আবার মার্কেজের ‘লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা’ উপন্যাসের কথা চলে আসছে কারণ এই অসাধারণ লেখাটা সবে পড়া শেষ করেছি। ডাক্তার জুভেনাল উর্বিনোর ভরভরন্ত সংসার। সুন্দরী স্ত্রী, উপযুক্ত শিক্ষিত দুই ছেলেমেয়ে, বাড়ি ভরতি চাকর-বাকর, সমাজ ও কর্মক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ প্রতিষ্ঠা- তার জীবনে আর সম্ভবত নতুন করে পাবার আর কিছুই নেই। বিভিন্ন রকম সামাজিক, ধার্মিক ও রাজনৈতিক দায়িত্বে নিজেকে জড়িয়ে রেখে সকলের চোখে তিনি ও তার স্ত্রী ফার্মিনা একটি আদর্শ দম্পতি হয়ে উঠেছেন। এহেন উর্বিনো প্রায় ছাপ্পান্ন বছর বয়সে এসে বছর চব্বিশের এক ডিভোর্সি মুলাট্টা যুবতীর প্রেমে পড়লেন। ওই বয়সে যা হয়- পুরোটাই দেহজ প্রেম, হৃদয়ের ছিঁটেফোঁটাও কোথাও নেই।
তার এই পরকীয়ার কাঁটা তার কাছে এতটাই যন্ত্রণাদায়ক ছিল যে তিনি সকলের থেকে অনেক কৌশলে তাকে গোপন রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যান। তা থেকে বেরিয়ে আসারও আপ্রাণ চেষ্টা করে যান কিন্তু কিছুতেই সফলতা লাভ করতে পারছিলেন না। এসব ক্ষেত্রে যা হয় বাড়িতে তার মেজাজ চড়ে যাচ্ছিল, খাবারে রুচি কমে আসছিল, ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে ফার্মিনা ও চাকরদের সঙ্গে মাথা গরম করে ফেলছিলেন। মুলাট্টা মেয়েটি কিন্তু তার পেশেন্ট ছিল। তিনি কোনোদিনই চেম্বারে রুগি দেখতেন না। হাসপাতালে ছাত্র পড়িয়ে বাড়ি ফিরে তার ঘোড়াগাড়ি করে দুপুরে সিয়েস্তার পর কিছুক্ষণ সাবেক ফরাসি নভেল পড়ে তিনি রুগি দেখতে বের হতেন। এই দুপুর গড়িয়ে বিকেলের সময়টাতেই হাউজ কল করে রুগি দেখার মাঝেই তার রঁদেভু চালু থাকল। স্বাভাবিকভাবেই হাতে সময় খুব কম থাকত। কামনার তাড়নায়, গোপনীয়তা রক্ষার দায়ে, ঘর্মাক্ত কলেবরে খুব কম সময়েই কাজটি সেরে তিনি বাইরে বেরিয়ে আসতেন।
এমন চলছিল বেশ কিন্তু তার স্ত্রী ফার্মিনা ছিলেন অন্য ধাঁচের নারী। তার একটা স্বভাব ছিল বাড়ির সকলের বিশেষ করে স্বামীর ছাড়া কাপড়-জামা এমনকি অর্ন্তবাস পর্যন্ত তিনি নিজে শুঁকে দেখতেন তাকে ধুতে দেবেন কিনা। এই কাজটি তিনি তার বিয়ের পর থেকেই করে আসছেন। এই ঘ্রাণবিচারে তিনি এতটাই দক্ষ ছিলেন যে একবার তার হারিয়ে যাওয়া শিশু সন্তানকে শুধু গন্ধ শুঁকে তিনি বাড়ির ভেতর থেকে ঘুমন্ত অবস্থায় খুঁজে বের করেন। ডাক্তারবাবু বউয়ের এই শোঁকাটোকা একদম পছন্দ করতেন না। কিন্তু বৌকে তিনি এতটাই ভয় ও সমীহ করতেন যে তার পক্ষে এর বিরোধিতা করা সম্ভব ছিল না।
