কোভিড যখন শুরু হল তখন অন্যান্য অনেকের মত আমিও খুব সংশয়ে ছিলাম- প্রাইভেট চেম্বার করব না কি করব না? এই নিয়ে স্টেথোস্কোপে আমি বার দুয়েক লিখেওছিলাম। শেষে সিদ্ধান্ত নিই, কপালে যা আছে হবে, চেম্বার বন্ধ করব না।
তবে পেশেন্টদের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলাম। সকালে দশ জন, রাতে কুড়ি জনের বেশি দেখতাম না। এখনও দেখি না। তবে এখন রুগির চাপ অনেক বেড়ে যাওয়ায় এবং লক ডাউন উঠে যাওয়ায় পরিস্থিতির বদল হওয়ায় লক্ষণরেখা মানা সবসময় সম্ভব হয় না।
যখন লক ডাউনের প্রথম ও মাঝের দিকে রুগি দেখছিলাম, অন্য অনেক ডাক্তারবাবুদের চেম্বারই বন্ধ ছিল। সেসময় আমার ভেতরে ভেতরে এমন একটা ভাব কাজ করত যে এই অবস্থায় পেশেন্টদের দেখছি মানে তাদের প্রতি আমি বিশেষ করুণা করছি।
বেশি কথা বলতাম না। ফোন সবসময় ধরতাম না। অধিকাংশ সময় ফোন বন্ধ রাখতাম। ফোনে গলার আওয়াজ এমনভাবে গম্ভীর করে কথা বলতাম যেন আমি অসম্ভব বিরক্ত ও রেগে আছি। আমার হতভাগা রুগিরা সেসময় আমাকে তবু সহ্য করেছিলেন কারণ সেসময় তাঁদের কাছে হয়ত সেরকম কোনো বিশেষ বিকল্প ছিল না অথবা তাঁরা বিশ্বাস করতেন আমাকে কোনোভাবে একবার দেখাতে পারলেই তাঁরা সুস্থ হয়ে উঠবেন।
আমার রুগিদের আমার প্রতি এই বিশ্বাসটা আমার বিগত ষোল বছর প্রাইভেট প্র্যাকটিসের অর্জন। আমার রুগিরা ও আমার প্রোটাগনিস্টরা বলেন আমার নাকি ‘হাতযশ’ আছে। আমি স্টেথোটা বুকে ছোঁয়ালেই, বা কেউ কেউ শুধু আমাকে একবার দেখেই নাকি সেরে ওঠেন।
এটা অবশ্য যে শুধু আমার ক্ষেত্রে হয় তা নয়, এটা অনেকের ক্ষেত্রেই হয়; আবার অনেকের ক্ষেত্রে হয়ও না- এটা অপ্রিয় হলেও সত্যি। আমার চেয়ে অনেক বিদ্বান ডাক্তারবাবুকেও চেম্বারে বসে মাছি তাড়াতে দেখেছি।
যাই হোক এই অবাঞ্ছিত আত্মশ্লাঘা বা হয়ত আত্মরতিও বটে এ উল্লেখের কিছু প্রয়োজন ছিল। কারণ চেম্বারে দশজন বা কুড়িজন হয়ে যাবার পরেও আরও চার কি পাঁচজন এসে যখন ‘এমার্জেন্সি’ বলে দেখানোর জন্য কাকুতি-মিনতি করত আমি তাদের অনেকের সাথেই খুব খারাপ ব্যবহার করতাম। অত্যন্ত রূঢ় ও কঠিন ব্যবহার। তাদের জায়গায় আমি হলে হয়ত সেই ‘অভদ্র’ ডাক্তারের কাছে দ্বিতীয়বার আর দেখাতেই আসতাম না।
কিন্তু আমি লক্ষ্য করতাম আমার আগের দিন ফিরিয়ে দেওয়া বিপন্ন রুগিদের মধ্যে অনেকেই পরের দিন অনেক আগে থেকেই চেম্বারের বাইরে এসে অপেক্ষা করছে যাতে তারা প্রথম দশ বা কুড়িজনের মধ্যে চলে আসতে পারে। এই বিষয়গুলো আমাকে তখন খুব প্রভাবিত করেছিল। অনুতপ্তও করেছিল।
তবু আমি অনড় মনোভাব থেকে সরে আসি নি। তার একটা কারণ অবশ্যই কোভিডের জন্য প্রোটোকল মেনে চেম্বারে রুগিদের ভিড় না বাড়ানো কিন্তু অন্য কারণটা যে আমার নিজেকে ‘স্থানীয় মসীহা’ বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা সেটা একেবারেই অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই।
আমার এই কঠোর অমানবিক আচরণের জন্য অন্য সময় হলে হয়ত আমি তিরস্কৃত এমনকি আক্রান্তও হতে পারতাম কিন্তু কোভিড পরিস্থিতিতে আমার ফিরিয়ে দেয়া বিপন্ন রুগিরা মাথা নিচু করে চলে গেছেন। মুখে টুঁ শব্দটিও করেন নি।
