কিছু কিছু মানুষ কিছুতেই হারেন না। বারবার ফিরে আসেন। যেমন উত্তম দত্ত মহাশয়। বিরাটিতে স্টেশনের কাছে বণিক পাড়ায় ‘মায়ের বাড়ি’র ঠিক পাশে তাঁর একটি বইয়ের দোকান আছে- বইঘর। আমার মেসোমশাইয়ের বন্ধু। আদ্যপ্রান্ত বইপাগল মানুষ। সামান্যই আলাপ ছিল।
দিব্যি চলছিলো সবকিছু। কিন্তু করোনা আসতেই গোলমাল হয়ে গেল। বইঘর বন্ধ। বইমেলা বন্ধ। লকডাউনে যারা বই কিনছেন তাঁরাও অনলাইনে কিনছেন। উত্তমকাকু পুরনো দিনের মানুষ। অনলাইন বোঝেন না। ফেসবুক বোঝেন না। তিনি বই বোঝেন। ট্রেনে বাসে করে ভারী ভারী বইয়ের পেটি নিয়ে বইমেলার সিজিনে দুর দুরান্তে, জেলায় জেলায় বইমেলা করে বেড়ান। লকডাউনে আচমকা সব বন্ধ।
এর মধ্যে আরো মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেল। ২০২০ সালের মাঝামাঝি উত্তমকাকুর স্ট্রোক হয়ে গেল। বারাসাত হাসপাতালে ভর্তি হয়ে কোনো রকমে প্রাণে বাঁচলেও একদিক অসাড় হয়ে গেল। হাঁটাচলা বন্ধ। আয় বন্ধ। বিছানা বন্দী জীবন। ভালো কবিতা লিখতেন, আর কলমই ধরতে পারেন না।
লকডাউনের মধ্যেই একদিন মেসোমশাই ফোন করলেন, উত্তমকাকু আমাকে দেখাতে আসবেন। ভ্যানে করে কাকিমা, উত্তমকাকুকে নিয়ে বাড়ির চেম্বারে দেখাতে এলেন। প্রথম যেদিন এলেন, ভ্যান থেকে নামতে পারেন নি। ওষুধপত্র লিখে বলেছিলাম ফিজিওথেরাপি করলে ভালো হয়। কিন্তু সেই দুঃসময়ে স্ট্রোকের প্রধান চিকিৎসা ফিজিওথেরাপি করানোটাও অনেকের কাছে বিলাসিতা ছিল।
কিছু ব্যায়াম শিখিয়ে দেওয়া হলো। আস্তে আস্তে উন্নতি হচ্ছিল। তবে আসল উন্নতি শুরু হলো যখন লকডাউন উঠে গেলো। উত্তমকাকু বারবার বলতেন, ‘যে করে হোক খাড়া হতেই হবে। বইমেলাগুলোর সময় চলে এসেছে।’
তারপর তিনবছর চলে গেছে। উত্তমকাকুর সাথে পরিচয় অনেক গাঢ় হয়েছে। উনি এখন পুরোপুরি সুস্থ। কেউ দেখলে বুঝতেই পারবেন না, ওনার স্ট্রোক হয়েছিলো। বইঘর দিব্যি চলছে। বিভিন্ন বইমেলাতেও যাচ্ছেন। কাকিমাও আটকান না। বলেন, ’মানুষটা বইয়ের মধ্যে থাকলে ভালো থাকেন।’ আগে প্রায় প্রতি মাসেই দেখাতে আসতেন। এখন তিন চার মাস পরপর আসেন। প্রেশার, সুগার সবই নিয়ন্ত্রণে। আমি শুধু রিপিট অল লিখে বইয়ের গল্প করি।
অনেকদিন ধরেই বলতেন বইঘরে আমাদের প্রকাশনীর কিছু বই বিক্রির জন্য দিয়ে আসতে। আজ রাতে গেছিলাম স্কুটার নিয়ে। কিছু বই দিয়ে এলাম- স্কুটারে একসাথে যত বই নিয়ে যাওয়া যায়। বইয়ের মধ্যে ওনাকে দেখে এতো ভালো লাগলো, আনন্দে চোখে জল চলে এল। এভাবেও ফিরে আসা যায়!
দুনিয়ার সব বই পাগলরা ভালো থাকুন। তাঁরা প্রত্যেকে আমার আত্মার আত্মীয়।