এহেন স্নিফারডগের মত ক্ষমতাশালী ফার্মিনা তার বরের ছাড়া জামায় একদিন প্রথমবার অন্য নারী ও বিছানার গন্ধ পেলেন। তারপর মাঝে মাঝে পেতে শুরু করলেন। এরপর ধারাবাহিকভাবে পেতে থাকলেন। বরকে কিচ্ছু না জানিয়ে তিনি এর অনুসন্ধান শুরু করলেন। কিছু পেলেন না কিন্তু বরের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলেন। তাদের বেডরুমে শ্মশানের নীরবতা বিরাজ করতে লাগল। ডাক্তারবাবু স্ত্রীর ব্যবহারে কিছু একটা অনুমান করছিলেন কিন্তু জিজ্ঞাসা করার সাহস হচ্ছিল না। একদিন যখন উর্বিনো তার সিয়েস্তার শেষে হ্যামকে শুয়ে নভেল পড়ছেন তখন কাপড়-জামা মেলতে এসে কপালে চশমা তুলে ফার্মিনা শুধু জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার ডাক্তারবাবু? স্ত্রীর ওই মুখভঙ্গী দেখেই তিনি বুঝে নিলেন যে তিনি ধরা পড়ে গেছেন। এরপর বউকে সব জানিয়ে আত্মসমর্পন ও ক্ষমাপ্রার্থনা করলেন। ফার্মিনা সহজে তাকে ক্ষমা করেন নি। ঘরের এক চাকরানিকে সঙ্গে নিয়ে টানা দুবছর বাড়ি ছেড়ে তার এক তুতো বোনের খামারবাড়িতে কাটান। যে উর্বিনো বউ ছাড়া সম্পূর্ণ অচল ছিলেন তিনি এই দুই বছর সংসার সামলাতে পুরো ল্যাজেগোবরে হয়ে পড়েন।
এ তো ছিল খুব মোটাদাগের বর্ণনা। যারা বইটি পড়েছেন তারা নিশ্চই আমার সাথে একমত হবেন যে কী অসাধারণ মুন্সিয়ানায় মার্কেজ এই অংশটার বর্ণনা করেছেন। এবার আসি কাজের কথায়। যদিচ পরকীয়ায় মত্ত উর্বিনোর সাথে আমার বর্তমান বয়সের পার্থক্য প্রায় দশ বছর তবুও ভেবে নিলাম এই বয়সেই আমি হঠাৎ করে এক পরকীয়ার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছি। উর্বিনোর সেই মেয়েটির মত আমারও হয়ত তিনি পেশেন্ট। সবটাই ধরে নেওয়া। কারন আজ পর্যন্ত যারা আমাকে দেখিয়েছেন তাদের মধ্যে অনেকেই যথেষ্ট আকর্ষণীয়া হলেও কারোর সাথে প্রেম শুরু করার মত তাড়না বিবাহিত অবস্থায় আমি কখনও বোধ করি নি। ধরলাম হল। উর্বিনোর চরিত্র যেমন দেখিয়েছেন মার্কেজ তার পক্ষেও পরকীয়ায় জড়ানো খুব কঠিন ছিল। তার স্ত্রী ফার্মিনা পর্যন্ত তার আবিষ্কারের পরে অবাক হয়ে গেছিলেন। আমার ক্ষেত্রেও ধরলাম হল। সেই ব্রাহ্মমুহূর্তে অ্যানাটমি ফিজিওলজি বায়োকেমিস্ট্রি মিলে এমন একটা কিছু হল যে পা পিছলে গেল। এরপর কী হবে? যে সময়ের কথা মার্কেজ লিখেছেন তখন অটোমোবাইল আসে নি, টেলিফোন আসে নি। মানুষের পক্ষে গোপনীয়তা রক্ষা করার অনেক উপায় ছিল। আজকের দিনে কি সেটা আদৌ সম্ভব? বিশেষ করে মোবাইল নামক যন্ত্রটির সাথে সাথে সোশ্যাল মিডিয়া ও হোয়া এসব চলে আসায় আমাদের জীবনে গোপনীয়তা অসম্ভব কমে গেছে। এখনকার দিনে বিবাহিত সম্পর্কগুলো যে এত ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে তার একটা অন্যতম কারণ এই গোপনীয়তার অভাব। এই খোলা বারান্দার মত সমাজে কি আদৌ আমার মত ছোট জায়গায় আটকে থাকা ডাক্তারবাবুর পক্ষে আদৌ পরকীয়া করা সম্ভব?
