ভদ্রলোক আমার অনেক দিনের চেনা। আমার অনেক দিনের রুগি। আমাকে দেখানোর প্রায় শুরুর দিক থেকেই জানতাম যে তিনি উকিলবাবু। নিজেই বলেছিলেন। সবসময় সাদা শার্ট আর প্যান্ট পরতেন। পৃথিবীতে অনেকেই থাকেন যারা নিজেদের পেশা নিয়ে গর্বিত। নিজের আত্মবিশ্বাস সবসময় তাঁদের কথার মধ্যে ফুটে ওঠে। উনি ছিলেন তেমন মানুষ।
খুব যে গর্বিত এমন নন। তবে আত্মবিশ্বাসী। তাই ভদ্রলোককে আমার ভালো লাগতো। অহমিকা আমি খুব সহ্য করতে পারি না। আমি অহঙ্কারী লোকের কাছাকাছি বেশিক্ষণ থাকতে পারি না। আমার নিজেকে অসহায় লাগে। তাই ভদ্রলোক আমাকে আকর্ষণ করতেন। তিনি যে বিরাট কাজকর্ম করছেন, আইনের জগতে যে তিনি বিরাট একজন কেউকেটা হয়ে উঠছেন এটা বুঝতে পারতাম। ‘কেউকেটা’ শব্দটায় হয়ত একটু অশোভনতা আছে কিন্তু আমার এমনটাই মনে হত। যদিও পরে বুঝেছি আমার ইন্সটিঙ্কট খুব ভুল ছিল না।
মাঝে মাঝেই ওনাকে দেখতাম কারো না কারো বাইকের পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সারাদিন প্রচন্ড ব্যস্ত থাকতেন। আমার কাছে যখন দেখাতে আসতেন মাথার চুলগুলো এলোমেলো। তেল দেওয়া কাঁচা চুলে বেশ কিছু সাদা ফুটে উঠছে। চোখে-মুখে ক্লান্তি ধরা পড়ত। বুঝতাম উনি ওনার কাজের জগতে প্রচন্ডভাবে ডুবে আছেন। আর এই ক্ষেত্রে যা হয় তাই হত।
শারীরিক সমস্যার চেয়ে মানসিক বিপন্নতায় কাহিল হতেন বেশি। ক’দিন বাদে বাদেই আমাকে বলতেন ডাক্তারবাবু, ‘আমাকে সব টেস্ট লিখে দিন। ফুল চেক আপ করব’। ওই বলতেনই। কোনোদিনই কোনো রিপোর্ট নিয়ে আসেন নি। নিজের ছোট মেয়েকেও দেখাতে আসতেন। একবার তার স্ত্রীকেও নিয়ে এসেছিলেন দেখাতে। বাড়িতে সবাই কেমন যেন এক মানসিক উৎকন্ঠার শিকার। তাদের সকলে অনেক বিত্তের মধ্যে থেকেও যেন সুখের মুখ দেখতে পারছে না। তারা সকলেই যেন সুখের ঘরের চাবি হারিয়ে ফেলেছে।
অথচ ভদ্রলোক খুব অমায়িক। রানাঘাটে দেশের বাড়ি। গ্রামের কৃ্তী ছেলে। কথায় ও ব্যবহারে গ্রাম্য এক সরলতা ছিল। তার সেই সরলতা আমাকে খুব টানত। মোটের ওপর মানুষটিকে আমি বেশ ভালোইবেসে ফেলেছিলাম। তারপর নানাজনের মুখে তাঁর আইন ব্যবসায় উন্নতির কথা শুনতাম। বুঝতাম উনি খুব তাড়াতাড়িই উন্নতির সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আসছেন। ভালো লাগত। তাঁর সাফল্যে আমার কোনোদিন অসূয়া বোধ হয় নি।
দেখাতে এলেই বলতেন, ‘ডাক্তারবাবু একদিন আমার চেম্বারে আসুন’। বুঝতাম যে তাঁর চেম্বারে দর্শনীয় কিছু নিশ্চয়ই আছে। পরে অন্যের মুখে শুনেছিলাম তাঁর চেম্বার ছিল খুবই পরিপাটি। চেম্বারের সংলগ্ন ছিল লাইব্রেরি। সেখানে নাকি দেশ বিদেশের এমন কোনো আইনের বই নেই যা তাঁর সংগ্রহে ছিল না।
