আগেই বলেছিলাম যে মেয়েদের রক্তাল্পতা হলে তাদের জন্য কুলেখাড়া পাতার রসের ব্যবস্থা আছে। কুলেখাড়া পাতা আমার রুগিরা জলে ফুটিয়ে সেই রস পান করেন। অ্যানিমিয়ার নিরাময়ে আমি সাধারণ লোকেদের মধ্যে এর থেকে জনপ্রিয় টোটকা আর কিছু দেখি নি। খেতে অসম্ভব খারাপ। ক্ষারীয় রস। খেলে জিভ ভারি হয়ে যায়। তবু আমার রুগিরা প্রচন্ড বিশ্বাসের সাথে এই পাতার রস খেয়ে আসছে। আমার প্র্যাকটিস জীবনের শুরু থেকে আজ অবধি এর জনপ্রিয়তায় সামান্য ভাঁটা দেখি নি। তা থেকে আমার মনে হয়েছে নিশ্চয়ই এই পাতার রসের সাথে রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়ার কোনো সম্পর্ক আছে। এই গাছের আরেক নাম গোকুলকাঁটা। সংস্কৃতে বলে কোকিলাক্ষ। এই গাছ আমাদের বনে-বাদাড়ে যথেষ্ট পাওয়া যায়। তাই বৈদিক যুগ থেকে আজও এর ব্যবহার হয়ে আসছে।
শীত ক্রমে আসিতেছে। এই সময় শুরু হবে কিডনিতে স্টোনের সমস্যা। শীতে আমাদের জল কম খাওয়া হয়। বিশেষ করে মেয়েদের যাদের ইউরিনে ইনফেকশনের প্রবণতা থাকে তাদের অনেকের প্রায় অবধারিতভাবে এই শীতকালে ইউরিনের ইনফেকশন ও তার সাথে সাথে স্টোনের সমস্যা ফিরে আসে। কিডনিতে পাথর হলে রুগিরা ব্যথায় এত কষ্ট পায় যে ডাক্তার হিসেবে সত্যিই তাদের দেখে খুব মায়া হয়। আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করে পাথর ধরা পড়লে দশ মিলিমিটারের নীচে পাথর হলে আমরা রুগিকে অভয় দিই যে ভবিষ্যতে সেটা পেচ্ছাপের সাথে বেরিয়ে যাবে। অপারেশন করার দরকার হবে না।
ডাক্তার হিসেবে স্বীকার না করে কোনো উপায় নেই যে এই পাথরকে কোনো ওষুধ দিয়ে বের করা বা কমানোর চিকিৎসাবিজ্ঞানসম্মত নির্দিষ্ট কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই যেখানে আমরা রুগিকে পুরোপুরি অভয় দিতে পারি না, তারা নিজেরা উপায় বের করে নেয়। দেখেছি আমার কিডনির পাথরে আক্রান্ত রুগিরা কুলত্ত কলাই ভেজানো জল খায়। সারারাত এই কলাই জলে ভিজিয়ে রেখে সকালে খালিপেটে এই জল খান। আমার মাকেও এই কুলত্ত কলাইয়ের গুণের কথা খুব বলতে শুনি। আমার এক মাস্টারমশাই ছিলেন যিনি রুগিদের প্রতিদিন একগ্লাস পাতিলেবুর রস খেতে বলতেন। আমিও আমার কিডনির স্টোনের রুগিদের তাই বলি। ডাক্তারি পরিভাষায় বলে, ‘ওয়ান্স আ স্টোন ফর্মার ইস অলওয়েজ আ স্টোন ফর্মার’- সত্যিই এই সমস্যা ঘুরে ঘুরে আসে। তাই রুগিরা চালু টোটকা ব্যবহার করে এর থেকে বাঁচার চেষ্টা করেন।
পাইলসের সমস্যা আমাদের দেশে খুব বেশি। যদিও এখন এর খুব আধুনিক শল্য চিকিৎসা বেরিয়ে গেছে তবু প্রাথমিকভাবে এর চিকিৎসা করাতে রুগিরা আমাদের কাছেই আসে। যেহেতু পাইলসের সাথে রক্ত বের হতে দেখলে সবাই খুব ঘাবড়ে যায়, তাই রুগিরা মানসিকভাবে খুব বিপন্ন অবস্থায় আমাদের কাছে আসে। কিন্তু এই রোগেরও কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ আমাদের অ্যালোপ্যাথিতে