গতকাল একজন দেখাতে এসেছিলেন তার হঠাৎ করে বুকের বাঁদিকে ব্যথা শুরু হয়েছিল। কিছুক্ষণ থাকার পরে কমেও যায়। তবু তিনি এসেছিলেন কারণ বুকের বাঁদিক বড়ই ভয়ের জায়গা। কবি নীরেন চক্কোত্তি তার এক কবিতায় সম্ভবত বলেছিলেন, লোকটি সারাজীবন তার বুকের বাঁদিকের চিন্তা নিয়েই কাটিয়ে গেল। অথচ সে যদি আরেকটু গভীরে যেত তবে পেয়ে যেত আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। এই ক্ষেত্রে তিনি যে বুকের বাঁদিকের বুক পকেট আর হৃদয়ের কথা বলতে চেয়েছেন তা নিশ্চই আলাদা করে বলার দরকার নেই। আমরা ডাক্তারেরা কিন্তু মানুষের এই আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের শিখার কেঁপে ওঠা নিয়ে অসম্ভব ব্যগ্র থাকি।
ইসিজি করেই এনেছেন। তেমন কিছুই নেই। আমারই দেয়া প্রেসারের ওষুধ খাচ্ছেন প্রায় দশ বছর। স্বাস্থ্য সুন্দর। বললাম ভয়ের কিছুই নেই। ওই চালিয়ে যান। মঙ্গলবারের চেম্বার। অন্য হপ্তায় বন্ধ থাকে। তাই ভিড় নেই। ভদ্রলোক একটু গুছিয়ে বসলেন। তার স্ত্রীর কথা বলতে শুরু করলেন। তিনিও আমার রুগি। প্রেসার আর সুগারের ওষুধ চলছে। তার সাথেই ওনার মারাত্মক এক সমস্যা আছে। সেটি ওনার মনের অসুখ। এ ক্ষেত্রে যা হয় কিছুতেই ডাক্তারের ওষুধ খাবেন না। ভদ্রলোক জোর করে বারাসাতের একজন সাইক্যাট্রিস্টের কাছে ১২০০ টাকা ভিজিট দিয়ে বেশ কয়েকবার নিয়ে গেছেন। লাভ তেমন কিছু হয় নি। উনি ওষুধই খেতে চান না। ১২০০ টাকার কথাটা উনি বেশ জোরের সাথেই বললেন।
ওনার মূল সন্দেহের লক্ষ্যবস্তু দোতলায় থাকা তার ছোটজা। তার উদ্দেশ্যে দিবারাত অশ্লীল গালাগালি দিয়ে চলেছেন। সব সময় তার মনে হয় সে তার খাবার জলে বিষ মিশিয়ে দিচ্ছে। আমি তাকে বললাম, দেখুন উনি যখন ওষুধ খাবেন না তখন ওনার সন্দেহ কমাতে ওনাকে কোনো গুনিনের কাছে নিয়ে যান।
উনি আমার কথা শুনে কিছুটা অবাক ও কিছুটা প্রসন্ন হলেন। শুনলাম এর মধ্যেই বেশ কয়েকবার তাকে নিয়ে ডানলপের কাছে ঠিক গুনিন নয় তবে এক সাধক কাম তান্ত্রিকের কাছে গেছেন। তিনি নাকি একমাত্র ওনার ‘ওষুধ’ই খেতে চান। ওনার ‘চিকিৎসা’র ওপরেই তার আস্থা আছে। ভদ্রলোক আড়ালে গিয়ে সেই তান্ত্রিকের সঙ্গে কথা বলেছেন।
– দেখুন আমিও মায়ের ভক্ত। আপনিও মায়ের ভক্ত। আমার জন্য আপনি কিছু একটা করুন দয়া করে।
– আমার যা করার আমি তো করে দিয়েছি। ওনার ব্যবস্থা করে দিয়েছি যাতে আর জলে বিষ মেশানো না হয়। উনি নিজেও সেটা বুঝতে পেরেছেন। যে জলপড়া দিয়েছি তা ছড়িয়ে দিলে কারোর ক্ষতি করার ক্ষমতা নেই। জলপড়া খেলে উনি নিজেও বিপদ থেকে বাঁচতে পারবেন।
– উনি একমাত্র আপনার ওপর আস্থা রাখেন। আপনার কাছেই আসতে চান। আর কোথাও যাবেন না।
– আমার আর কিছু করার নেই। আপনি বরং ওনাকে অন্য সমস্যার জন্য ডাক্তার দেখান।
ভদ্রলোক তান্ত্রিকের এই কথা শুনে খুশি হয়েছেন যে তিনি তাকে অন্তত ডাক্তার দেখাতে বলেছেন। বলেন নি, এটা পরুন ওটা লাগান। কেবল একটা রুপোর পাত্র দিয়েছেন। তাতে জলপড়া রাখতে বলেছেন।
কথা হল জলপড়া ব্যবহার করে, তান্ত্রিককে পয়সা দিয়ে উনি কি নিজের ও তার স্ত্রীর ক্ষতি করছেন? এমন অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আজকের দিনে কারোর কি বিশ্বাস রাখা উচিত?
