Sick women live forever.
বাংলায় একটা কথা আছে মেয়েদের বিড়ালের প্রাণ। তা সহজে বেরোয় না। কথাটা অনেক ক্ষেত্রে মিথ্যে নয়। তারপর সেই মহিলা যদি অসুস্থ হন, তাহলে সেই দুর্ভোগ আরো দীর্ঘস্থায়ী হয়। ওপরের কথাটি সম্ভবত কোনো রেড ইন্ডিয়ান প্রবচন থেকে নেওয়া। মার্কেজের ‘লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা’ উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার যৌবনের প্রেমিকা ফার্মিনা ডেজার জন্য অপেক্ষা করে করে মাথায় বিরাট টাক বানিয়ে ফেলেছেন আর সব দাঁত তুলে ফেলে নকল দাঁত পরে ঘুরে বেড়ান। তবু তিনি এখনো প্রত্যাশা করেন ফার্মিনার ডাক্তার স্বামী মারা গেলে তিনি তাকে বিয়ে করবেন। এমন সময় হঠাৎ দু-বছর ধরে ফার্মিনা বেপাত্তা হয়ে যান। প্রথমে তার জন্য কিছুদিন বিফল অনুসন্ধান চালিয়ে ফ্লোরেন্টিনো এই সিদ্ধান্তে আসেন যে ফার্মিনা যদি অসুস্থ হয়েও থাকে তবু তিনি মারা যেতে পারেন না কারণ Sick women live forever ।
আমি আগেও অনেকবার এই কলমে বলেছি যে ডাক্তার হবার কারণে সবচেয়ে বেশি যা আমাকে কষ্ট দেয় তা বার্ধক্যের অসহায়তা ও যন্ত্রণা। একজন ডাক্তারবাবু কখনই চিরযুবক বা যুবতী হয়ে থাকতে পারে না বা সমাজও তাদের সেই যুবক চেহারাটা মেনে নেয় না তার একটা কারণ অবশ্যই একজন ডাক্তারবাবুকে প্রতিনিয়ত সেই বার্ধক্যের সাথে লড়াই চালাতে হয়। এই লড়াইটা তার নিজের জন্য নয়, তার রুগিদের জন্য। প্রতিদিন সকাল হলেই আমার ফোনের হোয়াতে মেসেজ ভরে থাকে যেসব বয়স্ক মানুষদের দেখেছি তাদের সমস্যা হয় সারে নি, নয়ত বেড়ে গেছে। অনেকে হয়ত এতটাই খারাপ যে চেম্বারে এসে দেখাতেও পারবেন না। তাদের ক্ষেত্রে কী উপায়?
কোভিডের পরে সময়ের অভাবে হোম ভিসিট করা বন্ধ করে দেওয়ায় এইসব বয়স্ক মানুষদের সমস্যা আরো বেড়ে গেছে। কিন্তু আজকাল একটা কাছাকাছি হোম ভিসিট সেরে আসতেই আধঘন্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট লেগে যায়। যা ম্যানেজ করা এখন আমার পক্ষে অসম্ভব। তবু যাদের বহুদিন ধরে দেখছি বা লতায়-পাতায় যাদের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে এমন জায়গায় তো না গিয়ে উপায় নেই।
ওনাকে আমি পনের-ষোল বছর ধরে দেখছি। খুবই সুন্দরী। সেই কারণে হয়ত স্বামীর কাছেও সবসময় যত্ন পেয়েছেন। আগে যতবার দেখতে গেছি প্রতিবার ওনার বয়স্ক স্বামী ছেলে-বউয়ের পাশে এসে দাঁড়াতেন। ওনাকে আমি যতদিন ধরে দেখছি উনি আংশিক বা সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী। কোনোদিন ওনাকে আমি বাড়ির পাশের রাস্তাতেও হাঁটতে দেখি নি। কতবার বলেছি হাঁটার কথা। বাড়ির বিছানাটাই ওনার সবচেয়ে প্রিয় আশ্রয়। এমন নয় যে উনি পারবেন না কিন্তু অসুস্থতা তার মনের মধ্যে এমন শেকল বিছিয়ে রেখেছিল যে জেলখানার কয়েদিদের মত তিনি জেলখানাটাকেই ভালোবাসতে শুরু করেছিলেন। ভালোবাসা কথাটা হয়ত বাড়াবাড়ি হল, বলা যেতে পারে নিরাপদ বলে ভাবতে শুরু করেছিলেন।