নেই। আমি নিজে রুগিদের পায়খানা নরম রাখার ওপর জোর দিই। পায়খানা করার সময় একেবারে চাপ না দেওয়া, মাংস ও ঝাল-মশলা কম খাওয়া এবং বেশি করে জল, শাক-সব্জি, ফল খেলে অনেকেই এর থেকে মুক্তি পেয়ে যান। আমি রুগিদের এই ব্যাপারগুলোর ওপর জোর দিয়ে দেখেছি তাঁরা ভালো থাকেন। ডাক্তার হিসেবে আমরা যা বলি অধিকাংশই বেদবাক্যের মত তা মেনে চলেন। আমি নিজে ওই অসুখে আক্রান্ত হলেও হয়ত এতটা মেনে চলতে পারতাম না।
এই পাইলসে আক্রান্ত রুগিরা অনেকেই দেখেছি সাঁচি পেয়াজ বা ছোট পেঁয়াজ অল্প ঘিয়ে ভেজে রোজ দুবার করে খান, অন্তত যতদিন তাদের রক্ত পড়ে। তাঁরা বলেন এতে নাকি রক্ত পড়া তাড়াতাড়ি কমে যায়। সাঁচি পেঁয়াজ আবার মাথার চুল উঠে গেলেও অনেকে টাকে লাগান। আমার মা আমার টাকে লাগানোর জন্য অনেক সাঁচি পেঁয়াজ কিনে এনে সেসব দিয়ে শেষে তরকারি রান্না করে ফেলতেন। আমার কেন জানি মনে হয় টাকে চুল গজানোর কোনো টোটকা হয় না। টাক ভগবানের একটা অভিশাপ। টোটকা দিয়ে এর নিরাময় অসম্ভব।
এই শীত আসার সাথে সাথে সাথে অন্য এক ভয়ঙ্কর সমস্যা নিয়ে রুগিদের সংখ্যা বেড়ে যায়- তা হল পুড়ে যাওয়া। নারী-পুরুষ সবাই দগদগে ফোসকা আর প্রচন্ড যন্ত্রণা নিয়ে চিৎকার করতে করতে চেম্বারে আসেন। সাথে আসে বাড়ির ও পাড়ার জনা দশ-পনের লোক। পোড়া অল্প জায়গায় হলে সাধারণ চিকিৎসায় মাসখানেকের মধ্যে সেরে যায়। তবে শুরুর দিকের প্রচন্ড জ্বালা ও ব্যথা কমানোর জন্য আমার রুগিদের প্রায় সবাইকে দেখি সেই পোড়া জায়গায় টুথপেস্ট লাগিয়ে আসতে। এই ব্যাপারটা আমার ভয়াবহ লাগে। দগদগে ফোস্কার ওপর একগাদা টুথপেস্ট। এতে জ্বালা কিছুটা কমে হয়ত কিন্তু সেই পেস্ট চামড়ার ওপর লেগে থেকে চামড়ার খুব ক্ষতি করে এবং পোড়া শুকোতে দেরি হয়। কিভাবে এই টোটকা মানুষের মধ্যে ঢুকে গেছে, কবে থেকেই বা ঢুকেছে কে জানে? রুগিকে বা তার বাড়ির লোকেদের যে এই নিয়ে গালাগালি করব তারও উপায় থাকে না কারণ তারা সবাই ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল হয়ে থাকে। অথচ এই মারাত্মক টোটকা আমাদের জিনে এমনভাবে ঢুকে গেছে যে একে বের করা খুব মুশকিল। সবচেয়ে সমস্যার কথা আগুন লাগলে পাড়ার সব লোক চিৎকারে জড়ো হয়। তখন আগুনে পোড়া লোকটির কষ্ট দেখে কেউ না কেউ একজন এই অব্যর্থ দাওয়াইটি ঠিক বাতলে দেন।
আরেকটা ব্যাপার এটা ঠিক টোটকা কিনা আমি জানি না বিগত বেশ কয়েকবছর ধরে আমার রুগিদের মধ্যে খুব দেখতে পাচ্ছি, সেটা হল একটি পায়ে কালো কার বা মোটা সুতো পরা। ছেলেদের থেকে মেয়েরাই সাধারণত এই টোটকা ব্যবহার বেশি করে। সাদা স্রাব থেকে শুরু করে দুর্বলতা, থাইরয়েড, বন্ধাত্ব্য, সুগার, ওজন না বাড়া এমনকি স্বামীর মন না পাওয়া বা বিয়ে না হবার জন্যও আমি অনেককে এই কালো কার পরতে দেখেছি। যে মেয়েদের পা খুব সুন্দর তাদের পায়ে এই সুতো যে একেবারে মানায় না তা বলব না, তবে কিভাবে এর উৎপত্তি এবং কিভাবেই এটা এত জনপ্রিয় হয়েছে সেটা জানতে আমার খুব ইচ্ছে হয়। যদিও আমার অনুমান (আমি ভুল হতেই পারি) এই টোটকা খুব বেশিদিন আমাদের বাঙালিদের মধ্যে আসে নি। আমার আরও মনে হয় এটা হিন্দি বলয়ের টোটকাও হতে পারে, আমরা আউটসোর্স করেছি। কারণ আমার অনেক অবাঙালি রুগিদের মধ্যে আমি এর ব্যবহার দেখেছি।
