“Our knowledge can only be finite, while our ignorance must necessarily be infinite.”
“In so far as a scientific statement speaks about reality, it must be falsifiable; and in so far as it is not falsifiable; it does not speak about reality.”—Karl Popper.
“আমাদের জ্ঞান একটা নির্দিষ্ট সীমার বেশি কখনই হতে পারে না, যেখানে আমাদের অজ্ঞতা সীমাহীন”।
“যখন কোনো বৈজ্ঞানিক উক্তি বাস্তবতার সাথে যুক্ত থাকে তাকে সহজেই ভুল প্রমাণ করা যায়। আর যদি তাকে ভুল প্রমাণ না করা যায় তবে বুঝতে হবে তা কখনই বাস্তবতার সাথে যুক্ত নয়”। — কার্ল পপার।
করোনাকাল যতদিন ধরে শুরু হয়েছে তবে থেকেই আমার রুগিরা আমাকে এসে একটাই কথা জিজ্ঞাসা করে ডাক্তারবাবু ভ্যাকসিন কবে বের হবে? আমরা নিজেরাও সংবাদপত্র, জার্নাল, ইন্টারনেট সব জায়গায় খোঁজ রেখে চলেছি ভ্যাকসিনের গবেষণা কতদূর। আমি নিজে কোভিড ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা রুগিদের চিকিৎসা করছি না কিন্তু গত ছয়-সাত মাস ধরে যারা কোভিডে আক্রান্ত হলেও বাড়াবাড়ি তেমন হয় নি সেইসব অগণিত রুগিদের আমি বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করে চলেছি। তাই কোন রুগির কোভিড কতদূর যেতে পারে তা বোঝার একটা প্রাথমিক ধারণা আমার তৈরি হয়েছে।
আমরা যেসব ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করছি তাদের নাম ইতিমধ্যেই খবরের কাগজ বা টিভির দৌলতে নিশ্চই সবাই জেনে গেছেন। বিভিন্ন ওষুধের রেজিম আছে, তাদের প্রোটোকল আছে- ডাক্তারবাবুরা তা অনুসরণ করে চিকিৎসা করে চলেছেন। কিন্তু একটা কথা এক কথায় সবাই নিশ্চই স্বীকার করবেন যে এই চিকিৎসার পদ্ধতি নিয়ে আমাদের মধ্যে বিভ্রান্তি চরম। সেই একই কারণে আমাদের রুগিরা যারা আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আমাদের ভগবান বলে মনে করেন, আমাদের বিশ্বাস করেন তাদের কাছে আমরা খুব উৎসাহব্যঞ্জক কিছু তুলে ধরতে পারছি না। আমরা তাদের আর কি বলব নিজেরাই চিকিৎসার বিভ্রান্তিতে জেরবার হয়ে যাচ্ছি।
কোভিড যখন শুরু হয় ‘হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন’ নিয়ে একপ্রস্থ বিরাট নাটক হয়ে যায়। আমেরিকান প্রেসিডেন্টের সেই কুখ্যাত টুইট এবং তার প্রেক্ষিতে আমাদের দেশীয় রাজনীতি কিছুদিন উথালপাথাল হয়ে গেল। দোকানে ওষুধ পাওয়া গেল না। লোকে পাগলের মত হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কিনে খেতে শুরু করল। আমাদের ডাক্তারদের মধ্যেও এই নিয়ে বিভাজন হয়ে গেল। কেউ কেউ সেই ‘প্রোফাইল্যাক্সিস’ নিতে শুরু করলেন কেউ তাকে গুরুত্ব দিলেন না। উভয় পক্ষেরই নিজস্ব যুক্তি ছিল। শেষে দেখা গেল সেই ‘প্রোফাইল্যাক্সিস’ যারা নিয়েছেন বা নেন নি উভয়পক্ষেরই কোভিডে আক্রান্ত হবার সংখ্যা তেমন কিছু আলাদা নয়। তাই ওষুধটি যে কতখানি কাজ করছে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে।
হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের সাথে আরও দু-তিন রকম ওষুধ দিয়ে আমি আমার রুগিদের বাড়িতে চিকিৎসা করছি। ভাগ্য ভাল যে এই ওষুধগুলো খুবই সস্তা। তাই আমার মফস্সলের রুগিদের তা কিনে খেতে অসুবিধে হচ্ছে না। আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন আমি এক কথায় স্বীকার করব এই ওষুধগুলো সত্যিই কি কাজ করে বা আদৌ কিছু কাজ করছে কিনা আমার সীমিত জ্ঞানে আমি নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারব না। কিন্তু আমি যেহেতু ডাক্তার এবং ‘কিছু না দেবার থেকে কিছু ওষুধ’ আমাকে দিতেই হবে- তাই প্রোটোকল অনুসরণ না করার ধৃষ্টতা আমি কিছুতেই দেখাতে পারি না।
যারা খুব খারাপ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন তাদের অন্যসব ওষুধের সাথে ডাক্তারবাবুরা রেমডিসিভির দিয়ে চিকিৎসা করছেন। এই ওষুধ অসম্ভব দামি। তারপর খুব কালোবাজারি হচ্ছে। ফলে এর দাম আরও বেড়ে গেছে। ভারত সরকার এর দাম নিয়ন্ত্রণে কিছু রাশ টেনেছেন তবে কারো সর্বনাশ হলেও সেই সুবাদে কারো পৌষমাসও এসে যায়। তাই পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব। এই কয়েকদিনের মধ্যেই তা নিয়ে অনেক রিসার্চ পেপার বেরিয়ে গেল। আমরা ডাক্তারবাবুরাও বিরাট ভরসা নিয়ে রেমডিসিভির ব্যবহার করা শুরু করলাম। কয়েকদিন আগে WHO তার পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে জানিয়েছেন এই ওষুধের কার্যকারিতা প্রায় কিছুই নেই। ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে শুরু করে ফেলুদার চিকিৎসা যে ওষুধে হল তার কোনো কার্যকারিতা নেই!
এই ওষুধ বিক্রিতে যেসব আমেরিকান কোম্পানির ‘পৌষমাস’ চলছে তারা জোরদার লবি শুরু করেছেন এটাই প্রমাণ করতে যে WHO চিনের পিপলস পার্টির দলদাস তাই তাদের রিপোর্ট বিশ্বাসযোগ্য নয়। সুতরাং আবার ধোঁয়াশা, আবার রাজনীতির খেলা। আমরা আবার নতুন নাটকের মঞ্চে প্রবেশ করতে চলেছি।