আমি পরে এমনকি এখনো আমার ব্যবহার নিয়ে অসম্ভব অনুতপ্ত হই। কিন্তু যা হবার তা তো হয়েই গেছে! প্রত্যেক সফল বাজারি লেখকের যেমন একটা ‘এক্স-ফ্যাক্টর’ থাকে তেমনি প্রতি ডাক্তারের জনপ্রিয়তার পেছনে তেমন কিছু একটা কেমিস্ট্রি কাজ করে। আমার অনেক অল্প বয়স থেকেই প্র্যাকটিস গড়ে ওঠার পেছনে একটা প্রধান কারণ ছিল রুগিদের প্রতি আমার নম্র ব্যবহার। কিন্তু আমার বাড়তে থাকা বয়স, ক্রমবর্ধমান রুগির চাপ, শেষে কোভিড এসে সেটা প্রায় কেড়েই নিয়েছিল।
কিছুদিন আগেই আমি নিজের বিশেষ প্রয়োজনে আমারই কলেজের প্রাক্তনী, আমার চেয়ে চার বছরের এক সিনিয়রের সাথে যোগাযোগ করি। আমরা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজেও কিছুদিন কলিগ ছিলাম। তবে প্রথাগত হাসি বিনিময় ছাড়া আমাদের মধ্যে বেশি কিছু ছিল না।
একদিন রাত এগারোটায় আমি হঠাৎ করে তাকে ফোন করলাম। আমার সাথে দাদা এত রাতেও এমনভাবে কথা বলল যেন ও আমার পাশের বাড়িতে থাকে। কয়েকদিন পরে আমি তার কাঁকুড়্গাছির চেম্বারে তাকে দেখাতে যাই। মনে আছে আমরা সেদিন নর্থ বেঙ্গলে আমাদের কলেজ জীবনের স্মৃতি নিয়ে প্রায় একঘন্টা গল্প করেছিলাম। সকালে দাদা ৩০ কিমি সাইক্লিং করে এসেছেন। এখানে এসে দুটো অপারেশন করেছেন। বেলা দুটোয় আমরা আমাদের কথার মাঝে তিনবার ব্ল্যাক টি খেলাম। মাঝের এক ঘন্টায় দাদার অগণিত রুগিদের ফোন এল। শান্তভাবে, গলায় কোমলগান্ধারে দাদা সবাইকে জবাব দিলো।
সেই এক ঘন্টায় আমি অত্যন্ত প্রভাবিত হলাম। বিদ্ধ হলাম। বুঝলাম আমার নিজেকে দ্রুত বদলানো প্রয়োজন। এটা ‘এমার্জেন্সি’। দাদার সাথে আমার নিজের সমস্যার কথা নিয়ে এই কলামে আমি পরে ধারাবাহিকভাবে লিখব- তবে আজ এখানেই থাক।
কোভিড পরিস্থিতিতে আমি বেশিরভাগ সময়ই মোবাইল বন্ধ রাখতাম তা আগেই বলেছি। পেশেন্টদের সাথে হোয়াতে যোগাযোগ করতাম। দাদার সাথে দেখা করার পরদিন থেকেই আমি সারাদিন মোবাইল খোলা রাখতে শুরু করি। শুধু রাতের নিদ্রার সময়টুকু বাদে। কারণ আমি বিশ্বাস করি একজন পরিণত বয়স্ক মানুষের নীরোগ, সুস্থ থাকার জন্য দিনে অন্তত সাতঘন্টা ঘুমোনো দরকার। এটা আমার পড়াশুনো করে অর্জিত বিশ্বাস। সবাইকে আমি এটা বলেও থাকি। আ গুড নাইট স্লিপ ইজ দ্য বেস্ট মেডিসিন। আপনারা জানেন সারাজীবন প্রচুর ঘুরে বেড়াবার জন্য আমি দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে চাই। তাই ওইটুকু বিলাসিতা আমার নিজের স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ। আমার মেডিক্লেম।
তবে লক্ষ্য করেছি রাতে ফোন এখন কালেভদ্রে আসে। রুগিরা অসম্ভব বিপদে না পড়লে রাতে প্রায় ফোন করেই না। তাই ভাবছি এখন থেকে রাতেও ফোন খোলা রাখব। সবার সব প্রশ্নের উত্তর খুব শান্তভাবে, কোমলগান্ধারে দিচ্ছি। অন্যদিকে যিনি প্রশ্নকর্তা বা শ্রোতা তাঁর তৃপ্তিটুকু আমি এদিকে অনুভব করতে পারছি।
এর মধ্যে বেশ কিছু খারাপ-ভালো ঘটনা ঘটে গেছে। অনেক বয়স্ক কোভিড রুগি যাঁদের বাড়িতেই চিকিৎসা করছিলাম তাঁদের হঠাৎ অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যাওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। অনেক রুগি হঠাৎ বাড়িতে মারা গেছেন। আমি কোনো সামাজিক সমস্যায় পড়ি নি। ‘পোস্ট কোভিড কমপ্লিকেশনস’ আমাদের সব ডাক্তারদের কাছেই একটা বিরাট ঘোরেল ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিউমোনিয়ায় মারাত্মকভাবে আক্রান্ত যুবতী হাসপাতালে ভর্তি হবে না এই জেদ ধরে চোদ্দ দিন ধরে বাড়িতে হাই ফিভার নিয়ে তীব্র জ্বরের কষ্ট ও উৎকন্ঠা সহ্য করে শুধু আমার ওপর বিশ্বাস রেখে ভালো হয়ে উঠেছে। তিনবার তাকে অ্যান্টিবায়োটিক পালটে দিতে হয়েছে। এগুলো সবই সম্ভব হয়েছে বিগত কয়েক সপ্তাহে রুগিদের সাথে আমার বাড়তি সংযোগের কারণে।
