জ্বর কিংবা জারি/ মহা কিংবা মারি?/ অ্যান্টি বায়োটিকটিকি/ সারাবে কি ঠিক ঠিকই?/ ম্যালেরিয়া ফ্যালেরিয়া,/ কর্কশ কর্কট ভয়ে/ যদি কভু কাঁপে হিয়া/ ঠিক হবে কী দিয়া?/ অ্যান্টি বায়োটিকটিকি?/মরে গেলে সব ফাঁকি।।
আমাদের বুড়ো টেকো হাতুড়ে ডাক্তার গিলা মেটের ঝোলে রুটি ডুবিয়ে খেতে খেতে এই ভয়ানক কবিতাটি লিখতে থাকেন। গিলা মেটে জানেন? মুরগির গলা পাকস্থলী, মেটুলি – এ সবের ঝোল। কুড়ি টাকা প্লেট। এই যে ভয়াবহ কবিতা তৈরি হচ্ছে তারও একটা চমৎকার পশ্চাৎপট আছে।
পিছনাম্বু এবং ছত্রাক:
এক শ্যামবরণ দাড়ি-ঢাকা একটি যুবক ন্যাতপ্যাত করতে করতে তার মাতুলবাবুর সঙ্গে বুড়োর ভাঙা খুপরিতে নভেম্বরের বারো তারিখে এসে হাজির হল। উনিশের সন্ধ্যায় বিবাহ। পঁচিশে মধুচন্দ্রিমা কেরলের পিছনাম্বু মানে ব্যাকওয়াটারে। দু’ মাস আগে ছোকরার ইউরেটারে পাথর গজায়। পাইপ বসিয়ে পাথর বার করে পরে স্টেন্ট বা পাইপটা খোলা হয়। তার পর থেকে শুরু কাঁপুনি দিয়ে জ্বর। দুইখান মহানামধারী হাসপাতালের পর যে কেন ওরা এই ভুয়ো ডাক্তারের ভাঙা খুপরিতে হাজির হল, তা ভেবে ভেবে টাক-ফাক চুলকে হাতুড়ে শোনেন, স্টেন্ট বার করার পর থেকে দু’ মাস ধরে ভয়ানক কাঁপুনি দিয়ে জ্বর হচ্ছে। বাজারের সব রকম অ্যান্টি-বায়োটিকের স্টক শেষ, লেকিন জ্বরে জর্জরিত যুবক। দীর্ঘনাসা হাতুড়ে একটা সবুজ রঙের বইয়ের কথা মনে রেখে শ্রীহরিসেনকে স্মরণ করে একটা জম্পেশ অ্যান্টিফাঙ্গাল ঠুকে দিলেন (ডিপ অর্গান মাইকোসিস)।
তার পর হল মুশকিল। রাত্রি জাগরণে রক্তচক্ষু কপালে জ্যাবড়াসিঁদুর নববধূ তেইশে নভেম্বর সকালে এসে দু’ ফোঁটা চোখের জলে এক টুকরো হাসি মাখিয়ে বলল, “ডাক্তারকাকু জ্বর তো সেরে গেছে। কিন্তু আমাদের ব্যাকওয়াটার হানিমুনটা যে তুমি ক্যানসেল করে দিলে তার কী হবে?”
বেচারা অপ্রস্তুত থতমত ডাক্তার একটা বোকা হাসি দিয়ে জামার কলারটা একটু তুলল। তা হলে এটা ডিপ অর্গ্যান মাইকোসিসই ছিল – জয় চাঙায়নী সুধা, জয় বাবা থুম্বোনাথ।
সাদা গাড়ির মন্ত্রীমশায় এবং চিৎপটল:
প্রভুর আজব লীলা/ সুরাতেও ভাসে শিলা।
হ্যাঁ মশায়, তখন বুড়ো ডাক্তার ছোকরা হাতুড়ে ছিল। একটা ভগ্নপ্রায় দোকানের ক্ষুদ্রতম প্রকোষ্ঠে টেবিলফ্যান চালিয়ে ঘামত আর ঘামত। একদিন, না না, এক সন্ধ্যায় দোকানের বিক্রয়বালক বাপি একজন ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত চমৎকার স্থূলকায় ব্যক্তিকে ঠেলে ঠুলে কোনোক্রমে ছোট্ট ঘরের সরু দরজা দিয়ে ঢুকিয়ে দিল।
দোকানের মালিক মামাবাবু বললেন, “ইনি অমুক বিভাগের সর্বময় মন্ত্রী”। ওঁর কিছু দিন ধরে জ্বর-গলাব্যথা-কাশি – বর্তমানে বড্ড শরীর খারাপ লাগছে। দু’ রকম অ্যান্টিবায়োটিক হজম করেও জ্বর কমেনি। বরং শরীর বেশি খারাপ হয়েছে।
এমনিতেই আমাদের আধাপাগল ডাক্তারের মাথা অনেক সময় ঠিকঠাক কাজ করে না, তার ওপর মন্ত্রী-সান্ত্রী দেখলে পরে ঘেবড়ে ‘ঘ’ হয়ে যান। দেখা গেল উনি আগে যে সব অ্যান্টিবায়োটিক খেয়েছেন সেগুলো এই হাতুড়ে ভালো করে জানেনই না। অনেক ভেবে এবং চিন্তে ছোকরা হাতুড়ে একটা সাধারণ রক্তপরীক্ষা লিখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। ওষুধ না লেখায় মন্ত্রীমশাই রেগে ঘোঁত ঘোঁত করতে করতে বেরিয়ে গেলেন। ডাক্তার দরজার নোংরা পর্দা দিয়ে কপালের ঘাম মুছে দম ফেললেন।