আমাদের বটতলার মোড় থেকে একটু এগিয়ে একটা চায়ের দোকান। বর্তমান পার্টির ছোট বড় নেতারা ওখানে বেশ রাত পর্যন্ত আড্ডা দ্যায়। আমি চেম্বার থেকে ফেরার সময় প্রায়শই ওনাকে দেখতাম ওখানে রাত পর্যন্ত বসে আড্ডা দিচ্ছেন। আমি অরাজনৈতিক লোক। সম্পূর্ণভাবে। আগে এটা স্বীকার করতে আমার দ্বিধা হত। এই নিয়ে দেশি-বিদেশি মহামানবদের তো কম চাপানউতোর পড়ি নি। আজ বেশ কয়েকবছর ধরে আমার এই কথাটা স্বীকার করতে আর লজ্জা হয় না। আমি সকল রকম রাজনৈতিক সংসর্গ ও আবেগ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি। এমনকি কখনও কখনও অন্তর্গত স্থানীয় খবর থেকেও। তাই ভদ্রলোকের এত বড় খবর আমার কানেও আসে নি।
তারপর অনেকদিন আসেন না। প্রায় বছর তিনেক হল। মাঝে মাঝে ফোন করতেন। ডাক্তারবাবু আমি এখন নিউটাউনে থাকি। আপনি একটু ওষুধ লিখে পাঠিয়ে দিন। আমি আপনাকে জি পে করে দিচ্ছি। বিরক্ত হলেও মানুষটি যেহেতু উনি তাই আমি লিখে পাঠিয়ে দিতাম।
কিছুদিন পরে সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। মাঝে একবার হোয়াতে ছবি পাঠিয়েছিলেন উনি রাষ্ট্রপতির হাত থেকে কী একটা ‘শান্তি পুরস্কার’ নিচ্ছেন। কুমার শানুর সাথে সেলফি পাঠালেন। ওনারা দুজনেই নাকি সেই পুরস্কার পেয়েছেন। আস্তে আস্তে সেটাও বন্ধ হয়ে গেল।
গত দু’বছর ওনার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না। ওনার সাফল্যের নতুন কোনো খবর আর আমার কানে আসে নি। ধীরে ধীরে যেমন হয়। ওনার স্মৃতি আমার মন থেকে ঝাপসা হয়ে গেছিল।
ওনার এক সহকারী ওনার সূত্র ধরেই আমাকে দেখাতে আসতেন। অনেকদিন বাদে তিনি সেদিন দেখাতে এলেন। তাঁকে দেখেই আমার ওই ভদ্রলোকের কথা মনে এল। বেশ কয়েকদিন ধরেই চেম্বারে রুগির হাহাকার চলছে। তাই কিছু শোনার আকাঙ্খায় তাঁকে ওনার খবর জিজ্ঞাসা করলাম।
– আপনি ওনার কথা শোনেন নি কিছু?
আমি যথারীতি বিব্রত।
-টেটের চক্রে উনিও তো জড়িত। ব্যারাকপুরের অনেকের থেকেই উনি টাকা নিয়েছিলেন। কাউকে চাকরিও পাইয়ে দিয়েছেন। কাউকে দিতে পারেন নি। এখন ওনার নাম ইডির শর্টলিস্টে আছে। যে কোনোদিন সামনে আসবে।
ব্যারাকপুরে ওনার পক্ষে আর থাকা সম্ভব ছিল না। উনি যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন সেই বাড়িওলাও ওনার নামে চেক বাউন্স করার জন্য মামলা দায়ের করেছেন। ব্যারাকপুর কোর্টেই সেই মামলা চলছে।
-উনি কি বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতেন? ওনার চেম্বারে মাঝে মাঝেই যেতে বলতেন।
-ওনার লাইব্রেরিতে কী বই ছিল না ডাক্তারবাবু? সব বইও সম্ভবত নিয়ে যেতে পারেন নি। রাতারাতি ব্যারাকপুর ছেড়ে নিউ টাউনে শিফট করে গেছেন।
– এত ভালো করছিলেন কী করে যে এই মতি হল!
