গতকাল আমার জন্মদিনে ফেসবুকের দেয়ালে এতজন আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন দেখে আমি সত্যিই খুব অবাক হয়েছি। এই ভার্চুয়াল জগতেও তো এ এক ধরনের ভালোবাসার প্রকাশ। এতজন আমাকে ভালোবাসেন, আমাকে চেনেন এটা আমার কাছে মোটেই সামান্য ব্যাপার নয়। আমি পেশাগতভাবে ডাক্তারি করে যেমন অনেকের ভালোবাসা অর্জন করেছি, ততটাই ফেসবুকে লেখালেখি করে আমার পাঠকদের ভালোবাসা পেয়েছি। এই উপলব্ধি যেমন আমাকে আমার পেশার প্রতি আরও মনোযোগী হতে সাহায্য করবে, তেমনি আমার লেখালেখির জন্যও এ এক অনুপ্রেরণা। বাংলায় এই পাঠকের আকালে এতজন আমাকে নিয়মিত পড়েন–এটা মুখের কথা নয়।
আগের কলমেই বলেছিলাম কোভিড কমতে শুরু করেছে। এই হপ্তাখানেকের মধ্যেই তা অত্যন্ত কমে গেছে। তাই আবার সকালের চেম্বার শুরু করেছি। গত দুদিনে গড়ে তিরিশজন রুগি দেখলে তাঁদের মধ্যে কোভিড পেয়েছি দুই কি তিন জনের। আমার নিজেরও অবাক লাগছে। এতখানি সংক্রমণ কমে গেছে! এর জন্য লক ডাউনের ভূমিকা খানিকটা আছে। তবে আমার মনে হচ্ছে এটা ভাইরাসের সংক্রমণের নিজস্ব নমুনা। যেটা এর আগেও দেখা গেছে।
খানিকটা অবাক করার মতই ব্যাপার বই কি। কালবৈশাখী ঝড়ের পরে শান্ত পৃথিবীর মত। এবারের দ্বিতীয় ঢেউয়ে কোভিড সত্যিই ঝড়ের মতই এসেছিল, আবার তেমন হঠাতই চলে যাবার লক্ষণ দেখাচ্ছে।
চেম্বারে কোভিড রুগি কমে গেলেও ‘পোস্ট কোভিড’ বা কোভিড আক্রান্ত হবার পর আইসোলেশন বা হাসপাতালে কাটানো রুগিদের সংখ্যা বেড়ে গেছে। তাঁরা যে সবাই শুধু রুটিন চেক আপ করাতে আসছেন তা নয় তাঁরা তাঁদের সমস্যা নিয়েই আমাদের কাছে আসছেন।
এবারের কোভিড এই অল্প সময়েই ছারখার করে দিয়ে গেছে। এমন কোনো পরিবার নেই যেখানে তাঁদের কেউ না কেউ তা কাছেরই হোক বা দূরের, কোভিডে মারা যান নি। কোনো কোনো পরিবারে সেই সংখ্যা একাধিক। আমি যখন পিজি হাসপাতালে ইউরোলজিতে হাউসস্টাফশিপ করি তখন ডক্টর দাস ঠিকঠাক হাতের গ্লাভস পরা শেখানোর সময় বলতেন, ‘মনে রাখবে ইউ আর ডিলিং উইথ লাইফ। তুমি এমন এক পেশার সাথে যুক্ত যাতে তোমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান বস্তুটি নিয়ে সাবধান থাকতে হয়- তা হল মানুষের জীবন। তাই এখানে সবসময় তোমাকে অতিরিক্ত সতর্ক থাকা ছাড়া রাস্তা নেই। অনেকেরই কিছু হয় না কিন্তু আমাদের সামান্য অসতর্কতায় অনেকেরই তো জীবন যেতে পারে। আর যার যায় তার যায়। তোমার পরিবারে কারো যদি এমন হয়’?
