উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর অকৃতকার্য, বঞ্চিত ও তেজী ছাত্র-ছাত্রীরা রাস্তা অবরোধ ও নানা রকম আন্দোলন করেছিলেন। সেখানে সাংবাদিকরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে তাঁদের পরীক্ষা নিতে চেয়েছেন। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের প্রশ্ন ছিল ইংরাজি বিষয়ে। সোশ্যাল মিডিয়ায় যে কটি ভিডিও আমি দেখেছি সবেতেই ইংরাজির প্রশ্ন। পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, অংক, ইতিহাস, ভূগোল, সমাজ বিজ্ঞান, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ে কোনো প্রশ্ন নেই।
এইটা আমার খুব অবাক লেগেছে। এ রাজ্যে বাঙালীরা কি তাহলে অধিকাংশ ইংরাজিতেই ফেল করে। যদি তাই হয়, তাহলে এটা নিয়ে উচ্চপর্যায়ের গবেষণা করা দরকার। কেন একজন অংক বা রসায়নের মতো বিষয়ে পাশ করে যাচ্ছে। এমনকি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে লেটার পাচ্ছে। কিন্তু একটি ভাষার পরীক্ষায় পাশ করতে পারছে না। অথচ সে ভাষায় তাঁরা সারাক্ষণ ‘ম্যাসেজ করছেন’, বাঙলাতে কথা বলার সময়েও সে ভাষার শব্দ তাঁরা আকচার গুঁজে দিচ্ছেন। তাহলে কি শেক্সপিয়ারের মতো বা নিদেন পক্ষে চেতন ভগতের মতো ইংরাজি না জানলে উচ্চমাধ্যমিকে ইংরাজিতে পাশ করা যাবে না?
আমি ভাইরাল হওয়া ভিডিওগুলি দেখেছি। এবং অনেক বার বিষম খেয়েছি। ফেল করলে আমরা লজ্জা পেতাম, কিন্তু এযুগের ছেলে মেয়েরা সে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠেছেন। তাঁরা ফেল করার পরেও নিজেদের ভাবমূর্তির ব্যাপারে ন্যুনতম চিন্তা না করে রাস্তায় বসেছেন এবং নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য প্রাণপণ লড়াই করছেন। আমি যে তাঁদের বিপ্লবী অভিনন্দন জানাতে পারছি না, সেটা আমারই দুর্বলতা। কারণ আমি এখনও মধ্যবিত্ত মানসিকতা থেকে বেরোতে পারিনি।
ভিডিওগুলি দেখে কার কী কাজ সব গুলিয়ে গেছে। পুলিশদের দেখে মনে হচ্ছে তাঁরা প্রাতঃভ্রমণে বেড়িয়েছেন। মুগ্ধ চোখে সব চেয়ে চেয়ে দেখছেন। সাংবাদিকদের দেখে মনে হচ্ছে তাঁরা ইংরাজির শিক্ষক। যাকে যা পারছেন ইংরাজি বানান জিজ্ঞাসা করছেন। মেয়েটির আমব্রেলা বানান নিয়ে অনেকেই খিল্লি করছেন। কিন্তু আমার খিল্লি করার সাহস হয়নি। ওভাবে ক্যামেরার সামনে আমব্রেলা বানান হঠাৎ করে জিগ্যেস করলে আমিও ঠিকঠাক বলতে পারতাম কিনা সন্দেহ আছে।
তবে চিকিৎসক হিসাবে একটা বিষয়ে আমি খুবই অবাক হয়েছি। ফেল করা ছাত্রছাত্রীদের অধিকাংশই অত্যন্ত স্বাস্থ্য সচেতন। তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই মাস্ক পরে ছিলেন। বরঞ্চ ভালো ফলাফল করা ছেলেমেয়েরা প্রায় প্রত্যেকেই মাস্ক ছাড়াই মিডিয়াতে মুখ দেখিয়েছেন। অথচ বিষয়টা উল্টো হওয়াই স্বাভাবিক ছিল।
