‘ডাক্তারবাবু সিজারের সময় কোমরে ইঞ্জেকশন দিয়েছিল। তারপর থেকে আমার কোমরে ব্যথা।’
‘ছেলে হওয়ার পর থেকে মাঝে মাঝেই পিঠে ব্যাথা হয়। মাস দুয়েক ধরে বাড়াবাড়ি হচ্ছে।’
‘সিজারের সময় এত মোটা সূঁচ দিয়েছিল……তার পর থেকে কোমর ব্যাথা আর সারল না।
মেরুদন্ডের সমস্যার চিকিৎসা করি। স্বভাবতঃই, রোগীনী-দের কাছ থেকে এই ধরণের অভিযোগ প্রায়শঃই আমাকে শুনতে হয়। সাধারণ মানুষ তো বটেই, কিছু কিছু চিকিৎসকও এই ভুল ধারণার শিকার।
আপনি বলবেন, ‘ধারণাটা ঠিক না ভুল- তা আপনি জানলেন কি করে?’
সত্যিই তো, আমার একার কথায় তো কিছু প্রমান হয় না। তাই একটা তথ্যমূলক বিশ্লেষণ প্রয়োজন। সেটা করব। তার আগে কিছু সাধারণ জ্ঞানের কথা বলি।
মেরুদন্ডে ইঞ্জেকশন দিয়ে অস্থায়ী ভাবে কোমর ও পা অবশ করে নিয়ে পায়ে, কোমরে এমনকি কখনো কখনো পেটে বা মেরুদন্ডেও অস্ত্রোপচার করা হয়। একে বলে স্পাইনাল অ্যানাস্থেসিয়া। এর সুবিধা হল, এতে রোগীকে পুরো অজ্ঞান করার প্রয়োজন হয় না। পুরো অজ্ঞান করার যে সমস্যাগুলো, বিশেষতঃ শ্বাসযন্ত্রের সমস্যার সম্ভাবনা স্পাইনাল অ্যানাস্থেসিয়ায় অনেক কম থাকে। তবে স্পাইনাল অ্যানাস্থেসিয়া যে একেবারে সমস্যা বা ঝুঁকিবিহীন- তা কিন্তু নয়। পরিস্থিতি বুঝে অজ্ঞান বিশেষজ্ঞ এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন।
এখন কথা হল, স্পাইনাল অ্যানাস্থেসিয়ায় শুধু যে সিজারিয়ান অপারেশন হয় তা-ই নয়, আরো অন্য অনেক অপারেশনই এইভাবে করা হয়।
আমি অর্থোপেডিক সার্জেন। পায়ের অপারেশন প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে স্পাইনাল অ্যানাস্থেসিয়ায় করে চলেছি ছাব্বিশ বছর ধরে। কই কোনো রোগী তো অপারেশনের পরে স্পাইনাল অ্যানাস্থেসিয়ার কারণে ক্রনিক কোমরে ব্যাথা বলে না।
দুয়েকজনের স্পাইনাল ইঞ্জেকশনের জায়গায় বড় জোর দু-তিন দিন ব্যাথা থাকে। বরং কারো কারো মাথার যন্ত্রণা হতে পারে।
তাহলে স্পাইনাল অ্যানাস্থেসিয়ায় সিজারিয়ান সেকশনের অনেক দিন পরেও অনেকের কোমরে ব্যাথা থেকে যায় কেন? কারণটা অ্যানাস্থেসিয়া নয়, বরং গর্ভধারণ সম্পর্কিত।
গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে হরমোন জনিত কিছু পরিবর্তন আসে। এর ফলে লিগামেন্ট, অস্থিসন্ধি ইত্যাদি নরম হয়- যাতে গর্ভধারণের প্রয়োজনে প্রকৃতির নিয়মেই মায়ের পেলভিস বা কাঁকালের ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। আবার সন্তান প্রসবের পরে উপরোক্ত হরমোন নিঃসরণ কমে যায় এবং ব্যায়াম ও সাধারণ হাল্কা কাজকর্মে মাধ্যমে পেলভিস আগের অবস্থায় ফিরে আসে।
কিন্তু আজকাল গর্ভকালীন জটিলতা থাকলে তো বটেই, না থাকলেও প্রসবের আগে বা পরে কাজকর্ম বা ব্যায়াম খুব কম মায়েরা করে। বরং বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ বিশ্রামের প্রয়োজন না থাকলেও তারা বিশ্রামে থাকে। কারণটা কোনো ক্ষেত্রে ভয়। কোনো ক্ষেত্রে আলস্য। কোনো কোনো বিরল ক্ষেত্রে আবার স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ।
এছাড়া পিঠের মাংসপেশীর দূর্বলতা, শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়া, পেট বড় হয়ে শরীরের ভরকেন্দ্র বদলে যাওয়া, বড় হয়ে গেলেও বাচ্চাকে কোলে নেওয়া – এইসব কারণে প্রসবের পরেও অনেকের দীর্ঘদিন কোমরে ব্যাথা থাকে।
এই সমস্যা নিয়ে সারা পৃথিবীর অনেক বড় বড় হাসপাতালে গবেষণা হয়েছে। বহু বিখ্যাত আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান পত্রিকায় সেগুলো প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু কোনো গবেষণাতেই গর্ভকালীন বা প্রসবের পরের কোমরে ব্যাথার সাথে স্পাইনাল অ্যানাস্থেশিয়ার সম্পর্কের তেমন প্রমান মেলে নি।
তথ্যসূত্র
———–
1. Factors Associated with Back Pain after Childbirth
https://pubs.asahq.org/anesthesiology/article/81/1/29/42056/Factors-Associated-with-Back-Pain-after-Childbirth
2. Epidural Analgesia and Back Pain after Labor : Anastasija Malevic, Dalius Jatuzis, and Virginija Paliulyte
3. Prevalence of low back pain experienced after delivery with and without epidural analgesia: A non-randomised prospective direct and telephonic survey.
http://dx.doi.org/10.4103/0019-5049.130814