মায়ের দুধের বিকল্প হয়না। কিন্তু অনেক সময়েই মা বা শিশুর অসুস্থতার জন্য শিশুকে বাইরের খাবার দিতে হয়। এই সমস্যার জন্যই আমাদের রাজ্যে এসএসকেএম হাসপাতালেই প্রায় ৭ বছর ধরে চালু হয়েছে ব্রেস্ট মিল্ক ব্যাঙ্ক, যেখানে মায়েদের বুকের দুধ সংরক্ষণ করে প্রায় ৩ মাস রেখে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে, যার ফলে উপকৃত হয় এসএসকেএমে চিকিৎসাধীন বহু নবজাতক। বুকের দুধ সংগ্রহ ছাড়াও তারা প্রসবের আগে পরের নানান বিষয়ে সচেতনতা তৈরীর কাজও করে চলেছেন দীর্ঘ দিন ধরে। এই বিষয়েই কথা বলেছেন এসএসকেএম হাসপাতালের নিওনেটোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা সুচন্দ্রা মুখার্জি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পিয়ালী দে বিশ্বাস।
মিল্কব্যাঙ্ক কি?
হাসপাতালে ভর্তি ইচ্ছুক মায়েদের থেকে দুধ সংগ্রহ করে পাস্তুরাইজার মেশিনে পাস্তুরাইজ করে হাসপাতালে সংরক্ষণ করা থাকে। আমাদের রাজ্যে এক মাত্র এসএসকেএম হাসপাতালেই এই পদ্ধতিতে মায়েদের দুধ সংরক্ষণ করে রাখার পরিকাঠামো রয়েছে। এটাই মিল্কব্যাঙ্ক।
এই ব্যবস্থায় কি সুবিধা হয়?
এখন ৬- ৭ মাসের প্রি-ম্যাচিওর বাচ্চা জন্মানোর প্রবণতা অনেক বেশী। এই শিশুদের জন্মানোর পরে পরেই মায়ের বুকে দুধ আসতে দেরি হয়। এই বাচ্চারা আকারেও খুব ছোট হয় – ফলে এদের দুধ খাওনোটাও সমস্যার। ওই সব অসুস্থ শিশুদের মধ্যে বেশিরভাগকেই মিল্কব্যাঙ্কের দুধ দেওয়া হয়– পাশাপাশি যে সব মায়েরা অসুস্থতার কারণে শিশুদের দুধ খাওয়াতে পারেনা– তাঁদের সন্তানদেরকেও মিল্কব্যাঙ্ক থেকেই দুধ দেওয়া হয়। এই ব্যবস্থার সবচেয়ে বেশী সুবিধা হল মায়েদের শরীর থেকে সংগ্রহের পর এখানে প্রায় ৩ মাস পর্যন্ত দুধ সংরক্ষণ করে রাখা যায়। যদিও এত দিন সংরক্ষিত করে রাখার জন্য ওই দুধের গুণমান অনেকটাই কমে যায়।
তবে কি মিল্কব্যাঙ্ক একটি ব্যাঙ্ক?
না– ব্যাঙ্ক বলতে যা বোঝায়– মিল্ক ব্যাঙ্ক ঠিক তা নয়– এখানে কিছু জমা রাখার বিনিময়ে কিছু পাওয়া যায় না। এই ভুল ধারণার জন্যই কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৭ থেকে মিল্ক ব্যাঙ্কের নাম বদলে কম্প্রিহেনসিভ ল্যাকটেশন ম্যানেজমেন্ট সেন্টার নাম দিয়েছে। এখানে অত্যাধুনিক পাম্পিং যন্ত্রের সাহায্যে মায়েদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করা হয়। তবে মিল্কব্যাঙ্কের কাজ শুধু মায়েদের থেকে দুধ সংগ্রহ করা নয়। অনেক সময় সময়ের আগে বাচ্চা জন্মানোর জন্য মায়েদের শরীরে অক্সিটোসিন তৈরি হয় না। ফলে তাঁদের বুকের দুধও আসে না। অনেক প্রিম্যাচিওর শিশু দুধ টেনে খেতে পারে না – তাদের মায়েদের অত্যাধুনিক সাকিং যন্ত্রের সাহায্যে স্টিমিউলেশন দিয়ে মায়ের শরীরে অক্সিটোসিন তৈরীর চেষ্টাও করা হয়। আসলে সব মিলিয়ে এই সেন্টারটি মায়েদের সচেতন করার একটি প্রচেষ্টা। এখানে স্বাভাবিক প্রসবের উপর জোর দেওয়া– অপ্রয়োজনে সিজার না করা– শিশুকে ৬ মাস পর্যন্ত মায়ের দুধ খাওয়ানোর মত বিষয়গুলি সম্পর্কে মায়েদেরকে সচেতন করা হয়। প্রিম্যাচিওর শিশুর মায়েদের ক্ষেত্রে বেশীরভাগ সময়েই কাউন্সিলিংএর প্রয়োজন পড়ে।
মিল্ক ব্যাঙ্কের সঙ্গে কাউন্সিলিংএর কি সম্পর্ক?
