যদিও এটা মেডিকেল কলেজের গল্প। স্কুলের গল্প বলে চালিয়ে দিলাম। স্কুল খুলুক। স্কুল ও কলেজের স্মৃতি এক অমূল্য সম্পদ।
আমাদের পাড়ার মোটাদা ডাক্তারি পড়ে। ভালো নাম হিরণ্ময় নন্দী। এই নামটা ভুলে গেছিলাম। মোটাদাকেই জিজ্ঞাসা করে আবার জেনেছি। ভালো নামটা মনে রাখতে হবে। কদিন পরেই মোটাদা ডাক্তার হবে। তখন আর সবার সামনে ‘মোটাদা’ বলে ডাকা যাবে না।
মোটাদা মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে থাকে। আগে প্রতি রবিবারই বাড়ি আসত। ফাইনাল ইয়ারে ওঠার পর ন’মাসে ছ’মাসে বাড়ি আসে। পড়াশুনোর চাপ নাকি খুব বেড়েছে।
আমরা অপেক্ষায় থাকি কবে সে আসবে। মোটাদা এলে আমাদের অরুণোদয় ক্লাব ঘরে আড্ডা আরও ভালো জমে। চা, শিঙাড়া, ডালমুটের অভাব হয়না। আমি ছাড়াও থাকে বোঁচা, পিউপা আর ভূতো। মোটাদা মেডিকেল কলেজের নানা রকম রোমহর্ষক গল্প শোনায়। মরা কাটা থেকে অপরেশন থিয়েটারের গল্প কিছুই বাদ যায় না।
এবারে মোটাদা প্রায় মাসখানেক বাদে এসেছে। তাই উৎসাহ একটু বেশি। সকাল সকাল আমরা চারজন ক্লাবে হাজির। কিন্তু মোটাদার পাত্তা নেই। আমাদের দেখে কালু ল্যাজ নেড়ে ঘুর ঘুর করছে। পকেটে বাড়ি থেকে আনা কয়েকটা বিস্কুট ছিল। তাই ভেঙে ভেঙে কালুকে খাওয়াচ্ছিলাম।
কালু আমাদের পাড়ার সবচেয়ে আদুরে কুকুর। কুচকুচে কালো গায়ের রঙ। কালো লোম একেবারে চক চক করে। আলো পড়ে পিছলে যায়। একফোঁটা ময়লা লেগে নেই। কালু নিজের রূপ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। সে রোজ দূপুরে মলয়দাদের পুকুরে গিয়ে স্নান করে।
ভূতো বলল, ‘কি হল রে, মোটাদা কি বাড়িতে এসেও পড়তে বসে গেল? দশটা বাজে, এখনও এলো না।’
বলতে বলতে মোটাদা ক্লাব ঘরে ঢুকল। আমরা সমস্বরে বললাম, ‘এইতো, এসে গেছে। তোমার কথাই হচ্ছিল। তুমি অনেকদিন বাঁচবে।’
কিন্তু মোটাদা ক্লাবে ঢুকে কেমন ভয়ার্ত দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
বোঁচা বলল, ‘কি হ’ল, থমকে গেলে কেন?’
‘এটা…, এ…এ…টা… কি?’ মোটাদার তর্জনী কালুর দিকে।
বললাম, ‘এতো আমাদের কালু। কালুকে চিনতে পারছ না! কালু কিন্তু তোমায় ঠিক চিনেছে। দেখ, কেমন লেজ নাড়াচ্ছে।’
‘এটাকে আগে ঘর থেকে বার কর। তারপর আমি ঘরে ঢুকব।’
আমরা অত্যন্ত অবাক হলাম। মোটাদা কুকুর প্রচণ্ড ভালবাসে। এর আগেরবার যখন এসেছিল, কালুকে বাড়ি ডেকে নিয়ে নিজের হাতে খাইয়েছিল। সে এলাহি ব্যবস্থা। দেরাদুন চালের ভাত, দুই রকমের তরকারি, মাংসের ঝোল, একবাটি দুধ। মোটাদার মতে একেবারে ব্যালেন্স ডায়েট।
সেই মোটাদার এ কী পরিবর্তন? কালুকে ক্লাব ঘর থেকে বের করে দিতে বলছে!