সবশেষে যে মহার্ঘ, মহান টোটকার কথা না বললে আমার চিকিৎসকজীবন ব্যর্থ হবে তা হল বোরোলিন। সুরভিত এই অ্যান্টিসেপ্টিক ক্রিমটি বাঙালি জীবনের সাথে এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে একে বাদ দিয়ে আমাদের গৃহস্থালিকে ভাবা প্রায় অসম্ভব। সেই ছোট্টবেলা থেকে শোনা শ্রাবন্তীদির রেডিওতে রোববার দুপুরের ‘বোরোলিনের সংসার’ দিয়ে সেই যে শুরু আজও তা চলছে। দিদির অমন মিহি নরম গলা শুনে সেই ছোট্টবেলাতেই পেটে কেমন গুড়গুড় করত। কারণটা ঠিক বুঝতে পারতাম না। আজও ‘একটা দেশলাই কাঠি জ্বালাও’ গানটা শুনলে সেই ছেলেবেলার গুড়গুড় ফিরে আসে।
আমাদের গরিব ঘরের বাঙালি মেয়েদের তো কোনো প্রসাধনী বা ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি তাঁদের স্বামীরা কিনে দেন না, বা তাঁদের বিউটি পার্লারে যাবার পয়সাও দেন না- তাঁদের রক্ষাকবচ তাই বোরোলিন। বাংলা সিরিয়ালের বিশাল বড়লোক বাড়ির বউরা যারা রান্নার সময়ও বেনারসি পরে তারা রাতে শোবার সময় যখন বিছানায় বর শায়িত থাকা অবস্থায় ফিনফিনে নাইটি পরে প্রায় একঘন্টা ধরে লিপস্টিক পরে- তাদের দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার গরিব বউদি-দিদি-নতুনবউ রুগিরা তাদের স্বামীকে ‘ধরে রাখতে’ এখনও শীত কি গ্রীষ্ম সারা বছর মুখে বোরোলিন লাগিয়ে ঘুমোতে যান।
আর পারছি না গুরু, সেই নার্সারি থেকে শুরু। শুধু বিবাহিতই বা কি করে বলি, আমার অনেক আত্মীয় আছেন যাঁদের বিয়ে হয় নি বা স্বামী মারা গেছেন তাঁদের বিছানায় বালিশের পাশে আর কিছু না হোক একটা বোরোলিন থাকবেই। আমার মা আমাদের ছোটবেলায় শীতকালে আমাদের ফেটে যাওয়া গালে জোর করে ঘষে ঘষে বোরোলিন লাগিয়ে দিতেন। ট্রেকিং করতে গিয়ে দেখি অনেক বাঙালি ট্রেকার পাহাড়ের উচ্চতায় অতিবেগুনি রশ্মির হাত থেকে বাঁচতে সানস্ক্রিনের বদলে বোরোলিন ব্যবহার করেন। যেসব ছোট বাচ্চাদের ফাইমোসিস আছে, নুনুর চামড়া খুলতে দেরি হয়, তাদের মায়েরা স্নানের সময় নুনুর চামড়া টেনে স্ট্রেচ করে বোরোলিন লাগিয়ে দেন। বাঙালি জীবনে বোরোলিনের ব্যবহার ও গুরুত্ব নিয়ে ভাবছি গবেষণামূলক কিছু কাজ করে ব্রিটিশ জার্নালে পাবলিকেশনের জন্য পাঠাব।