– খুবই ভালো করছিলেন। আমি তো ওনার সাথেই ছিলাম। কোনোভাবে সেই রাজনৈতিক চক্রের মধ্যে ঢুকে পড়েছিলেন। আর বেরোতে পারেন নি। এখন তো প্রায় শেষ হয়ে গেছেন। অনেকদিন খবর পাই না। জানি না এখন কী করছেন।
– ওনার মেয়ে বউকেও মাঝে মাঝে দেখাতে নিয়ে আসতেন।
– উনি তো দ্বিতীয়বার আরেকটা বিয়ে করেছিলেন শোনেন নি? ওই বউ এখন সমানে ব্ল্যাকমেল করে চলেছে।
আরো কিছু কথা হল। ভদ্রলোক চলে গেলেন। ভাবছিলাম ঠিক যেন কোনো সিনেমার চিত্রনাট্য। যারা এই দুর্নীতিতে জড়িত প্রতিটি মানুষের এই একই গল্প। অগুন্তি অর্থ। আকস্মিক আর্থিক ও ক্ষমতার উত্থান এবং অবশ্যই দ্বিতীয় নারী। ওনার মত গ্রাম্য সরলতায় ঢাকা মানুষটিও এই যৌনতা ও অর্থের মোহ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন নি। অন্য আর পাঁচজনের মত তিনিও চার্জশিটের অপেক্ষা করছেন।
রাজনীতি এদের ব্যবহার করে নাকি এরা ক্ষমতা ও অর্থের জন্য রাজনীতির আশ্রয় নেয়? আমার মনে হয় দ্বিতীয়টিই ঠিক। রাজনীতি অনেকটা শেয়ার মার্কেটের মত। ভীষণ অনিশ্চিত একটা জায়গা। যেখান থেকে আপনি একই সাথে অল্প সময়ে কোটিপতি বা পথের ভিখিরি হতে পারেন। তবে পথের ভিখিরিরও কিছু ইজ্জত থাকে কিন্তু রাজনীতির ঘোলাজলে অর্থের সাথে সাথে এদের মানসম্মান সবই যায়।
সাধারণ মানুষ যাদের রাজনীতির মানসিক কাঠামো নেই তারা রাজনীতিতে এসে পচা পাঁকে ডুবে মরে। ওনার মত ঘাগু উকিলও বেসামাল হয়ে গেছেন। অথচ উনি যেভাবে করছিলেন উনি যদি একটু স্মল বা মিড ক্যাপে ইনভেস্ট করতেন! একটু ধৈর্য ধরতেন পাঁচ-দশ বছর তবে কিন্তু ভালোই রিটার্ন পেতেন। কিন্তু উনি নিরানব্বই শতাংশ মানুষের মতই ভুল করলেন। ওয়ারেন বাফেটের কথা মনে রাখলেন না। যা পরিণতি হবার তাই হল।
– উনি যেমন উন্নতি করছিলেন ডাক্তারবাবু আর কয়েক বছরের মধ্যেই খুব ভালো জায়গায় চলে যেতেন। কিন্তু এখন যা নিজের অবস্থা করেছেন আর মনে হয় ফিরে আসতে পারবেন না।
ভদ্রলোকের জন্য করুণা নাকি ক্রোধ কোনটা আমার মনে এল তা আমি সঠিকভাবে বুঝতে পারলাম না। আসলে আমি মানুষটি সম্পর্কে আমার আগের ধারণা থেকে বেরোতে পারছি না হয়ত। তার সেই সাদা পোষাক, সরল গ্রাম্য কথা, সফল আইনজ্ঞের স্বীকৃতি এইসব দেখেই তো বেশ কিছু লোক ওনাকে লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়েছে একটি সরকারি চাকরির জন্য। রাজনৈতিক নেতাদের তো আজকাল লোকেরা বিশ্বাস করে না। তাই তাঁরা আড়ালে ওনার মত লোকেদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। তাঁরাও ক্ষমতা ও অর্থের লোভে সেই নাবাল জমিতে পা রাখেন।
সকলের ক্ষেত্রেই গল্পটা হয়ত একই রকম।