কথার কথা যদি ধরেও নিই যে আমি একটি শুরু করেছি আমার বউয়ের পক্ষে তাকে আবিষ্কার করতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হবে না। ঠিক কোনো না কোনোভাবে কিছুদিনের মধ্যেই সে জেনে যাবে। তা বলে ভাববেন না যে সে জামাকাপড় শুঁকে তা আবিষ্কার করবে। যত বয়স বাড়ছে ততই বাড়ছে তাই শুচিবাই। তাই অমন কাজ করা থেকে সে একশ হাত দূরে থাকে। ফার্মিনার মত সে কপালে চশমা তুলেও কোনোদিন অমন নাটকীয়ভাবে জিজ্ঞাসাও করবে না, কী ব্যাপার ডাক্তারবাবু? সে বাংলা চেঁচিয়ে বাড়ি মাত করে বিপজ্জনকভাবে ভায়োলেন্ট হয়ে উঠে মেয়ের হাত ধরে সাময়িকভাবে বাপের বাড়ি গিয়ে তার পরবর্তী ঘুঁটি সাজাবে।
আমার আপনার স্ত্রী যাদের দেখে আমাদের মনে হয় তারা খুব শান্ত, সরল এবং সমব্যথী তারা সম্ভবত নারী চরিত্র জানি না। মেয়েদের ঈশ্বর অসম্ভব কঠিন হৃদয়ের অধিকারী করে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তাতে তাঁর বা আমাদের কী লাভ হয়েছে জানি না কিন্তু সাহিত্য ও শের-সায়রী-সঙ্গীতের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। আমার উনি ফার্মিনার মত অবস্থায় পড়লে আর পাঁচটা মেয়ের মতই যতক্ষণ না আমাকে ভয়ঙ্কর একটা আঘাত করতে পারছেন ততক্ষণ শান্তি পাবেন না। আর আমি যে কিনা বয়সের তাড়নায় ও কামজ উত্তেজনায় পা পিছলে ফেলেছি- তার মান-সম্মান-অর্থ-যশ সব কিছুই গোল্লায় যাবে। এমন উদাহরণ আমার দেখা বেশ কিছু ডাক্তারবাবুদের মধ্যে দেখেছি। অনেকে হয় তার এলাকাই ছেড়ে অন্যত্র নতুন করে শুরু করেছেন নয়ত পুরনো এলাকাতেই পড়ে থেকে অতীতের সুখস্মৃতিচারণ করে চলেছেন।
উর্বিনোর ক্ষেত্রে কোনোটাই হয় নি। তিনি সেই মুলাট্টা মেয়েটিকে একখানি রুবির নেকলেস উপহার পাঠিয়ে বিষয়টার নিষ্পত্তি করেন। তাঁর স্ত্রী কোথাও এটি নিয়ে মুখ খোলেন নি। যদিও স্ত্রীর চোখে চিরকালের জন্য তিনি স্খলিত মানুষ হয়েই রয়ে যান। যদিও স্বামীর প্রতি দায়িত্ব ও ভালোবাসা কোনোটাই ফার্মিনার কমে নি বরং ডাক্তারবাবু যখন পালিয়ে যাওয়া কাকাতুয়াটিকে ধরতে গিয়ে মইয়ে উঠে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে গেছেন তখন ফার্মিনাকে শুধু এইটে বলার জন্য তিনি ক্ষণিক বেঁচে ছিলেন যে তিনি তাকে কতটা ভালোবাসেন।
যারা এই লেখা পড়ে ভাবছেন এটা সম্ভবত ডাক্তারবাবুর পরকীয়া শুরুর প্রবেশক তাদের জন্য মার্কেজ আরো সুন্দর করে বলেছেন। চিরকাল কন্সটি সমস্যায় ভোগা ফ্লোরেন্টিনো অ্যারিজার গডফাদার যিনি পেশায় ডাক্তার তিনি বলছেন এই পৃথিবীতে দুই রকমের লোক আছে, One who can shit and one who cannot. আমি আমার পেশায় শয়ে শয়ে আই.বি.এস.-এর রুগি দেখে এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে এই দলে আরেকটি দল থাকা দরকার, one who does not want to – হাগু করে করে তারা এত ক্লান্ত যে তারা চান আর না অনেক হয়েছে। ফ্লোরেন্টিনো যিনি কিনা প্রতি রাতেই যৌন রঁদেভুতে বের হন তিনি এই জগতের মানুষদের দুটি ভাগে ভাগ করেছেন, One who can screw and one who cannot. রসিক পাঠককে নিশ্চই ‘স্ক্রু’-এর অর্থ বলার প্রয়োজন নেই। ফ্লোরেন্টিনো বলছেন যারা এই কাজটা ঠিকঠাক করতে পারেন না তাদের মুখে সবসময় এই নিয়েই কথা। যৌনতা নিয়ে তাদের কপচানোর কোনো শেষ নেই। আর যারা এই কাজে পটু তারা একদম নীরব। এই নিয়ে কোনো কথাই বলেন না কারণ তারা জানেন এই কাজ চালিয়ে যাবার প্রধানতম উপায় হল নীরব থাকা, উদাসীন থাকা। গোপনীয়তাই এই কাজের অন্যতম শর্ত। আমার জীবনে আমি এমনটি বেশ কিছু লোকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি।
তাই যারা এই লেখাকে ডাক্তারবাবুর প্রবেশক ভাবছিলেন তারা এতক্ষণে এটা নিশ্চয় বুঝে গেছেন যে এটি আধবুড়ো ডাক্তারের আত্মপ্রবঞ্চনা বই কিছু নয়।