সিনিয়র ডাক্তারদাদার সাথে আমি মাত্র দু-দিন দেখা করেছি। ঘটনাচক্রে দাদা নিজেই এখন কোভিড আক্রান্ত হয়ে গৃহবন্দী। তাতেই আমার মধ্যে যে এতখানি পরিবর্তন হয়েছে এতে আমি যারপরনাই হতবাক। কিন্তু এর ফলে আমার মধ্যে দীর্ঘদিন জমে থাকা একটা প্রশ্নের উত্তর আমি পেয়ে গেছি।
বহু বাচ্চা ছেলেমেয়ে আছে যাদের আমি অনেক ছোট বয়স থেকে দেখছি। তাদের বাবা-মায়েরা আমাকে বলেছেন, “ডাক্তারবাবু ও আপনাকে দেখে এত প্রভাবিত যে ও-ও আপনার মত ডাক্তার হতে চায়”। আমি তখন সদ্য-সদ্য পাশ করা আনাড়ি এম.বি.বি.এস.। আমার চারপাশে সব নামজাদা ডাক্তারবাবুদের ভিড়। আমার তাদের কথা শুনে খুব অবাক লাগত। হাসতাম, তবে মুখে কিছু বলতাম না।
আজ তাদের মধ্যে অনেকেই ডাক্তারিতে চান্স পেয়ে আমাকে দিয়ে মেডিকেল সার্টিফিকেট ফিল আপ করাতে এসে প্রণাম করে। তাদের বাবা-মা হাতে মিষ্টির প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে যায়। এখন বুঝতে পারি একজন ডাক্তার হয়ে যদি আরেকজন ডাক্তারকে মাত্র দু-দিন দেখেই আমি এতটা প্রভাবিত হতে পারি তবে যে মেধাবী বাচ্চা ছেলে বা মেয়েটা তাদের শারীরিক কষ্ট নিয়ে বিগত দশবছর ধরে আমার কাছে এসে উপশম পেয়ে আমার মত হতে চেয়েছে সে যে আমাকে তার রোলমডেল করতেই পারে এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
এই যে আমি গত দু-হপ্তা ধরে এত নম্রভাবে এখন আমার রুগিদের সাথে কথা বলছি, ধৈর্য ধরে সবার কথা শুনছি, উত্তর দিচ্ছি এতে কি আমার নিজের মনের ওপর কোনো চাপ পড়ছে না? বিরক্তি আসছে না? সে তো আসবেই। আসছেও। বিরক্তি খুব কষ্ট করে চেপে রাখছি। তবে যখন চেম্বারে বসে শুনি বাইরে দু-ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করে থাকা রুগিও অন্য আরেকজনকে বলছেন, “ডাক্তারবাবু সবসময় ফোন করলেই ফোন ধরেন। না ধরলে কল-ব্যাক করেন। সব কথা মন দিয়ে শোনেন। জবাব দেন। আজকালকার ডাক্তাররা তো ফোন ওঠাতেই চান না”। তখন মনের মধ্যে প্রফুল্লতা আসে। বুঝি ওষুধে কাজ হয়েছে।
আর মুখে যত বড় বড় কথাই বলি না কেন আমার এক বড় দুঃখী কিন্তু সদাহাস্যময়ী সহকর্মী দিদি সবসময় বলতেন, “যাই বলিশ না কেন রিশিকেশ, সিল্ভার টনিক ইজ দা বেস্ট ট্রিটমেন্ট”। দিদি মেদিনীপুরিয়ান। তাঁর উচ্চারণে একটু স-এর দোশ আছে। তাই এই ভদ্র ব্যবহারের আড়ালে ও বাহুল্যে আমার লক্ষ্মীর ঝাঁপিও যে ভরে উঠতে শুরু করেছে তাকে তো মোটেই অস্বীকার করতে পারি না, তাই না? আপনারা কী বলেন?
(চলবে)
অনেক ধন্যবাদ ডাক্তারবাবু, এত আন্তরিকভাবে এতগুলো কথা বলার জন্য। প্রার্থনা করি যাতে আমাদের রাজ্যের/ দেশের পাড়ায় পাড়ায়, সব সরকারি হাসপাতালে আপনার মতো ডাক্তার হোন…
আমি পূর্বমেদিনীপুরের একটা ছোট্ট গ্রামে থাকি, আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনা যে ডাক্তারবাবুকে দেখানোর পর ফোন করে সমস্যা বলতে পারব সরাসরি ডাক্তরবাবুকে তাও আবার রাত-বিরেতে!!
খুব ভালো থাকবে।
দারুন।