কালু কিছুতেই বেরোতে চায়না। ভূতো হাত তুলে ‘হেট হেট’ বলতেই ওর পায়ে মাথা ঘষতে লাগল। তারপর পিউপা আর ভূতো মিলে একরকম ঠেলেই ওকে বার করে দিল। কালু অত্যন্ত আহত দৃষ্টিতে মায়াভরা চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। মোটাদা ভেতর থেকে ছিটকানি দিয়ে বলল, ‘যাক, বাঁচলুম।’
‘কি হলো, তুমি হঠাৎ কালুর উপর এত ক্ষেপে গেলে কেন?’
‘শুধু কালু নয়, দুনিয়ার সব কুকুরের উপরই আমার রাগ। কুকুরের মতো নেমক হারাম, অকৃতজ্ঞ, ছ্যাঁচড়া প্রাণী পৃথিবীতে দুটো নেই।’
‘সেকি গো! আমি তো উল্টো কথা জানতাম। কুকুরের মতো প্রভুভক্ত জীব আর হয়না!’
‘ভুল জানতিস। তাহলে একটা গল্প শোন। গল্প নয়, একেবারে সত্যি ঘটনা। ঘটেছে মাত্র আঠারো দিন আগে।
আমাদের মেন হোস্টেলে একটা কুকুর আছে। নাম পল্টু। মেন হোস্টেল মেডিকেল কলেজের সবচেয়ে বড় হোস্টেল। চারতলা বিশাল বাড়িটায় সারি সারি ঘর গুলোয় অন্তত পাঁচশ ডাক্তারি ছাত্র থাকে। তাদের চিৎকার, চেঁচামেচিতে সারাক্ষণ হোস্টেল গম গম করে।
প্রায় নব্বই শতাংশ ছাত্রই পল্টুকে ভালবাসত। তাকে আদর করে খাওয়াতো। অফুরন্ত খাওয়া দাওয়া করে পল্টুর চেহারা হয়েছিল সুন্দরবনের বাঘের মত। তোরা কখনও ভুড়ি ওয়ালা কুকুর দেখেছিস? পল্টুর পাঁচ নম্বর ফুটবলের সাইজের একটা ভুড়িও হয়েছিল।
সারা হোস্টেলে পল্টুকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতাম আমি। আমাকে দেখেই ও লেজ নাড়ত। ঝাঁপিয়ে কোলে উঠতে চাইত। মুখ টুখ চেটে একাকার কাণ্ড করত।
ভালই দিন কাটছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই বিপদ ঘনিয়ে এল। একটি ছেলে খবর আনল, পরেরদিন পৌরসভা থেকে কুকুর ধরার দল আসবে। ইডেন হসপিটাল রোডে কুকুরের অত্যন্ত বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। এলাকার সব কুকুরকে ধরে ধাপার মাঠে ছেড়ে আসবে।
হোস্টেল শুদ্ধু ছেলে চিন্তিত হয়ে পড়ল। পল্টুকে যদি ধরে নিয়ে যায়! এতো আদর যত্নে থেকে ব্যাটার অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে। ধাপার মাঠে গিয়ে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারবে না। এলাকার অন্য কুকুররা পল্টুকে ঈর্ষার দৃষ্টিতে দেখে। নেহাৎ আমাদের ভয়েই পল্টুকে কিছু বলে না। ওকে একা পেলে হয়তো সবাই মিলে প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করবে।
কিছু একটা করতেই হবে। তড়িঘড়ি জেনারেল বডি মিটিং ডাকা হলো। অনেক আলাপ আলোচনার পরে স্থির হলো, পল্টুকে হোস্টেলের একটা ঘরে কাল সারাদিন লুকিয়ে রাখা হবে।