তবে আমি বুদ্ধিজীবী নই। বরঞ্চ বেশিরভাগ মানুষের চাইতে আমার বুদ্ধি আশংকাজনক কম। তাই এই সব বিতর্কিত ব্যাপারে আমার মতামতের কোনো দাম নেই। মতামত দিয়েও লাভ নেই। কারণ পরের বছর আবার কিছু ছাত্রছাত্রী ফেল করবেন। তাঁরা আবার রাস্তা অবরোধ করবেন। সাংবাদিকরা আবার তাঁদের ওরাংওটাং ইংরাজি বানান সহ জিগ্যেস করবেন। কিছু বুদ্ধিমান মানুষ তাই নিয়ে খিল্লি করবেন। গরমকালে আবার গরম পড়বে। এবং গরমের ছুটি দু মাস থেকে বাড়িয়ে আড়াই মাস করে দেওয়া হবে।
বরঞ্চ আমি যেটা পারি সেটাই করি। আমি গল্প শোনাতে পারি। তবে বানানো গল্প নয়। সে ক্ষমতা আমার নেই। আমি টুকে গল্প লিখি। প্রতিদিন যা দেখি সেসবই টোকাটুকি করে গল্প বলে চালাই। তেমন কিছু গল্প আপনাদের শোনাই। বানানের গল্প- ইংরাজি ও বাংলার।
পানিহাটি হাসপাতালে প্রথম সময়টা বেশ ভালোই কাটছিল। আমি আর ডা. কুণ্ডু ছিলাম মেডিসিন বিভাগে। আমি সদ্য এম ডি পাশ করে এসেছি। অভিজ্ঞতা কম। আর ওদিকে কুণ্ডু স্যারকে অভিজ্ঞতার অ্যাটলান্টিকও বলা চলে। তিনি একাধিক ডিস্ট্রিক্ট হাসপাতালে মেডিসিন বিভাগ সামলে এসেছেন। পানিহাটির মতো হাসপাতাল সামলানো তাঁর বাঁ হাতের কাজ।
ফলে আমি একেবারে নির্ভয়ে ডিউটি করছিলাম। মাথার উপর ছাতার মতো কুণ্ডু স্যার রয়েছেন। তাঁর কাছ থেকে যতটা পারা যায় শিখছিলাম। দুজন থাকায় ডিউটি করতাম অনেক আরামে। আউটডোরের দিন শুধু আউটডোরের রোগী দেখলেই হতো। বারবার ইন্ডোরে কলবুক খেয়ে দৌড়াতে হতো না।
প্রথমদিকে মেডিসিন আউটডোরে আমাকে রোগীরা বিশেষ ভরসা করতেন না। সকলেই ডা. কুণ্ডুকে দেখাতে চাইতেন। আমার কাছে দেখাতে আসত স্কুল পালানো ছেলেমেয়েরা। তাদের সাথেই গল্প করতাম। তাছাড়া এন সি সি বা বিভিন্ন কারণে মেডিকেল ফিটনেস সার্টিফিকেট নিতে অনেক ছাত্রছাত্রী আসত। হাসি মুখেই তাদের দাবী মেটাতাম।
তবে আমাদের সুখ বেশিদিন উপরমহলের সহ্য হল না। কোনো কারণ ছাড়াই ডা কুণ্ডুকে আরেক জায়গায় ট্রান্সফার করা হলো এবং বারবার ট্রান্সফার হতে হতে তিতিবিরক্ত হয়ে উনি চাকরি ছাড়লেন। বারাসাত হাসপাতাল থেকে একজন ফিজিশিয়নকে আমাদের হাসপাতালে দেওয়া হলো। তিনিও রেগে মেগে চাকরি ছেড়ে দিলেন।
আমি একা পড়ে রইলাম পানিহাটি হাসপাতালে এবং অথৈ জলে পড়লাম। আউটডোরের রোগীর সংখ্যা এক ধাক্কায় বেড়ে চারশো ছাড়ালো। ছাত্র- ছাত্রীদের মধ্যে আমার জনপ্রিয়তা নিয়ে আমি বেশ আনন্দিত ছিলাম। সেই জনপ্রিয়তা আমার গলার কাঁটা হয়ে উঠল।
তারা আগের মতোই আসে। পেটে ব্যথার ওষুধ চায়, সর্দি কাশির ওষুধ চায়। আমি তিতিবিরক্ত হয়ে একটি ছেলেকে বললাম, ‘পেটে ব্যথার ওষুধ দেব। আগে পেট ইংরাজি বল।’
ছেলেটি কিছুক্ষণ চুপ করে বলল, ‘ডাক্তারবাবু, কার পেট- ছেলেদের না মেয়েদের?’