গত কয়েকমাস আগে থেকেই ‘প্লাজমা থেরাপি’ অর্থাৎ যাদের কোভিড হয়েছে এবং সুস্থ হয়েছেন তাদের রক্তরস নিয়ে কোভিড-আক্রান্ত অন্যের শরীরে দিলে ‘উল্লেখযোগ্য’ কাজ হচ্ছিল বলে ভাবা হচ্ছিল। কারণ রক্তরসে প্রচুর অ্যান্টিবডি থাকে। দিল্লির ডাক্তারবাবুরা বলছিলেন তারা এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করে খুব ভাল ফল পেয়েছেন। আমাদের কলকাতাতেও তাই এই থেরাপি চলতে থাকে। আজ সকালে খবরের কাগজ খুলে দেখছি গবেষকরা বলছেন, ধুর সব বাজে কথা। প্লাজমা থেরাপির কোভিডের চিকিৎসায় কার্যকারিতা শূন্য।
প্রশ্ন হল এটা কেন হচ্ছে? কেন এত বিভ্রান্তি? তার একমাত্র কারণ ‘আমরা জানি না’। আমরা জানি না কোভিড হঠাৎ কিভাবে এল? আমরা জানি না এটা কতদিন থাকবে? এটার ‘হার্ড ইমিউনিটি’ কতদিনে তৈরি হবে? আমরা জানি না এই ভাইরাসকে সঠিকভাবে মোকাবিলার উপায় কি? আমরা জানি না ভ্যাকসিন কবে আসবে? আসলেও তা কতটা কার্যকরী হবে? এই এক বিরাট না জানার মধ্যে আশার আলো যে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন এবং কোভিড এসে আমাদের আবার জানিয়ে দিয়ে গেল আমরা যে মনে করতাম আমরা চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির শিখরে বাস করছি অথবা আর ক’দিনেই হয়ত অমরত্বের কাছেও পৌঁছে যাব- সেই ধারণা কত ভ্রান্ত ও ভঙ্গুর।
সারা পৃথিবীর অবস্থা যদি এমন হয় তাহলে বুঝে দেখুন আমাদের দেশের বা আমাদের রাজ্যের কি অবস্থা। আমরা কোন বিভ্রান্তির চরমে বাস করছি। আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল এখানে গবেষণার অবস্থা ভয়ঙ্কর খারাপ। আমার মত চুনোপুটি ডাক্তারদের কথা ছেড়ে দিন যাদের আপনারা রোজ টিভি খুললেই দেখতে পান তাদের মধ্যেও খুব খুব কম সংখ্যায় ডাক্তারবাবুরা চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণার সাথে যুক্ত। আমরা তাই বই বা জার্নাল পড়ে পন্ডিত। যে কাজ আমেরিকায় হচ্ছে, ইউ কে তে হচ্ছে, জাপানে হচ্ছে আমরা হাপিত্যেশ করে তার দিকে চেয়ে বসে আছি। ‘এফ ডি এ’ যাকে ছাড়পত্র দিয়েছে আমরা বিনা দ্বিধায় তাকে গলার মালা করে নিই এবং বিনা বাধায় সেই ওষুধ লিখতে শুরু করি। যে ওষুধ আমেরিকানদের ওপর কাজ করছে আদৌ তা আমাদের দেশে কাজ করবে কিনা তা অনুসন্ধানের কোনো চেষ্টা আমরা করি না। আমরা ভারতীয় ডাক্তাররা তাই সেইসব দেশগুলোর ‘ইয়েসম্যান’। তার ফলশ্রুতিই হল এই সংকট।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ধাপগুলোই এমন করা আছে যে আপনাকে চিন্তা করতে দেয়া হবে না। আপনাকে অনুসন্ধানের সুযোগ দেয়া হবে না। এই পরাধীনতার পঙ্গুত্ত্ব আমরা এখনও বয়ে চলেছি। এ আরও কতদিন চলবে তা কে জানে?
চিকিৎসাবিজ্ঞানের কথা ছেড়েই দিলাম। আপনি অন্য ক্ষেত্রের গবেষণাতেয় গত পঞ্চাশ বছরে এমন কি কিছু দেখেছেন যাতে আপনি গর্বিত হতে পারেন? ভেবে বলুন তো?
