আমি তখন পিজি হাসপাতালে হাউসস্টাফশিপ করি। পিজির হোস্টেলের ছোট খুপড়ির মত ঘরে পাশাপাশি দুটো লোহার বেডে আমি আর কৃষ্ণেন্দু থাকি। কৃষ্ণেন্দু ন্যাশনাল থেকে পাশ করে এসেছে। ও এখন গাইনোকলজিস্ট। শেষ যা খবর জানি এন.আর.এস.-এ পোস্টেড আছে।
একদিন বিকেলে কৃষ্ণেন্দুর এক সদ্য পাশ করা ইঞ্জিনীয়র বন্ধু হোস্টেলে দেখা করতে এল। আমরা তখনও হোস্টেলের খুপড়ি ঘরে আছি। রাত জেগে পোস্ট গ্র্যাজুয়েটের জন্য পড়ছি। মাসে হাতে পাই মাত্র ৬,৩৪০ টাকা। আমার তো আবার টানাটানির সংসার। পুরনো পৈত্রিক ভাঙ্গা বাড়ি ছেড়ে মাকে নিয়ে ভদ্রস্থ ভাড়া বাড়িতে থাকছি। মাসে ভাড়াই গুণতে হয় ৩,০০০ টাকা। বাকি টাকায় সংসার চলে।
তখনও প্র্যাকটিস শুরু করি নি। ছাব্বিশ বছর বয়স হয়ে গেছে। কৃষ্ণেন্দুর সেই বন্ধু ঝকঝকে পোষাক পরে দেখা করতে এসেছে। পাশ করার আগেই ক্যাম্পাসিং-এ আই.টি. সেক্টরে চাকরি পেয়ে গেছে। প্রচুর মাইনে। বিদেশ যাব যাব করছে। আমরা দুই বন্ধু ঢলঢলে পায়জামা পরে হা করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রূপকথা শুনছি।
ছেলেটা চোখেমুখে কথা বলছিল। কৃষ্ণেন্দু আবার প্রেম করে। প্রেমিকা ওর ব্যাচমেট। ওর বিয়ের তাড়াও আমার থেকে বেশি। তাই ওর পড়াশোনার গতি যেমন বেশি, উৎকন্ঠাও বেশি।
আমরা দুজনেই যখন ভ্যালভ্যাল করে ওর কর্পোরেট সাফল্যের কথা গিলছি, আর একই বয়সে কিছুই না হবার জন্য নিজেদের প্রফেশনকে গালমন্দ করছি তখন সেই ছেলেটি একটি আশ্চর্য কথা বললঃ “তোমাদের প্রফেশনের সাথে আমাদের প্রফেশনের কোনো তুলনাই হয় না। একজন ডাক্তার যে সামাজিক সম্মান পায়, আমরা সেখানে কোথায়? পাড়ার লোকেরা জানেই না পাড়ার কোন ছেলেটা ইঞ্জিনীয়র, সে কোথায় কাজ করে? আর তোমরা ডাক্তারিতে চান্স পাবার পরেই লোকেরা খবর নেয় তোমরা কবে পাশ করবে? কবে থেকে রুগি দেখা শুরু করবে?”