তাঁর স্বামী তাঁর থেকে অনেক সক্ষম হলেও হঠাৎ করেই একদিন মারা গেলেন। সারা বাড়ির লোকেরা তার অসুস্থতা নিয়ে এত ভাবিত উদ্বিগ্ন থাকত যে তার স্বামীর মৃত্যুর ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে ওদের কিছুটা সময় লাগল। তার স্বামীর মৃত্যুর পরে যেদিন প্রথম ওনাকে দেখতে গেলাম উনি হাউহাউ করে কেঁদে বললেন, এখন তার কী হবে? তাকে কে দেখবে? তার ছেলে তো এমন কিছুই করে না। তার বড় কিছু ধরা পড়লে হয়ত তাকে বিনা চিকিৎসাতেই মারা যেতে হবে। সেই কান্নার পরে প্রায় নয় কি দশ বছর তো পার হয়েই গেছে। কিছুদিন আগে তিনি মারা গেলেন।
শীত বয়স্ক লোকদের জীবাত্মার পরমাত্মার সাথে মিলিত হবার ঋতু। প্রতিবার শীতে কত বয়স্ক মানুষ যে রোগাক্রান্ত হয়ে বা রোগভোগে মারা যান তার কোন হিসেব নেই। শীত এলেই প্রতিবার ভাবি এবার বসন্তে আমার মত বেশ কিছু বিষণ্ণ মানুষগুলোকে আর দেখতে পাব না। নিজেকে কিছুটা নির্ভার লাগে কারণ তাদের দুরারোগ্য সমস্যাগুলো আর শুনতে হবে না। মানুষগুলোও তাদের যন্ত্রণাময় বার্ধক্য থেকে মুক্তি পাবে।
যাব না যাব না করেও দেখতে গেছি বাড়িতে। জানি গিয়ে লাভ নেই। তবু বাড়ির লোক ছাড়বে না। ক’দিন আগেই ছেলে লাইফ সার্টিফিকেটে সই করিয়ে নিয়ে গেছে। ওই টাকায় অনেকটাই ওদের সংসার চলে। ছেলের কাজ বড় কঠিন, মাইনেও কম। তাই মায়ের জীবনটাও খুব মূল্যবান। বিগত কয়েক বছর ধরে ওই সার্টিফিকেট লেখার সময় প্রতিবারই ভাবি এবারই হয়ত শেষ। বাড়ি গিয়ে ভাবি আর হয়ত আসতে হবে না- কিন্তু ঈশ্বরের কৃপাই বলুন বা তার বউমার অসম্ভব সেবাই বলুন উনি বারবার আমাকে ভুল প্রমাণিত করেছেন। এবারও দেখতে গিয়ে তাই মনে হয়েছিল। এবারই হয়ত শেষ।
বাড়িতে যখন দেখতে গেছি একটি মেয়ে তাকে তখন সবে ক্যাথেটার পরিয়েছে। ইউরিন আটকে গিয়েছিল। ব্লাডার ওয়াশ দিয়েও কাজ হয় নি। তাই পালটে দিয়েছে। সারা গায়ে একটুও কাপড় নেই। বুকের কাছে সায়াটা জড়ো করা। ঘরে ছেলে বউ ছাড়াও দুজন বাইরের লোক। মহিলার এই সীমাহীন নগ্নতা কারোর মনেই কোনো অস্বাচ্ছন্দ সৃষ্টি করছে না। এটাই বার্ধক্যের অভিশাপ। আগে যখন ওনাকে দেখতে আসতাম মাঝে মাঝেই পা ফুলে যায় বলে ওনার পা টিপে দেখতাম। পায়ের ওপরের শাড়ি সামান্য তুলে তিনি আবার পা ঢেকে দিতেন। আজ এমনভাবে শুয়ে আছেন, হয়ত সচেতনও আছেন কিন্তু বিরুদ্ধতার কোনো শক্তি আর তার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। তার সব লজ্জা আব্রু আজ অর্থহীন হয়ে গেছে।