তবে আমার দেশের গালমন্দ করতে আমি আজ আসি নি, আমি সামগ্রিকতা নিয়েই বলতে এসেছি। আমরা যাদের কথা ধ্রুব বলে মনে করি তারাও কিন্তু এখনও পর্যন্ত বিরাট কিছু করে উঠতে পারছেন না। তাহলে বুঝে দেখুন আমাদের এই এত বছরের সভ্যতার অহমিকা, আমাদের জ্ঞানের বুলি কত পলকা। আপনি বলবেন বিজ্ঞান তো এভাবেই এগোয়। একশবার। প্রয়োজনই আবিষ্কারের জননী। আমার বলার উদ্দেশ্য তা নয়। আমি বলতে চাইছি আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা দেখুন। স্বীকার করুন যে আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করি যেখানে আমাদের জ্ঞান নির্দিষ্ট, অজ্ঞানতা সীমাহীন। আপনি জানেন ভাইরাসরা প্রায় ‘অমর’? পাহাড়ের গুহায়, সমুদ্রের গহ্বরে, বনে-জঙ্গলে কত বিলিয়ন ভাইরাস আপনাকে আক্রমণ করার জন্য বসে আছে? এক ভাইরাস ‘এইচ আই ভি’ সামান্য এক জংলি বাঁদর থেকে একজন মানুষের মধ্যে ঢুকেছিল। আজও সে তার বিপুল বংশবিস্তার করে পৃথিবীর জিওপলিটিক্স পালটে দিয়েছে। এবার এসেছে করোনা। দেখুন এ কতদূর যেতে পারে। আর ওরা সবাই মিলে আক্রমণ করলে বিলিয়ন লাগবে না আর এমন পঞ্চাশটা ভাইরাস যদি উপযুক্ত ‘হোস্ট’ পেয়ে যায় আমাদের মানবসভ্যতা যে কয়েক বছরেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
এ তো গেল ওষুধের কথা। আপনারা তো ভ্যাকসিন ভ্যাকসিন করে লাফাচ্ছেন একবার আসতে দিন বাজারে। তারপর শুধু তার কালোবাজারি বা রাজনৈতিক তরজার কথা ছেড়ে দিন- ক্ষয়িষ্ণু এই সভ্যতার আন্তর্জাতিক বস্তিতে যেখানে আমরা থাকি সেখানে আমরা এসবে অভ্যস্ত, কিন্তু সেই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কী হবে আমরা সবাই তা নিয়ে খুব সন্দিহান। এত দেশ তো এত ভ্যাকসিন বের করেছে বলে দাবি করছে তারা কিন্তু এখনও জোরগলায় কিছু বলতে পারছেন না। আমেরিকায় হাতের কাছে নির্বাচন। ট্রাম্প কিছু না পেরে এখন সে দেশের সেরা ইমিউনোলজিস্টকে গালাগালি দোষারোপ করা শুরু করে দিয়েছেন। রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্র বলে কিছু হয় না। তা ভারতেও যা আমেরিকাতেও তাই।
তাই আসুন আমরা আরেকবার স্বীকার করি যে ‘আমরা কিছু জানি না’। আমাদের দেশের সব পন্ডিত, সব মহান ডাক্তার সবাই স্বীকার করুন যে ‘আমরা কিছু জানি না’। মানুষ তার অজ্ঞতা সম্পর্কে সচেতন হলেই সে জ্ঞানের জগতে পা রাখার ছাড়পত্র পায়। মানুষের ওপর আস্থা হারানো অন্যায় কিন্তু মানুষের ওপর সম্পূর্ন ভরসা রাখাও ততোধিক অন্যায়। যারা সব বিষয়ে সর্বজ্ঞতার দাবি করে তাদের সন্দেহ করতে শিখুন।
সব ঠিক ই বলছেন, তবে এই অকপট স্বীকারোক্তির পর ও বোধহয় ডাক্তার আর রিসার্চারের একযোগে কাজ করে যাওয়াই দস্তুর অমৃতের খোঁজ জারি রাখার জন্য। যেটা আমার দেশে হয়না।
একটা কথা বলি? কোভিডের চিকিৎসা ক্ষেত্রে এত বিভিন্নতা বা diversification, differential degree of symptoms, success rate in treatment, সব কিছুই বোধহয় লুকিয়ে আছে ভাইরাস ও ACE 2 receptor এর surface glycosylation এর উপর। ……
আশায় থাকলাম এই রকম আরও কিছু পড়ার।
এই সহজ সরল স্বীকারোক্তি র সাহস আর সততাই বিজ্ঞান কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ।এই পথ ক্ষমতার লালসায় মত্ত রাজনৈতিক নেতা দের না-পসন্দ্ ।