সেদিনের সেই শিবপুর থেকে পাশ করা ছেলেটি আজ কোথায় আছে জানি না। হয়ত ক্যালিফোর্নিয়া বা সিয়াটেল, লন্ডন বা বার্লিন কিন্তু ওর কথাটা আমার জীবনে ফলে গেছে।
শুধু আমার কেন আমার মত সব ডাক্তারদের জীবনেই এটা হয়ত অমোঘ সত্যি। আসামের মানসে দুর্লভ পাখি বেঙ্গল ফ্লোরিক্যানের ছবি তুলতে গেছি। সঙ্গে জয়দাস মহাপাত্র। তিনিও ডাক্তারবাবু। রিসোর্টে দেখা হল মহারাষ্ট্রের এক যুবকের সাথে। বিরাট দামি লেন্স আর ক্যামেরা নিয়ে এসেছে পাখির ছবি তুলতে। মুম্বইয়ের নামজাদা ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে।
আমরা কথায় কথায় তার পারিবারিক ঐতিহ্য ও বিত্তের কথা উল্লেখ করতে সে বললঃ “দাদা, আমরা সব পারি। তবে আপনাদের মত মানুষের জীবন তো ফিরিয়ে দিতে পারি না!” মুখ দেখে মনে হল মন থেকেই কথাটা বলছে।
আমি যখন প্রথম প্র্যাকটিস শুরু করি আমার ভিজিট ছিল মাত্র তিরিশ টাকা। এখন চারশ টাকা। গত ষোল বছরে বৃদ্ধির হার ১২৩০%। সংখ্যাটা অবাক করার মত তবে অসম্ভব নয়। আমার চেম্বারে ভিজিটের নীচে লেখা আছেঃ “আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের কথা সবসময় বিবেচনা করা হবে”। তাই বাড়ির কাজের লোক, জমির মজুর, ভ্যানচালক, অটোওলা, টোটোওলা, সব্জি বিক্রেতা… তারা তাদের সাধ্যমতই আমার ভিজিট দেয়।
আমি যখন প্রথম বাড়িতে বসতাম লোকেরা আমাকে বলত-‘গরিবের ডাক্তার’। তখন বাম জমানা চলছে। আজ আমার যা ভিজিট সেই উপমা হয়ত আমার ক্ষেত্রে খাটে না কিন্তু চেম্বারে বসে এখনও বাইরে থেকে এমন কথাও কানে আসেঃ-
“- বাবা চারশ টাকা ভিজিট?
– না, না ডাক্তারবাবু ওরকম নন। আপনার অসুবিধে থাকলে ওনাকে বলবেন”।
তখন মনে হয় আমার মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ থেকে আমি নিশ্চই সম্পূর্ণ সরে আসি নি। রুগিরা সবাই নিশ্চই আড়ালে আমার সম্পর্কে সবসময় শুধুই দুর্নাম করে না।
আমার এক বন্ধু ছিল, সে বলত, “যখন দেখবি অর্ধেক লোক তোকে ভগবান বলছে আর অর্ধেক লোক তোকে শুয়োরের বাচ্চা বলছে তখন বুঝবি তুই বড় ডাক্তার হয়েছিস”। ‘বড় ডাক্তার’ হবার যোগ্যতা বা প্রবল বাসনা কোনোটাই আমার নেই– তবু মাঝে মাঝে নিজের সম্পর্কে শতাংশের হিসেব আমার খুব জানতে ইচ্ছে হয়।
মাঝে এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল যে সামাজিকভাবে আমরা ডাক্তারবাবুরা খুব বিপন্ন বোধ করছিলাম। খবরের কাগজ খুললেই ডাক্তারদের পেটানোর খবর, বাড়ি-চেম্বার ভাংচুরের ছবি, মলমূত্র খাওয়ানোর খবর, মহম্মদ আলি পার্কের বিখ্যাত দুর্গাপুজোয় অসুররূপী ডাক্তারকে দেখিয়ে থিমপুজোর ঐতিহ্য রক্ষা- এসব অত্যন্ত বিরক্ত ও বিব্রত করত।
আমাদের বন্ধুদের গ্রুপে এই নিয়ে আলোচনা হলে কেউই চাইত না যে তাদের ছেলেমেয়েরা কেউ ডাক্তার হোক। এই পরিস্থিতিতে এল কোভিড। দীর্ঘ প্রায় দশমাস ধরে চলা এই মহামারীতে সারা পৃথিবীতে ডাক্তাররাই সামনে থেকে যুদ্ধ করে চলেছেন। সারা পৃথিবীর কথা ছেড়েই দিলাম, আমাদের ব্যারাকপুর ও তার আশেপাশের এলাকার অনেক ডাক্তারবাবুরা কোভিডে মারা গেলেন। অনাদিদাও সেদিন দীর্ঘ একমাসের লড়াইয়ের পর চলে গেলেন। তাঁর মত কর্মী মানুষ যিনি কোভিডের মধ্যেও আই.এম.এ. থেকে নানান জায়গায় সচেতনতামূলক বক্তৃতা ও ক্যাম্প করেছিলেন তাঁর চলে যাওয়াটা আমাদের এলাকার ডাক্তারদের ও মানুষের এক অপূরণীয় ক্ষতি।