একদম শ্বাস নিতে পারছেন না। বললাম একটা অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে। যতদিন বাঁচে। বললাম আজ বা হয়ত কালই। সামনেই বললাম। ভুল শুধরে নিতে তার দিকে টাকাতেই দেখলাম কপালে যেন হালকা কুঞ্চন। তিনি কি আমার কথা শুনতে পেয়েছেন? হয়ত পেয়েছেন। অথচ আমি কেমন সাবলীলভাবে তার সামনেই বলে ফেললাম। উনি অনেকদিন কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। তা বলে এমন তো নয় যে তিনি শুনতে পাবেন না। আগামি কয়েক ঘন্টা বা কয়েকদিন তাঁর বেঁচে থাকাটাকে আমি আরো উৎকন্ঠার মধ্যে ফেলে দিলাম। ডাক্তার হিসেবে এই ভুল আমরা বারবার করি।
যে বাড়িতে একজন মানুষ দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ থাকেন সেই বাড়িতে সবাই নিজেদের অজান্তেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। সকলের বয়স সময়ের তুলনায় বেড়ে যায়। নিঃসন্তান এই দম্পতির বয়স মহিলাকে পনের বছর সেবা করতে করতে কম করে পঁচিশ বছর বেড়ে গেছে। একজনের সুগার প্রেসার ধরা পড়েছে। অন্যজনের দুটি হাঁটুতেই নি রিপ্লেসমেন্ট হয়ে গেছে। শুধু মানুষ নয় বাড়ির এমনকি ঘরেরও বয়স বেড়ে গেছে। দোতলার ঘর। একতলাটা ভাড়া দেয়া হয়েছে ভবিষ্যতের কথা ভেবে। গরমকালে ঘর যেমন গরম থাকে এখন তেমনই ঠান্ডা। দরজা খুলে রাখা হয়েছে ইউরিনের কটু গন্ধ যাতে বেরিয়ে যেতে পারে। কিন্তু তাতে তার গায়ে বরফের মত শীতলতা এসেছে। হাত-পা এত ঠান্ডা আমি বললাম একটু গরম সেঁক করতে। প্রেসার মাপাই গেল না এতটাই কম। মুখের কাছে একটু আগে খাওয়ানোর জন্য চেষ্টা করা তরল খাবার লেগে আছে। বললাম মুছিয়ে দিতে। সারা ঘরে অসুস্থতার জঞ্জাল। সারা জীবনে বেঁচে থাকার অর্থহীন প্রচেষ্টা যা আমরা করে যাই, আমরা ডাক্তারেরা যার বেসাতি করে উপার্জন করি- সব আড়ম্বরপূর্ণ ঢক্কানিনাদ মৃতপ্রায় মানুষটিকে তীব্রভাবে ব্যঙ্গ করে চলেছে। সেই নগ্নতা আমার দিকে তাকিয়ে অট্টহাস্যে ফেটে পড়ছে। তবু ভালো যে এই অবস্থায় ভেন্টিলেটর, সাকার মেশিন, ডায়ালিসিস এসব গালভরা গোলগাপ্পার দিকে ঠেলে দেবার ক্ষমতা তার ছেলের নেই। তাই এই সামান্য অক্সিজেনের প্লাস্টিক টিউব নাকে নিয়েই সম্ভবত তিনি নিজের বাড়িতে, যা ছেড়ে তিনি কোনোদিন পাড়ার রাস্তাতেও হাঁটেন নি, চলে যাবেন।
জানি এবার হয়ত ভুল হবে না। তবু উনি বলেই একটা সংশয় ছিল। দুদিন পরে ছেলে ফোন করে জানালো, মা আর নেই।