কিন্তু ওই যে বলে তুমি যাও বঙ্গে…। পরের দুপুরে ছোকরার থান ইট সাইজের মোবাইল ফোন কড়কড়িয়ে বেজে উঠল। এক মহাবিখ্যাত প্যাথলজি সেন্টারের ফোন। জানা গেল, মন্ত্রীমশাইয়ের রক্তে ক্যানসার। এবং ক্যানসার কোষগুলো প্রায় ষাট শতাংশ স্বাভাবিক কোষ দখলে নিয়ে ফেলেছে। সুতরাং আবার ছোটো ছোটো ছোটো। সবুজ বাজাজ ক্যাবে চেপে মন্ত্রীমশাইয়ের বাড়ি খুঁজে পেয়ে তবে শান্তি। তার মানে জ্বর হল আর কপাত করে অ্যান্টিবায়োটিক খেলাম, গল্প নয়কো সহজ অত।
একটি চমৎকার বালকের চমৎকার জ্বর:
এই কিছু দিন আগে এক অতি ভদ্রলোক তার শীর্ণ বাচ্চা নিয়ে পথভোলা এক পথিকের মতো এই খড়গনাসা টেকো হাতুড়ের কাছে হাজির। দীর্ঘ তিন মাসের জ্বর। দু’জন পাশ করা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখেছেন। দু’ বার ঝকমকে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ওজন কমছে। সন্ধ্যার তারাগুলো আকাশে ফুটলেই জ্বর আসে। ক্লাস নাইনের ছেলেটার বাবা জলের ব্যবসা করেন। মানে ঠান্ডা জলের। সঙ্গে পান ইত্যাদি বেচে থাকেন। রক্তে ইএসআর বেড়েছে। হাতুড়ে বড়ো ভয় পেল। একটা বাচ্চা ডাক্তার নাম সব্যসাচী সেনগুপ্ত – চমৎকার গল্প লেখে – তাকে ফোনে জিজ্ঞাসা করলেন –“ভাই সব্যসাচী, এই হল ব্যাপার – আমি কি এই ধাড়ি বাচ্চাটাকে টিবির ওষুধ শুরু করে দেব?”
সব্যসাচী অত্যন্ত জ্ঞানী ছেলে – ধীর স্থির মানুষ – ধৈর্য ধরে শুনেটুনে সায় দিল। যা-ই হোক, সব্যসাচীর নিঁখুত পরামর্শে জ্বরের রোগী টিবির ওষুধে সেরে গেল।
কালীপূজা, আলোকসজ্জা এবং মায়ের চোখের জল:
এত দিনে হাতুড়ে আরও আরও বুড়ো আর খ্যাপাটে হয়েছেন। এক অতি সাধারণ গৃহস্থ মা তার লম্বাটে শ্যামল ঝাঁকড়া চুলের কিশোরছানাকে নিয়ে হাজির হল। জ্বরে জেরবার। প্রায় দু’মাস ধরে।
হাতুড়ের বিদ্যেবুদ্ধি বেশ কম। পাজামা-পাঞ্জাবি পরে চেম্বারে বসে বসে চা গেলে আর গান করে। অনেক দিন পরে একটা রোগী পেয়ে বেশ ঠুকেঠাকে টিপে টুপে উলটে পালটে দেখল। ঘাড়ে কুঁচকির কাছে বগলের নীচে কয়েকটা গ্ল্যান্ড ফুলে রয়েছে। আগেকার ব্যস্ত ডাক্তারেরা বোধহয় দেখার সময় পাননি। হাতুড়ের মতো কর্মহীন তো নন?
যা-ই হোক, গ্ল্যান্ডের বায়োপসি নিয়ে কালীপুজোর ঠিক আগের দিন অতি সাধারণ মা এসে ফাঁকা চেম্বারে বসে আছেন। তাঁর দু’ চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে লবণাক্ত জল। নীরবে রিপোর্টটা হাতুড়ের হাতে তুলে দিলেন। ব্লাড ক্যানসার। টেবিলে মাথা রেখে সেই চিরন্তন মা বলেন, “ছেলেটা এখন বাড়িতে দিদির সঙ্গে টুনিলাইট লাগাচ্ছে। আমি বাড়ি ফিরে ওর সামনে দাঁড়াব কী করে?”
হ্যাঁ, আমারও কিছু গর্ব আছে, বাঁচার রসদ আছে। গতকাল খবর পেলাম ছেলেটা কেমোথেরাপি নিয়ে একদম ‘ভালো’ আছে।
সব ডাক্তারবাবুরা কি একই রকম ভালো লেখেন !
হ্যাঁ বলবো না না বলবো ? টু বি অর নট টু বি ?
সুপ্রভাত স্যার,
আমার শ্বশুর মশায় প্রায় 2 মাস ধরে জ্বর রয়েছে। আমি আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে চাই। আপনার যোগাযোগ নম্বর বা চেম্বার নম্বর দিন।
ধন্যবাদ
প্রশান্ত আচার্জী