আমি নিজেই যেচে দায়িত্ব নিলাম। আমার দুজন রুমমেট প্রদীপ্তদা আর অতনু বাড়ি গেছে। ঠিক হল আমি পল্টুকে নিয়ে ঘরে ঢুকব আর বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দেওয়া হবে। যাতে কুকুর ধরার বাহিনী পল্টুর উপস্থিতি টের না পায়।
অনেক ধরণের লোভনীয় খাবার জোগাড় করলাম। চার রকমের বিস্কুট, পাউরুটি, মুড়ি, কেক, গুড়ো দুধ আর কয়েক বোতল জল। সারাদিন এসব খেয়েই দুজনে কাটিয়ে দেব। রাতে হোস্টেলের ক্যান্টিনে আই ডি অর্থাৎ ইমপ্রুভ ডায়েট। ফ্রাইড রাইস আর চিলি চিকেন। আমি কবজি ডুবিয়ে খাব, আর পল্টু থাবা ডুবিয়ে খাবে।
পরেরদিন সাত সকালে পল্টুকে বিস্কুটের লোভ দেখিয়ে ঘরে ঢোকালাম। বাইরে থেকে একজন তালা ঝুলিয়ে দিল। দরজা বন্ধের শব্দ হতেই পল্টু দৌড়ে গেল। থাবা দিয়ে দরজা ফাঁকা করার চেষ্টা করল। আমার দিকে তাকিয়ে ভৌ ভৌ করে দুবার ডাকল।
বললাম, “পল্টু সোনা, তোমার ভালোর জন্যই বাধ্য হয়ে এই ব্যবস্থা করতে হয়েছে। না হলে দুষ্টু লোকেরা তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে।”
পল্টু আমার কথা বিশ্বাস করল বলে মনে হল না। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ডাকল, “উ…উ…”
আমি বললাম, “বাবুসোনা, অতো ডাকাডাকি করিস না। দুষ্টু লোকেরা টের পেয়ে যাবে। তুই বরঞ্চ অতনুর বিছানায় একটু শুয়ে নে।”
একরকম জোর করেই পল্টুকে অতনুর খাটে তুলে দিলাম। পল্টু বার দুয়েক চাদরটা শুঁকল। তারপর লাফ দিয়ে খাট থেকে নেমে এল।
আমি সুর করে বললাম, “কি হল প…ল…টু? নেমে এলি কেন…ও…ও? ও বুঝেছি। অতনু জম্মে বিছানার চাদর কাচে না। তোর মতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কুকুর ওই বোঁটকা গন্ধ সহ্য করবি কি করে। তুই বাবু পদা’দার বিছানায় শুয়ে পড়। পদা’দা শৌখিন লোক। দুদিন অন্তর বিছানার চাদর কাচে। চাদরে পারফিউম লাগায়। দেখিস বাবু, বিছানাটা নোংরা করিস না। তাহলে পদা’দা আমাকে ছাড়বে না।”
কিন্তু পল্টু পরিষ্কার বিছানাতেও শোওয়ার উৎসাহ দেখাল না। বরঞ্চ করুণ সুরে ডাকতে আরম্ভ করল, “ভৌউউউউ…।”
বললাম, “দোহাই পল্টু চুপ কর। তোর পায়ে ধরছি। এখুনি কুকুর ধরার লোকেরা চলে আসবে। ওরা টের পেয়ে গেলে মুশকিল।”
কিন্তু কে কার কথা শোনে। পল্টু একবার দৌড়ে দরজার কাছে যায়, তারপার ঘরের মধ্যে চরকির মতো পাক খায়। আমার টেবিলের উপর একটা মাথার খুলি ছিল। সেটা ছিটকে পড়ল। অতনুর খাতার পাতা ঘরময় উড়ছে। এক কোনায় রাখা থালা বাসন উল্টে গেল। দুটো কাঁচের গ্লাস ভাঙল। আমি অসহায় ভাবে বলতে লাগলাম, “বাবা পল্টু শান্ত হ। সব কিছু তোর ভালোর
জন্যই করা।”
নিজের ভালো পাগলেও বোঝে। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখলাম, কুকুরে অন্তত নিজের ভালো বোঝে না। অকৃতজ্ঞ পল্টু ঘরের মধ্যে যেন তান্ডব নৃত্য শুরু করল।