এক টপ টু বটম দিদিভক্ত একবার আমাকে দিদির দূরদর্শিতার কথা বলতে বলতে বলেছিলেন বোরোলিন নাকি দিদির আবিষ্কার। আমি চমকে চোদ্দ হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “বলেন কি মশাই? তা কখনও হয় নাকি? হাফপ্যান্ট থেকে বোরোলিন দেখছি। আপনি একে দিদির আবিষ্কার বলে চালালেই হবে?” তিনি শুধরে নিয়ে বলেন, “আরে না না। এই যে এখন নতুন বোরোলিনের বড় মুখওয়ালা কৌটোগুলো দেখছেন না ওগুলো দিদির আবিষ্কার”। দিদি যখন প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হলেন তখন শিল্প সম্ভাবনা বৃদ্ধির স্বপ্নময় দিনগুলোতে উনি নাকি বোরোলিনের কর্তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন টিউবের মুখ বড় করতে। এতে এর ব্যবহার বাড়বে। শিল্পে পুঁজি বাড়বে। তখন থেকেই টিউবের সাথে এই কৌটোর ব্যবহার শুরু হয়। এর ফলে নাকি বোরোলিনের ব্যবসা দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। সত্যি কি মিথ্যা আমি জানি না। তবে ভদ্রলোক খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে কথাটা আমাকে বলেছিলেন।
এতদূর অবধি ঠিক ছিল কিন্তু কিভাবে যে বোরোলিন গরম করে লাগানোর ধারণা বাঙালি জীবনে ঢুকে গেছে তাতে আমি হতবাক হয়ে যাই। গরম করে কোনো কিছু লাগালে তার কার্যকারিতা বেড়ে যায়- এই অগ্নিশুদ্ধির ধারণা যে কিভাবে আমাদের মধ্যে ঢুকে গেল তা নিয়ে সমাজতাত্ত্বিকদের গবেষণা করা উচিত। কেটে গেলে, ফোঁড়ায়, ঘায়ে, ছুলিতে, দাদে, সদ্য বিয়ের পর নব্য-নতুন যৌন সংসর্গের পর পুরুষাঙ্গের চামড়া ফেটে ভয়াবহ রক্তপাতে, পাইলসে, ফিসারে, ফিসচুলায়, আঙ্গুলহারা বা প্যারোনিকিয়ায় এমনকি ডায়াবিটিক গ্যাংগ্রিনের মত ডাক্তারদেরও পিলে চমকে দেয়া অসুখে অমন নির্দ্বিধায় বোরোলিন গরম করে লাগানোর মহাজ্ঞান বাঙ্গালিরা যে কিভাবে লাভ করল এ আমার এক চিরকালীন বিস্ময়!
লাগাবি লাগা তা আবার গরম করে কেন বাবা! যেটুকু কাজ বোরোলিন এমনি লাগালে হত পুড়িয়ে লাগানোয় সেই কার্যকারিতাটুকুও আর হবে না- এই সহজ কথাটা যে কেন মানুষের মাথায় ঢোকে না তা আমি বুঝতে পারি না। রিক্সাওয়ালা থেকে শুরু করে কর্পোরেট স্যার, কাজের মাসি থেকে সুখি চেহারার বৌদি- সবাই এই অব্যর্থ নিদানে এমন অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে আমি বলতে বলতে হতাশ হয়ে এখন বলাই ছেড়ে দিয়েছি।
তাই আপনারা কখনও আমার চেম্বারে এলে এখন এরকম কথোপকথন প্রায়ই শুনতে পাবেন- “কাটাটা কদিন ধরে আছে?”
“তা ডাক্তারবাবু, দশদিন হয়ে গেল”।
“টিটেনাস নিয়েছেন?”
“না ডাক্তারবাবু”।
“ তা এতদিন ঘরে নিয়ে বসে আছেন, এত ছড়িয়ে গেছে। কি করেছেন হোমিও?”
“না ডাক্তারবাবু”।
“তবে এতদিন করেছেনটা কী?”
“বোরোলিন লাগিয়েছি ডাক্তারবাবু। প্রতিদিন তিনবার করে”।
“হুম্। কি বোরোলিন গরম করে?”
“হ্যাঁ, ডাক্তারবাবু”। (অত্যন্ত উৎসাহের সাথে) “লাগাবো?”
“লাগান, কি আর করবেন। ওটা তিনবারের জায়গায় চারবার করুন”।
আর পারছি না গুরু। সেই নার্সারি থেকে শুরু।
Darun… Apnar ros bodher tarif Na kore parchi Na.
দারুন দারুন।
বাস্তব সত্য
খুব বাস্তব কথা
খুব ভালো লাগলো
এভাবেই লিখুন।