“আমার কুঁড়েঘরে নেমেছে শীতকাল
তুষার জ’মে আছে ঘরের মেঝে জুড়ে বরফ প’ড়ে আছে
গভীর ঘন হয়ে পাশের নদী ভ’রে….”
– হুমায়ুন আজাদ
……..ডিসেম্বর মাস। পাহাড়ে যথারীতি প্রবল ঠান্ডা। রাম্ভীঝোরার ধারে আমার ঘর রাতে প্রায় বরফ শীতল হয়ে যায়। কম্বলে কাজ হয় না। খাটের নীচে হিটার জ্বালিয়ে শুয়ে থাকি। মাথার কাছে একটা চল্লিশ ওয়াটের টাংস্টেন বাল্ব জ্বলে সারারাত। সব আলো নিভে গেলে খুব অস্বস্তি হয়। অনেক রাত অবধি জেগে বই পড়ি। নয়ত পুরোনো ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’।
এই এত বছরের জীবনে শুচিশ্মিতা একবার মাত্র দার্জিলিং বেড়াতে গেছে। সেই ছোটবেলার স্মৃতি হারিয়ে গেছে কবেই! জানুয়ারীর প্রবল ঠান্ডার মধ্যে একদিন ও আর আমি দার্জিলিং গেলাম। হোটেল ফাঁকা। তবে বৃষ্টি, কুয়াশা কিছুই নেই। আকাশ বেশ পরিস্কার। কিন্তু শুচিশ্মিতা ঠান্ডায় অসুস্থ হয়ে পড়ায় বিশেষ কিছু ঘুরতে পারলাম না।
একদিন ট্রাউট মাছ ধরা পড়ল রাম্ভী-তে। বিরাট হইচই। হোটেলে জয়ন্তদা-র রেসিপি-তে রান্না হল সেই মাছ। সবাই গন্ধে গন্ধে সন্ধ্যাবেলাতেই হোটেলে হাজির। হোটেলে খেতে গেলে অনেকের সাথে দেখা হয়। না হলে সারা বিকেল,সন্ধ্যা, রাত বড় একাকী মনে হয়। আউটডোরের শেষ রোগীটা চলে যাওয়ার পরে নিঃঝুম হতাশা নেমে আসে চারপাশে। তরল অন্ধকার গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়। শীতকাল। চারদিক প্রায় নিস্তব্ধ। রাম্ভীঝোরাতে জল খুব কম। হাল্কা কুলকুল আওয়াজ।
শিলিগুড়িতে থাকলে সন্ধ্যেয় চেম্বার। গভীর রাত পর্যন্ত প্যারামাউন্ট বা নর্থ বেঙ্গল ক্লিনিকে। হয় অমলদা, নয়ত নিজের অপারেশন। আবার একদিন উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে গেলাম মাইকেলদা-র খোঁজে। আশুতোষের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আশু আর আমি একসাথে মেডিক্যাল কলেজে পড়েছি। তখন ও উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে। ওর কাছে খবর পেলাম আমাদের অভিরূপ আছে মিরিক বিপিএইচসি-তে।
অভিরূপ মেডিক্যাল কলেজের হোষ্টেলে আমার এককালের রুমমেট। অনুকুল ঠাকুরের শিষ্য অভিরূপ চিরকালের নির্বিরোধী প্রশ্নহীন বাধ্য ছাত্র। আমার মত বিপজ্জনক রুমমেটকে বেশ কিছু বছর ও যে সহ্য করেছিল- এমনকি নিরামিশ লাউয়ের তরকারীতে গোপনে চিংড়িমাছ মিশিয়ে দেওয়া অথবা ওর দুধের বাটি বেড়াল দিয়ে খাইয়ে দেওয়ার পরেও- সেটা ওর মহানুভবতা।
আশুতোষ এলো একদিন আমাদের শিলিগুড়ির বাড়িতে। অনেক কথা হল পুরোনো। ঠিক হল একদিন সবাই মিলে মিরিক যাব। যদিও সে যাওয়া আর হয়ে ওঠে নি। যদিও অভিরূপ এসেছিল শিলিগুড়িতে।
শিলিগুড়ি অর্থোপেডিক ক্লাব তৈরী হল। অমলদা, ডাক্তার অনিল চৌধুরী, ডাক্তার শাসমল, ডাক্তার মোহপাল, মাইকেল-দা এবং আরো অনেকে। অর্থোপেডিক্স নিয়ে আলোচনা হত। সুযোগ পেলেই থাকতাম। সবাই আমার সিনিয়র। ওখানে সবাই বলল,
‘তুমি কেন বিপিএইচসি-তে পড়ে রয়েছ? অথচ এদিকে দেখ উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ এবং শিলিগুড়ি মহকুমা হাসপাতালে অর্থোপেডিক্সে লোক প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। মেডিক্যাল কলেজে চলে এস।’
আমি নিজেই যেন আমার পোষ্টিং হেল্থ সেন্টারে করিয়েছি!