প্রসবের আগেই আমরা মাকে বোঝাই প্রিম্যাচিওর বেবির কি কি সমস্যা। আমরা সব সময়েই স্বাভাবিক প্রসবের উপর জোর দি। কিন্তু এর বাইরেও এখন সমাজে সিজার হওয়ার একটা প্রবণতা তৈরী হয়েছে। আমরা মায়েদের বোঝাই সময়ের আগে সিজার হলে তাঁরা শারীরিক ভাবে কি কি সমস্যায় পড়বেন। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে কোনও মেডিক্যাল এমারজেন্সি বা বন্ধ্যাত্বের সমস্যা থাকে– এসব ক্ষেত্রে কৃত্রিম প্রসব করাতেই হয়।
সময়ের আগে সিজার হলে মায়েদের শরীরে দুধ তৈরি হতে দেরি হয়। কারণ কৃত্রিম প্রসবে প্রসব বেদনা ওঠেনা। ফলে মায়ের শরীর থেকে অক্সিটোসিন বের হয়না। এছাড়াও এই শিশুদের মধ্যে দীর্ঘ মেয়াদী নানান অসুস্থতার প্রবণতা থাকে – সেগুলো কি ভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে সেটা মায়েদের বোঝাতেই অনেকটা সময় ধরে কাউন্সিলিং করানোর প্রয়োজন পড়ে। মায়েদের কাউন্সিলিংটা একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
প্রসবে অক্সিটোসিনের ভূমিকা কি?
স্বাভাবিক প্রসবের পরে কিছু সময়ের মধ্যেই মায়ের শরীরে দুধ আসে। আগেই বলেছি প্রসব বেদনা উঠলে তবেই শরীর থেকে স্বাভাবিক নিয়মে অক্সিটোসিন বেরোবে। অক্সিটোসিন না বেরোলে মায়ের শরীরে দুধ তৈরি হয় না। জন্মের সময় স্বাভাবিক নিয়মে অক্সিটোসিন না বের হললে এর প্রভাব ভবিষ্যতেও পড়ে। সিজারের ক্ষেত্রে অনেক সময়েই মায়ের সঙ্গে শিশুর বোঝাপড়াতে সমস্যা হতে দেখা গিয়েছে। এর পিছনে অনেকাংশেই দায়ী প্রসবের সময় অক্সিটোসিন না বেরোনো। সে কারণেই সবসময়েই স্বাভাবিক প্রসবের উপর জোর দেওয়া উচিত । সাধারণ নিয়ম হল প্রসব বেদনা ওঠার পর প্রসব হল– গর্ভফুল বেরোলো – তারপর রক্ত বেরোনো বন্ধ হয়ে গেল। তারপর সন্তানকে মায়ের বুকের কাছে দেওয়ার পর শিশু নিপলে মুখ দিলে মায়ের শরীরে স্টিমিউলেশন হয়– তাতেই দুধ বের হয়ে আসে। সেই কারণেই প্রসবের পরের এক ঘন্টা শিশুকে মায়ের কাছে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়।
পরিণত সময়ে বাচ্চা জন্মানোর পর সাধারণ নিয়মেই মা ও শিশুর শরীর থেকে অক্সিটোসিন বের হয়। অক্সিটোসিন গর্ভাশয়কে সঙ্কুচিত করে গর্ভফুলকে বেরোতে সাহায্য করে– সেই সঙ্গে সন্তানের স্পর্শে মায়ের বুকে দুধের সঞ্চার হয়। কিন্তু সময়ের আগে যদি কৃত্রিম উপায়ে অস্ত্রোপচার করে শিশুর জন্ম হয়– তবে অক্সিটোসিন বেরোয় না– ফলে মায়ের দুধ তৈরিতে দেরি হয়। এখন এনএসইউতে সময়ের আগে জন্মানো শিশুর সংখ্যা অনেক বেশী। এমন বহু শিশু আছে যারা সময়ের আগে জন্মানোর কারণে শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছে না– মুখ দিয়ে খাবার টানা তো অনেক দূরের ব্যাপার। তখন ওই শিশুদের স্থিতিশীল করার জন্য ভেন্টিলেটারে রাখা হয়। এরপরে মা ও শিশুর মধ্যে বন্ডিং বাড়ানোর জন্য এনআইসিইউতে মাকে এনে ক্যাঙারু মাদার কেয়ার দেওয়ানো হয়। ক্যাঙারু মাদার কেয়ারে নবজাতককে মায়ের বুকের ওপর রেখে দেওয়া হয়।
অক্সিটোসিনটা কি? আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে প্রসবের ক্ষেত্রে অক্সিটোসিন তো তবে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়?