বন্ধুদের যাদের জিজ্ঞাসা করছি তারা প্রায় সকলেই কখনও না কখনও পজিটিভ হয়েছে। তারা কিন্তু সুস্থ হয়ে আবার প্র্যাকটিস শুরু করেছে। আমিও কখনও আমার চেম্বার বন্ধ রাখি নি। নিজে ভয় পেয়েছি, বাড়ির লোকে জোর করেছে চেম্বার বন্ধ রাখতে অন্তত কিছুদিন, আত্মীয়রা বলেছে রুগি না দেখতে- আমি তাদের কথা মান্য করি নি।
আমার জেঠু ব্যারাকপুরের নামজাদা হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। আশি বছর পার করে ফেললেন। গতকাল আমরা জেঠু-জেঠিমার পঞ্চাশতম বিবাহবার্ষিকী উজ্জাপন করলাম। উনি একদিনের জন্যও চেম্বার বন্ধ করেন নি। আমিও তাঁকে বারণ করেছি। তিনি শোনেন নি। “তুই তো ওষুধ দিয়েই দিয়েছিস। ও আমার কিছু হবে না”।
আমি অনুভব করেছি এই কোভিড পরিস্থিতি আমাদের ডাক্তারদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও সম্মানের জায়গাটা আবার ফিরিয়ে দিয়েছে। যুদ্ধের পর সৈনিকেরা যেমন বীরোচিত মর্যাদা পায়, লোকেরা আমাদেরকেও এখন সেই দৃষ্টিতেই দেখতে শুরু করেছে।
“ডাক্তারবাবু আপনি ছিলেন বলেই আমার মা ভালো হয়ে গেলেন”।
“ভাগ্যিস আপনার কাছে এসেছিলাম তাই আমার ১২ লাখ টাকা বেঁচে গেল। প্রাইভেটে ভর্তি হলে আমার সব টাকা শেষ হয়ে যেত”।
তাদের সব কথা বা অনুমান হয়ত সত্যি নয় কিন্তু এই দশমাস আমার এলাকাবাসীর কাছে আরও অনেকের মত আমিও রোল মডেল হয়ে উঠেছি- এই বোধটা আমাকে খুব আনন্দ দেয়। কোভিড এসে আমার প্রফেশনের প্রতি আমার ভালোবাসা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি মনে করি এই কাজের প্রতি ভালোবাসা আমার ভবিষ্যৎ জীবনের একটা বিরাট দিশা হয়ে উঠতে পারে।
আমাদের কলেজের এস.এফ.আই.-এর এক নেতা দাদা ছিলেন যিনি ফার্স্ট ইয়ারে আমাদের পরিচিতির সময় বলেছিলেন- “এখানে তো এসেছ, জেনে রেখ এখানে ঢুকতে কষ্ট, ঢুকে কষ্ট, বেরিয়ে কষ্ট। তুমি কোনো একদিন যখন দাঁড়াবে তখন তোমারটা আর দাঁড়াবে না”।
তার ভবিষ্যৎবাণী আমার ক্ষেত্রে পুরোটা খাটে নি। আমি দাঁড়িয়ে যাবার পরেও আমারটা নিয়মিত ভালোই দাঁড়াত।
ইদানিং যদিও বিশেষ প্রয়োজনে রাতে এক মিলিগ্রাম ফিনাস্টেরাইড ট্যাবলেট খেতে হচ্ছে তাই দাঁড়ানো প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তবে কয়েকমাসের এই ‘শনির দশা’ কেটে গেলে আমি তাকে আবার দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারব- নিজের প্রতি এই কনফিডেন্স আমার আছে।
আমার স্টেথোস্কোপের পাঠকেরা অপেক্ষা করুন এই ওষুধ খাবার কারণ এবং তার লোমহর্ষক প্রতিক্রিয়া নিয়ে আমি কিছুদিন পরেই ধারাবাহিকভাবে লিখব। আপনারা অনেকেই তাতে অত্যন্ত প্রভাবিত হবেন বলেই আমার বিশ্বাস। কিন্তু তা যতদিন না হচ্ছে আপনারা দয়া করে আমার সাময়িক ‘শারীরিক অক্ষমতার জন্য’ আমার বারো বছরের বৈবাহিক সম্পর্কটা যাতে ভেস্তে না যায় তার জন্য আপনাদের উপাস্য দেবতার কাছে একটু দরবার করবেন এই আশা রাখছি।
(চলবে)
Pls don’t forget world’s wealthiest person name -Jeff Bezos!
Excellent!
The more I read the more passionate I become of your golden letters. সত্যি অবিশ্বাস্য!!!!