আমি চমকে গেলাম। মেয়েদের পেটের আবার আলাদা ইংরাজি আছে নাকি?
ছেলেটি আবার বলল, ‘স্যার, মেয়েরা পেট নাচালে তাঁকে বলা হয় বেলি ড্যান্স। তাই মেয়েদের পেটের ইংরাজি বেলি। আর ড্যান্স হলো ইয়ে… নাচ।‘
ছেলেটিকে আর ঘাঁটাতে সাহস পেলাম না। তবে আমি হাল ছাড়লাম না। এন সি সি’র জন্য মেডিকেল সার্টিফিকেট নিতে আসা একজনকে বললাম, ‘করে দেবো। আগে এন সি সি-এর পুরোটা বল।‘
বেচারা দু- চারবার ‘ন্যাশনাল… ন্যাশনাল’ বলেই তুতলে গেল। বললাম, ‘এন সি সি’র পুরো কথা শিখে আসবি। তারপর সার্টিফিকেট পাবি। ‘
এভাবে পড়া ধরা শুরু করায় আস্তে আস্তে আমার কমবয়সী রোগীর সংখ্যা কমে গেল। তবে আমি শুধু ইংরাজি ধরতাম না। বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল সব ধরতাম। প্রথম শ্রেণীর লিভার আর তৃতীয় শ্রেণীর লিভারের পার্থক্য, নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র, পানিপথের প্রথম যুদ্ধের সাল, অরুণাচল প্রদেশের রাজধানীর নাম – রীতিমতো পড়াশুনো করে আউটডোরে যেতাম। ফলে আমার টেবিলে ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড় কমতে থাকল আর আমার উল্টোদিকে কে এল সি স্যারের সামনে ভিড় বাড়তে থাকল।
এবার একটু বাংলায় ফিরে আসি। এক যুগ আগের কথা। তখন খড়গ্রাম হাসপাতালে চাকরি করি। এক জানুয়ারি মাসের বিকালে পীযূষদার মোটর সাইকেলে নতুন রাস্তা দিয়ে কান্দি যাচ্ছি। মহিষাঢ়ের পরে বাতুরে ভবা পাগলার আশ্রমের সামনে একদল ছেলে মেয়ে রাস্তা আটকালো। সরস্বতী পুজোর চাঁদা চাই।
সরস্বতী পুজোর চাঁদা কেউ চাইলেই নস্টালজিক হয়ে যাই। ছোটো বেলায় সরস্বতী পুজোর চাঁদা চাইতে গেলেই সকলে বানান ধরতেন। প্রথমে সকলেই ধরতেন সরস্বতী বানান। তাছাড়াও অন্যান্য বানানের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল “কুজ্ঝটিকা” আর “কিংকর্তব্যবিমূঢ়” ।
বানান জিগ্যেস না করে সরস্বতী পুজোর চাঁদা দেওয়া অপরাধ। তাই সরস্বতী বানান ধরলাম। বাকি সকলে ঠেলে ঠেলে একটি রোগা ছেলেকে এগিয়ে দিল। সে মাথা নিচু করে মৃদু স্বরে সঠিক বানানটা বলে দিল। এরপর “কুজ্ঝটিকা” বানান আর তার মানেও বলে দিল। “কিংকর্তব্যবিমূঢ়” বানানও ঠিক ঠাক বলল। তারপর একে একে “অভ্যন্তরীণ”, “আয়ত্তাধীন”, “প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব” সব বানান বলে দিল। ছেলেটির মুখে লাজুক হাসি। ধুলোমাখা খালি পা।
দশটাকা চাঁদা নিয়ে গোটা দলটা লাফাতে লাফাতে চলে গেল। আমি অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম।
বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ ছবি নেট থেকে ঝাড়া