জন্মের সময় অক্সিটোসিনের অভাব ভবিষ্যতে মা ও শিশুর বন্ডিংএ প্রভাব ফেলে। আমাদের বুঝতে হবে অক্সিটোসিন শুধুমাত্র সাধারণ একটি হরমোন নয়– নিউরোট্রান্সমিটার। এটি আসলে মুড ভালো করার একটি উপাদানও।
অক্সিটোসিন শিশুর স্বভাব তৈরী করার পাশাপাশি মা ও শিশুর মধ্যে আত্মিক বন্ধন তৈরী করে। ব্রেনে অক্সিটোসিনের রিসেপটার আছে– যেখান থেকে একটি শিশুর ব্যবহার– তার মুড এগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়। সেই কারণেই দেখা গেছে যে মায়েরা ব্রেস্ট ফিড করান, তাঁরা যারা করান না– তাঁদের চেয়ে ভালো মুডে থাকেন। প্রিম্যাচিওর ডেলিভারির ক্ষেত্রে অক্সিটোসিন বেরোয় না– ফলে মা ও শিশুর মধ্যে বোঝাপড়া কম থাকে। পরবর্তীকালে দেখা যায়– মাকেও শিশু বোঝে না– বা শিশুর সমস্যাও মা বুঝতে পারছেন না। মায়ের সঙ্গে শিশুর বোঝাপড়াতে সমস্যা হতে থাকে। ফলে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি গরুর বাছুর মারা গেলেই গরুকে একটা খড়ের বাছুর দেওয়া হত। যাতে ওই নকল বাছুরকে দেখেই গরুর শরীরে অক্সিটোসিন বের হয়– এবং গরুর দুধ হয়। প্রসবের পরে সন্তানকে দেখে বা ছুঁয়ে স্বাভাবিক ভাবেই মায়ের শরীর থেকে অক্সিটোসিন বের হয়। অক্সিটোসিন বেরোলে তবেই ওই গরুর শরীরে দুধ তৈরী হবে। ঠিক একই ভাবে মায়েদের শরীর থেকে অক্সিটোসিন বের হলেই বুকে দুধ আসবে। প্রসবে অক্সিটোসিনের গুরুত্ব অপরিসীম।
কিন্তু সিজারিয়ান প্রসবের পরে স্বাভাবিক ভাবে অক্সিটোসিন না বেরোলে তাঁকে তো কৃত্রিম অক্সিটোসিন ইনজেক্ট করা হয়?
সিজারের পরে জরায়ুর সংকোচন করতে অক্সিটোসিন দেওয়া হয়।
এখন সিজারিয়ান পদ্ধতিতে জন্মের প্রবণতা অনেক বেড়েছে। এটা কি সমস্যার?
এখন প্রিম্যাচিওর বেবির প্রবণতা অনেক বেড়েছে। ব্যবসায়িক কারণেই মায়েদেরকে বোঝানো হচ্ছে স্বাভাবিক প্রসবে কষ্ট অনেক বেশী। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ৩৯ সপ্তাহের আগে সিজার করা হচ্ছে। কেউ ডাক্তারের সুবিধা মত সময় বা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী শুভ দিনক্ষণের চক্করে পড়ে সিজার করাচ্ছেন। এর ফলে বহু মায়েরাই সমস্যায় পড়ছেন। একমাত্র প্রসবের সময় কোনও জটিলতা ছাড়া কখোনই সিজার করা উচিত নয়। কারণ সময়ের আগে জন্মালে শিশুর নানান শারীরিক সমস্যা হওয়ার পাশাপাশি মায়েরাও গভীর সমস্যায় পড়েন। ব্রেস্ট ফিডিং এর অভ্যাস করাতেও সমস্যা হয়। এছাড়া ভবিষ্যতেও শিশুদের ব্যবহারে প্রভাব পড়ে।