সত্যিই যার যায় তার যায়। একটা আকস্মিক মৃত্যু সেই পরিবারের ওপর কেমন ধাক্কা দিতে পারে তা এই কোভিডের সময় আমি আমার চারদিকে তাকালেই বুঝতে পারছি। লক ডাউনে বসে থাকা কাজের মানুষ আবার কাজ পেয়ে যাবেন, কিন্তু যে পরিবারে কাজের লোকই চলে গেছেন তাদের উপায় কি? সেসব পরিবারকে আরও অনেক যুদ্ধ করে তবে আবার ঘুরে দাঁড়াতে হবে।
একে কাছের মানুষকে হারাবার বেদনা তার ওপর মৃত্যুভয় এই দুইয়ের ধাক্কায় যারা মানসিকভাবে দুর্বল তাঁরা আরও কাহিল হয়ে পড়ছেন। তাঁদের নিয়ে জেরবার হয়ে চলেছেন বাড়ির লোকেরা। ডাক্তারবাবু ছাদে উঠতে গেলে বুক ধড়ফড় করে, বুকে ব্যথা হয়, সবসময় মনে হয় বুকে কী চেপে ধরছে- এসব সমস্যা তো আছেই। আগেই বলেছিলাম যে কোভিড চলে গেলে এই বুকের সমস্যা নিয়ে কেউ না কেউ নিশ্চই কোনো আর্টিকেল লিখবেন।
পোস্ট কোভিড সমস্যা নিয়ে যাঁরা এখন আসছেন তাঁদের প্রধান সমস্যা দুর্বলতা। নিজেও কোভিড আক্রান্ত ছিলাম বলে জানি এই দুর্বলতা সহজে চলে যাবার নয়। আমার ভ্যাকসিন নেবার কারণেই হয়ত কোভিড তেমন মারাত্মক হয় নি। তা সত্ত্বেও নিজেকে পুরোপুরি সুস্থ বোধ হতে দিন কুড়ির ওপরে লেগে গেছে। যাঁরা কোভিডে প্রচন্ড কাহিল হয়ে পড়েছিলেন তারা দুমাস কেটে গেলেও এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ বোধ করতে পারছেন না।
তাঁরা যে সবাই ইচ্ছে করে নিজেদের অসুস্থতাকে প্রলম্বিত করতে চাইছেন তা নয়, তাঁরা সত্যিই ভেতরে ভেতরে আগের মত তেমন জোর পাচ্ছেন না। খিদে চলে যাওয়া, হাপ ধরা, সবসময় ঘুমঘুম ভাব কিন্তু একটানা ঘুমের সমস্যা, কাজের কথা ভাবলেই ভয় লাগা- এ ধরনের সমস্যা নিয়ে অনেকে আসছেন। সাধারণ দুর্বলতাই বেশি। ‘ডাক্তারবাবু আমি যদি একটু খেতে পারতাম তাহলেই ভালো হয়ে যেতাম। আপনি আমাকে একটু খিদের ওষুধ দিন’। ‘আমি রাতে ঘুমোচ্ছি। দুপুরে ঘুমোচ্ছি। তবু যখনই কোথাও বসছি মনে হয় শুয়ে পড়ি’। ‘ছাদের গাছে সকালে জল দিতে উঠলে আমাকে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে নিয়ে তারপর কাজ শুরু করতে হচ্ছে’।
পোস্ট কোভিড রুগিদের অনেকের একমাস পেরিয়ে গেলেও কাশি কমছে না। চেস্ট এক্স-রে তে সাদা ছোপ থাকছে অনেকদিন। একথা ঠিক যাঁদের স্টেরয়েড দিতে হয়েছিল তাঁদের অনেকের ক্ষেত্রেই কাশির প্রকোপ কম। আর যাঁদের কাশি সহজে কমছে না তাঁদের ক্ষেত্রে স্টেরয়েড ইনহেলার দিলে তাড়াতাড়ি উপশম হচ্ছে। আমি দুমদাম কড়া অ্যান্টিবায়োটিক দেবার বিরোধী। এ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়াই অনেকের উপশম হচ্ছে।
এবারের পোস্ট কোভিড রুগিদের মধ্যে যে সমস্যাটা প্রকটভাবে চোখে পড়ছে তা হল তাঁদের ব্লাড সুগার লেভেল প্রচন্ড বেড়ে যাচ্ছে। এঁদের মধ্যে অনেকেই হয়ত ‘প্রিডায়াবিটিক’ ছিলেন, ওষুধ খেতেন না। কোভিডের পরে তাঁদের ফাস্টিং ব্লাড সুগার দু’শ এমনকি তিনশো ছাড়িয়ে গেছে। এরকম রুগি প্রচুর পাচ্ছি। এই ফলাফল আমাকেও খুব অবাক করছে।