আমাদের বাড়িতে যে দিদি দিনে প্রায় ছয় ঘন্টা কাজ করেন তিনি মতুয়া সম্প্রদায়ের। তার মেয়েকে গত আট বছরে তিনবার বিয়ে দিয়েছেন। মেয়েটির বয়স এখন পঁচিশ-ছাব্বিশ। প্রথম জামাইয়ের তার বৌদির সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। বিয়ের পরে তার এইচ আই ভি ধরা পড়ে। দ্বিতীয় জামাইয়ের তার প্রথম পক্ষের সাথে আইনি বিচ্ছেদ হয় নি। তার একমাত্র উদ্দেশ্য শ্বশুরবাড়ি থেকে টাকা হাতানো। তৃতীয় জামাই তাদের সম্প্রদায়ের। এটি তার দ্বিতীয় পক্ষ। সে কাজ কর্ম না করে সারাদিন শুয়ে থাকা আর কীর্তন করাতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। মেয়েটির দুটি সন্তান। একটিকে গর্ভপাত করে আটকানো গেছে। মেয়েটি এখন তার দুই সন্তান নিয়ে বছরের এগারো মাস বাপের বাড়িই থাকে।
তার হঠাৎ করে পায়ে জোর না পেয়ে পড়ে যাওয়ার অসুখ হয়েছে। আমি বললাম একদিন নিয়ে আসতে। দেখব। দিদির স্থির বিশ্বাস ‘কেউ ওরে বশ করসে’। সেই বশীকরণ থেকে মুক্ত করতে দিদি মেয়েকে নিয়ে প্রতি মঙ্গলবার কৃষ্ণনগর যাচ্ছেন। সাম্প্রতিক আপডেট হল, ওষুধে কাজ করা শুরু করেছে।
আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয়ের দশ আঙ্গুলে আটটি আংটি। সে নিজে এম বি এ। বিয়ে করার পরে সে তার বউকেও ওই আটটি আংটি পরিয়ে দিয়ে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করেছে। তার দিদির এবার স্কুলে বদলির চিঠি আসায় সেই দুঃসময়ে দিদিকে তার সেই পরিচিত জ্যোতিষের কাছে নিয়ে গেলে তিনি দিদিকে এক লাখের ওপরে দামের পাথর দিয়ে তার বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় করে দিয়েছেন।
আমার কাছে একজন বৃদ্ধ মানুষ ও তার পরিবার প্রায় দশ বছর ধরে দেখাচ্ছেন। ফোন ধরলেই বলেন, ডাক্তারবাবু আমি বিশ্বাস বলছি। ওনার বয়স প্রায় পঁচাশি। ওনার কথা শুনলেই আমার আরেকজনের কথা মনে হয়, ‘ডাক্তারবাবু আমি খাঁ বলছি’। হঠাৎ পরীক্ষা করাতে গিয়ে দেখি ওনার লিভারে মাল্টিপল মেটাস্টেটিক ডিপোজিট। সম্ভবত অন্য কোনো জায়গায় ক্যান্সার লিভারে ছড়িয়ে গেছে। যদিও আপাতভাবে তার কোনো সমস্যা নেই।
– কী করব ডাক্তারবাবু?
– রাজারহাটে টাটা সেন্টারে গিয়ে দেখান।
একদিন গেছিলেন। চিকিৎসার ঝামেলা আর টাকার কথা শুনে হোমিও শুরু করেছেন। কোথায় একজন লেডি ডক্টর দেখান। সকালে বেরোতে হয়। রাতে ফেরেন। সঙ্গে নিয়ে আসেন প্রায় হাজার দশেক টাকার ওষুধ। এমনিতে মনে হয় নির্ভয়। কিন্তু নাক দিয়ে রক্ত বেরোলেই ভয় পান। ফোন করেন। সময় কী এসে গেল?
