মানুষ শুধু বেঁচে থাকার জন্য কতো কী যে করতে পারে! তাও খুব ভালোভাবে বাঁচা না, কোনো রকমে দু’বেলার খাবার জোগাড় করে পশুর মতো বাঁচা।
খুপরিজীবী ডাক্তার হয়ে আমার লাভ ক্ষতি কী হয়েছে জানি না- কিন্তু একটা লাভ অবশ্যই হয়েছে। সারাদিনে প্রচুর মানুষ দেখি, তাঁদের গল্প শুনি। অন্য কোনো পেশায় গেলে এই সুযোগ হতো না।
খুপরিতে মাঝে মাঝেই একটি পনেরো- ষোলো বছরের ছেলে আসত। সঙ্গে থাকত তার একেবারে ছোটো বোন। ছেলেটি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকত। ভিড় কমার অপেক্ষা করত। ভিড় কমলে আমার সহকারী গৌরের কাছে যেত। গৌর তার পিঠের ক্ষতচিহ্ন গুলো বিটাডিন দিয়ে মুছে দিত। মলম লাগিয়ে দিত।
প্রথম যেদিন ছেলেটি জামা খুলে পিঠ দেখিয়েছিল, চমকে গেছিলাম। সারা পিঠে অজস্র ক্ষতচিহ্ন। জিজ্ঞাস করলাম, ‘কী করে হলো? কেউ মেরেছে?’
ছেলেটি মৃদু হেসে বলেছিল, ‘আমার নিজের ভাগ্যই আমাকে মেরেছে।’
ছোট্টো মেয়েটি দাদার পিঠের দিকে তাকিয়ে একটা লজেন্সের খোসা ছাড়ায়। আমি দাগ গুলো দেখছিলাম। একই রকম লম্বাটে দাগ। সরু বেত দিয়ে মারলে যেমন কালশিটে পড়ে যায়।
ছেলেটি বলল, ‘ট্রেনে ভিক্ষা করি। নিজের পিঠে নিজেই লাঠি দিয়ে মেরে ভিক্ষা চাই। আর কিছু পারি না তো। বাবা মা নেই, পড়াশুনো শিখিনি, গান জানিনা।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘তা বলে এতো জোরে জোরে মারবি? এতো কয়েক জায়গায় চামড়া ফেটে রক্ত বেরিয়ে গেছে!’
ছেলেটি বলল, ‘জোরে না মারলে, দাগ না পড়লে- কেউ পয়সা দেয় না তো!’
ভেবে দেখলাম, ঠিকই তো, ছেলেটা কোনো কিছু না করে যদি ভিক্ষা চাইতো তাহলে কেউ টাকা দিতো না। একটা রাস্তার ছেলে আর তার বোন বাঁচলো না মরলো তাতে কারো কিছু যায় আসে না। তাই ছেলেটা এই বীভৎস রাস্তা নিয়েছে। সে তার সীমিত বুদ্ধি দিয়ে বুঝে গেছে সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষ আসলে এই বীভৎসতাকে পছন্দ করেন। আর যারা করেন না, তাঁরা এটাকে থামানোর জন্য পয়সা দেবেন।
কদিনের মধ্যেই জেনেছিলাম, ছোট্ট মেয়েটি আসলে ছেলেটির নিজের বোন নয়। সেও পথ শিশু। ছেলেটির পেছন পেছন খাবারের জন্য ঘুরত। ঘুরতে ঘুরতে স্থায়ী ভাবে তার বোন হয়ে গেছে। ছেলেটি হেসে বলতো, ‘বড্ড মায়া পরে গেছে। আমার তো পৃথিবীতে নিজের কেউ নেই। ভগবান বোনটাকে দিয়েছে।’
ছেলেটি একদিন বলল, ‘আর কিছু টাকা জমাতে পারলেই এটা ছেড়ে দেব। বাদাম, ছোলা, চানাচুরের প্যাকেট বিক্রি করব।‘
জিজ্ঞাস করলাম, ‘কতো টাকা লাগবে?’
সে উত্তরে যে টাকার অংকটা বলেছিল, সেটা অত্যন্ত সামান্য। একটি ছেলে যদি এই সামান্য কটি টাকা পেলে এই বীভৎস রাস্তা থেকে সরে আসে তাহলে সেটা না দেওয়ার কোনো কারণই নেই। ছেলেটি অবাক ভাবে বলেছিল, ‘আমি কেন আপনার কাছ থেকে টাকা নেব?’
বললাম, ‘মনে কর তোকে ধার দিচ্ছি। তুই অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে আমাকে ফেরত দিয়ে দিস।’
ছেলেটি একগাল হেসে বলল, ‘অবশ্যই ফেরত দেব। আমাকে কটা দিন সময় দেন।’
তারপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। ছেলেটি ড্রেসিং করার জন্য আর আসেনি। তার আর কোনো খবর পাইনি। তবে এটা জানি সে যে কোনোদিন ধার শোধ করার জন্য আসবে তার বোনের হাত ধরে। ছোট্টো মেয়েটির পরনে থাকবে একটা হলুদের উপর লাল লাল ফুল তোলা নতুন ফ্রক।