পোস্ট কোভিড রুগিদের অনেকেরই প্যানক্রিয়াসের সমস্যা হচ্ছে। মাইল্ড প্যানক্রিয়াটাইটিস নিয়ে অনেকেই আসছেন। লিভারের সমস্যা নিয়ে তো আগের থেকেই আসছিলেন। তাই মনে হয় কোভিড ভাইরাস বিশেষ করে প্যানক্রিয়াসের ওপর সাময়িক ক্ষতিটা বেশি করে করছে যার জন্য ইনসুলিন ক্ষরণের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তাই হয়ত ব্লাড সুগার এমন অস্বাভাবিক বেড়ে যাচ্ছে। স্টেরয়েডের ব্যবহারও একটা কারণ হতে পারে। এই রুগিরা এখনও ফলো আপে আসেন নি। এলে আগামি দিনে বুঝতে পারব এই সমস্যাটা কী সাময়িক নাকি কোভিডের রুগিদের মধ্যে ডায়াবিটিসে আক্রান্ত হবার সংখ্যা সত্যিই বেড়ে যাচ্ছে।
কোভিড থেকে সেরে উঠেও অনেকে নতুন করে জ্বরে পড়ছেন। দ্বিতীয়বার কোভিড নয় কিন্তু অন্য কোনো ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। তাই সকলকে কোভিড থেকে সেরে উঠে অন্তত দু-মাস খুব সাবধানে থাকা উচিত। কোভিডে অন্য যে কোনো ভাইরাল অসুখের মতই ইমিউনিটি কমে যায়, তাই নতুন করে জ্বরে বা অন্য অসুখে আক্রান্ত হওয়া অসম্ভব নয়। আমার কাছে অনেক কোভিডে আক্রান্ত রুগিরা আসছেন যাঁরা বারাবাড়ি রকমের টনসিলাইটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন। গলা ফুলে যাচ্ছে, ঘাড় পর্যন্ত ঘোরাতে পারছেন না, তার সাথে জ্বর। অনেকে নতুনভাবে পেট খারাপের কবলে পড়ছেন। তা সহজে ঠিকও হচ্ছে না।
পোস্ট কোভিড আর্থ্রাইটিস অনেক পাচ্ছি। হাতে-পায়ের অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, ফুলে যাওয়া এমন সমস্যা নিয়েও প্রচুর রুগি আসছেন। যাঁদের আগের থেকেই ব্যথার সমস্যা তাঁদের তো সমস্যা খুবই বেড়ে যাচ্ছে। অথচ এই ধরনের রুগিদের আমরা রিউম্যাটলজিকাল প্যারামিটার দেখার জন্য যা যা পরীক্ষা করি তাতে খুব অস্বাভাবিক কিছু রিপোর্ট আসছে না। সাধারণ ওষুধেই কাজ দিচ্ছে। মনে হচ্ছে মাস খানেকের তাঁরা মধ্যেই সেরে উঠবেন।
দ্বিতীয় ঢেউ মনে হয় বিদায় নেবার জন্য তৈরি কিন্তু এই কোভিড আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে গেছে। আমাদের এ থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন। আগামি কোভিডের ঢেউ হয়ত পুজোর আগে-পরে আসতে চলেছে। এবার আমরা খুব উদাসীন হয়ে পড়েছিলাম, ভেবেছিলাম কোভিড হয়ত চলেই গেছে। সেই ফল আমাদের ভুগতে হয়েছে। তাই তৃতীয় ধাক্কা যে আসবেই তা আমাদের ধরেই নিতে হবে এবং গা-ছাড়া ভাব কাটাতে হবে। সব কাজের মধ্যেও সতর্কতা বজায় রাখতে হবে। আর যে যেখান থেকে পাচ্ছেন ভ্যাকসিন নেবার চেষ্টা করুন।
এবারের কোভিড আমাদের সকলের থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে। এ এক অদৃশ্য শত্রু। আগামিবার আমরা তাকে আর অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হতে দেব না। সবাইকে এমন একটা সংকল্প ভেতরে ভেতরে গড়ে তুলতে হবে। আর পরিশেষে বলি, আমি কিন্তু বলছি না কোভিড চলে গেছে। সে চলে যাবার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটাই আশার কথা।