আমি হাল ছেড়ে দিলাম। যে নিজের ভালো টুকু বোঝে না, নিজের শুভানুধ্যায়ীকে নূন্যতম সম্মান দেখায় না, তার জন্য অকারণে চিন্তা করে লাভ নেই। তাঁকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার ক্ষমতা স্বয়ং ভগবানেরও নেই।
হঠাৎ বাইরে কোলাহল শুনলাম। তার মানে বাইরে কুকুর ধরার দল চলে এসেছে। ওদিকে পল্টু তীক্ষ্ণ স্বরে ডাকছে, “উ…উ…।” আমার মাথার মধ্যে আবার জীবে প্রেম চাগাড় দিয়ে উঠল। প্রায় ড্রাইভ দিয়ে পল্টুর মুখ চেপে ধরলাম।
তারপর এক বীভৎস কাণ্ড ঘটে গেল। পল্টু আমার হাত কামড়ে ধরল। আমি উঠে দাঁড়িয়ে ওর পেটে ক্যাঁত করে একটা লাথি মারলাম। পল্টু দরজার উপর ছিটকে পড়ল। ওখান থেকে ছুটে এসে ডান পায়ে কামড় বসাল। বাধ্য হয়ে আবার লাথি মারলাম। ফুটবল খেলা পা। পল্টু উড়ে গিয়ে দেওয়ালে আছড়ে পড়ল। আমি তারস্বরে চিৎকার শুরু করলাম, “বাইরের তালা খোলো। আই অ্যাম আণ্ডার অ্যাটাক।”
দরজার বাইরে বন্ধুরা জড় হচ্ছে। কিন্তু কেউ দরজার তালা খুলছে না। একজন বলল, “তিমিরের কাছে চাবি, তিমির তো নন্দনে সিনেমা দেখতে গেছে।” আমি রাগে, অভিমানে প্রায় কেঁদে ফেললাম। আমি মরতে বসেছি, আর তিমির নন্দনে সিনেমা দেখছে। এই না হলে বন্ধু। চিৎকার করে বললাম, “আমাকে যদি বাঁচাতে চাস, দরজার তালা ভাঙ।”
কিন্তু দরজার তালা ভাঙার দরকার হল না। একটু চাপাচাপি করতেই একপাশের পুরোনো কাঠের পাল্লা ভেঙে পড়ল। পল্টু দরজা খোলা পেয়ে তীরের মতো ছুটে পালাল।
বন্ধুরা আমাকে রক্তাক্ত অবস্থায় মেডিকেল কলেজের এমারজেন্সিতে নিয়ে গেল। ড্রেসিং করে, ইংজেকশন নিয়ে হোস্টেলে ফেরত এলাম। সারাদিন পৌরসভার কুকুর ধরা দলের অপেক্ষা করলাম। কিন্তু কেউ এলো না। তারা এলে আমিই দাঁড়িয়ে থেকে পল্টুকে ধরিয়ে দিতাম।’
মোটাদা আমাদের দিকে তাকিয়ে উদাস মুখে বলল, ‘এবার তো বুঝেছিস কেন আমি কুকুর সহ্য করতে পারছি না। কুকুরকে বেশি লাই দিস নে। একেবারে মাথায় চড়ে নৃত্য করবে। যা হোক, এবার আসি। সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। মেডিসিন আর সার্জারি পড়তে হবে। বিকেলে আবার আসব।’ মোটাদা উদাস মুখে চলে গেল।
খানিকক্ষণ বাদেই কুকুরের কেঁউ কেঁউ করে করুণ চিৎকার। তারপর মোটাদার চিৎকার। ‘ওরে বাবারে, খেয়ে ফেলল রে।’
ক্লাবের জানলা থেকে দেখলাম, মোটাদাকে কালু তাড়া করেছে। মোটাদা কালুর লেজে পা দিয়েছে, নাকি পেটে লাথি মেরেছে জানিনা, কিন্তু এটুকু জানি এ মুহুর্তে আমাদের কিছু করার নেই, দেখে যাওয়া ছাড়া। আমরা রুদ্ধশ্বাসে দেখতে লাগলাম দৌড়ে কে জেতে, মোটাদা নাকি কালু।
ছবি নেট থেকে ঝাড়া।