝগড়া মারামারি পছন্দ করে না।
অবাক হয়ে বুটু বলল, ওরা ফিরে আসবে তো!
রাক্ষস হাসল। ওরা এত ভয় পেয়েছে, যে আসবেই না।
রাক্ষস ঠিক বলেনি। ভয় রাজপুত্র পেয়েছিল। কিন্তু দেশে ফিরে নৌবহর তৈরি করতে বলল। বলল, অনেক কামান আর গোলা নিতে।
একদিন, অনেক রাতে, রাজপুত্র ফিরে এল। সমুদ্র থেকেই গোলা মারল তীর লক্ষ করে।
আকাশে চাঁদ ছিল না। ঘোর অন্ধকার। কামানের শব্দে ঘুম ভাঙল রাক্ষস আর বুটুর। গুহার মুখে দাঁড়িয়ে দেখল অন্ধকারের মধ্যে আগুনের ঝলক।
রাক্ষস বলল, ওটা কামান।
বুটু বলল, ওটা রাজপুত্র।
রাক্ষস বলল ও লড়াই করবে না।
বুটু বলল, চলো পালাই।
রাক্ষস বলল, আমার কাঁধে চড়ে বসো।
বুটু বলল, কোথায় যাবে?
রাক্ষস বলল, দূরে। রাজপুত্র চলে গেলে ফিরব।
বুটু বলল, অনেক দিনের জন্য যাব?
রাক্ষস বলল, হতেও পারে।
বুটু বলল, অভ্রের থলেটা নিয়ে যাব?
রাক্ষস বলল, নিয়ে এসো।
বুটু অভ্রের থলে নিয়ে রাক্ষসের কাঁধে চড়ে বসল। রাক্ষস পাহাড়ের মাথায় উঠল। এক লাফে উঠে গেল অনেক ওপরে। অন্ধকারে রাজপুত্র দেখতেই পেল না। মন্ত্রবলে রাক্ষসরা উড়তে পারে। উড়তে উড়তে অনেক ওপরে চলে গেল। দ্বীপ থেকে অনেক দূরে।
সারা রাত কামান চালিয়েও কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে সকালে রাজপুত্র লোক পাঠাল দ্বীপে। ওরা ফিরে বলল, কেউ কোত্থাও নেই। রাজপুত্র গিয়ে দেখল সব ফাঁকা।
ফিরে গেল দেশে।
– ছয় –
উড়তে উড়তে বুটুর ঘুম পাচ্ছিল। ঢুলতে শুরু করল। রাক্ষস ধরে রইল ওকে। বুটু ঘুমিয়ে পড়ল।
হাতের মুঠো আলগা হয়ে গেল। থলের মুখ খুলে অভ্র আর স্ফটিক ছড়িয়ে গেল সারা আকাশে।
ঘুম থেকে উঠে বুটু বলল, কোথায় এসেছি?
রাক্ষস বলল, চাঁদে। এখন এখানেই থাকব। কেউ জ্বালাতন করবে না।
বুটু আকাশের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল, এ কী! আকাশে ওগুলো কী? চিকমিক করছে!
রাক্ষস হেসে বলল, ওগুলো তোমার অভ্র আর স্ফটিক। ঘুমের মধ্যে আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে। সূর্যের আলোয় চিকমিক করছে।
বুটুও হেসে বলল, অভ্রও না, স্ফটিকও না। ওগুলোর নাম এখন তারা।
– সাত –
ওরা এখনও থাকে চাঁদে। রাতের আকাশে গোল চাঁদ উঠলে দেখা যায় ওদের ছায়া। আর বুটুর থলেভর্তি অভ্র আর স্ফটিক-ই আজ আকাশভরা তারা।