এই যে মানুষেরা জলপড়া করছেন, ঝাড়াচ্ছেন, হাতে আংটি পড়ছেন, ক্যানসারে হোমিও করছেন, তারা কি ঠিক করছেন? এই প্রসঙ্গে আমি আমার মতামতটাই শুধু বলতে পারি। মানুষ অপচিকিৎসা বা প্রথার বাইরে তখনই যান যখন তার করার কিছু থাকে না। আমার বাড়িতে যে কাজ করে সে যদি হাসপাতালে দেখাতে যায় তবে কলকাতায় আসা-যাওয়া, পরীক্ষা, ওষুধ বাবদ তার যে খরচ হবে সে ব্যয়ভার বহন করা তার পক্ষে অসম্ভব। যেহেতু মেয়েটির ওপর দিয়ে প্রচুর ঝড়-ঝাপটা গেছে তাই সে হয়ত যাকে আগে বলা হত ‘হিস্টিরিয়া’ তেমন কোনো রোগের শিকার। সে ক্ষেত্রে ঝাড়ফুঁকে তা সেরেও যেতে পারে। পড়েছি আগেকার দিনে হিস্টিরিয়ার চিকিৎসা নাকি ইন্টারকোর্সের মাধ্যমে করা হত। এক্ষেত্রে তার থেকে তো ভালো। এই কয় বছরে এটুকু উন্নতি তো হয়েছে। কারন অভিনয়ের চিকিৎসা এক্ষেত্রে অভিনয়। আর যদি সত্যিই তার কোনো নার্ভের অসুখ হয়, যেটি নিঃসন্দেহে খুব প্রচলিত নয় জটিল, সেক্ষেত্রে তার উপশম হবে না। মেয়েটি তার মায়ের আরো বড় বোঝা হয়ে যাবে। ওই যে বললাম ওদের কিছু করার নেই। তাই ওরা বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরেছে।
বিশ্বাসবাবু এই পঁচাশি বছর বয়সে নিজেকে আর আধুনিক রোগমুক্তির গিনিপিগ বানাতে চাইছেন না। সেই কষ্ট সহ্য করার থেকে উনি ক্যানসারের ব্যথা না হয় কিছুদিন সহ্য করে নেবেন। ওনার স্ত্রী জীবিত। যা কিছু আছে সর্বস্ব শেষ করে দিলে স্ত্রীর হাতেও কিছু থাকবে না। ছেলেদের ঋণও বেড়ে যাবে। তাই হোমিওটা ওনার চয়েস। উনি কি হোমিওতে সুস্থ হবেন? একদম না। উনি কি অ্যালোতে সুস্থ হবেন? একশ শতাংশ না। তাই হোমিও ওনার চয়েস। আমি ওনার সিদ্ধান্তকে মান্যতা দিই।
আমাদের সেই এম বি এ কাম ইঞ্জিনিয়ারবাবু কিন্তু বিয়ের পরে অনেক প্রাণবন্ত হয়েছে। তার সাময়িক অবসাদ কেটে গেছে। সম্প্রতি বাবা হয়েছে এবং জীবনের দিকে প্রবল পজিটিভ এনার্জি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তার না হয় এক্ষেত্রে লাখ তিনেক টাকা খরচা হয়েছে। না হয় সে বিশ্বাস করেন গ্রহ নক্ষত্র থেকে বিশেষ কিছু রেডিয়েশন আসে যাকে হাতের পাথরগুলো গ্রহণ করে শরীরে ছড়িয়ে দেয়। আপনার আমার হাসি পেতে পারে। তাতে তার কিছু আসে যায় না। কে এই পৃথিবীতে ঠিক বলুন তো? এত বছর ধরে শুনে এলাম যে ‘বিগ ব্যাং’ তত্ত্ব এখন তো শুনছি সেটিও নাকি ভ্রান্ত হতে পারে। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ এমন সব ছবি তুলেছে যা থেকে নিশ্চিত ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি আরো অনেক অনেক প্রাচীন। কেউ আগ বাড়িয়ে বলছেন আমাদের মহাবিশ্ব নিজেই নাকি একটা ব্ল্যাক হোলের মধ্যে আছে। ভাবুন। কী বলবেন?
যিনি তার স্ত্রীকে জলপড়া নিতে তান্ত্রিকের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি সমগ্র বিবাহিত জীবনে ক্লিষ্ট হতে হতে জেনেছেন এ ছাড়া তার উপায় নেই। চিকিৎসা করালে কী উনি সুস্থ হতেন? ওনার গালাগালি দেয়া, উত্তেজনা সাময়িক প্রশমিত হত। উনি এক ঝিমন্ত চিড়িয়াখানার প্রাণীতে পরিণত হতেন। সেটা অবশ্যই অনেকটা, কানার মধ্যে ঝাপসা কিন্তু সেটাও তো করা যাচ্ছে না। কিছু তো করাতে হবে! তাই জলপড়া।
এই পৃথিবী একটা অবাস্তব জায়গা। এখানে কোনো কিছুকেই কারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। আমরা এই পৃথিবীতে সুখ-অসুখে কিছুকাল ব্যস্ত থাকার জন্য এসেছি। যেদিন আমাদের অভিনয় শেষ হবে সেদিন শান্তি। ওইটুকুই নিশ্চয়তা যে একদিন মৃত্যু বিলক্ষণ সেই শান্তি এনে দেবে।