মাইকেল-দা বলতেই উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের সুপার আমাকে মেডিক্যাল কলেজে তুলে আনতে খুব উৎসাহী হলেন। চিঠিও লিখলেন স্বাস্থ্যদপ্তরে। শিলিগুড়ি হাসপাতালও লিখেছিল অনুরূপ একটা চিঠি। কিন্তু নীচুতলা, বিশেষতঃ কলকাতা থেকে দূরের হাসপাতালগুলোর প্রয়োজন বা মতামতকে উচ্চপদস্থ কর্তাব্যাক্তিরা কবেই বা গুরুত্ব দিয়েছে! সুতরাং সেসব চিঠি বাতিল কাগজের ঝুড়িতে চলে গেল।
সামতাহার হেল্থ সেন্টারের সংস্কার শুরু হবে শুনলাম। আমাকে তাহলে এবারে যেতেই হবে। রাম্ভীতে ক’দিন থাকব জানি না। কাজ না থাকলে মাঝে মাঝে মাঝে উদভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়াই। কোনো কোনোদিন স্কুটারে শুকনা। অশোক দাশগুপ্ত-র সাথে। শুচিশ্মিতার সাথে সিনেমা। শুকনায় একবার হাতির কবলে পড়তে পড়তে বেঁচেছিলাম।
রাম্ভীতে একবার এক কাঠমিস্তিরি এসে বলল,
‘ডাক্তারবাবু, এখানে সেগুনকাঠ খুব সস্তা। প্রায় হাফ দাম। কিছু ফার্নিচার বানিয়ে দিই। সুন্দর টেঁকসই হবে। অনেকেই বানিয়ে নিয়ে যায়।’
‘আমি এখানে একা থাকি। ফার্নিচার দিয়ে কি করব? তাছাড়া আমি সবে চাকরি পেয়েছি। আমার অত টাকা নেই।’
আমি জানতাম ওই কাঠগুলো বেআইনি ভাবে কাটা। সেইজন্য দাম খুব কম। তাই এড়িয়ে গেলাম। কিন্তু সেই কাঠমিস্তিরি আমার পেছনে লেগে রইল কিছুদিন। তারপর একসময় হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিল।
শীতকালে একটাও বিয়ে নেমন্তন্ন আসবে না, তা আবার হয় না কি! লেগে গেল অরুণের ভাইয়ের বিয়ে। হাসপাতাল আর থানার সবার নেমন্তন্ন। সবাই সেজেগুজে চললাম নেপালী বিয়েতে। সাজানো গেটের মুখে আমাদের বরণ করা হল। কপালে দিল রক্তের তিলক। হাতে ধরিয়ে দিল কমলালেবু থেকে ঘরে তৈরী এক ধরণের স্থানীয় মদ। আমাদের অনেকেই আপত্তি করল। বিশেষতঃ মহিলারা। আমি বললাম,
‘এটা ওদের সামাজিক প্রথা। গেলাসটা অন্ততঃ ঠোঁটে ছুঁইয়ে নিন। না হলে ওরা দুঃখ পাবে।’
যেটা বললাম না সেটা হল, সামাজিক অনুষ্ঠানে প্রথাভঙ্গ করলে এরা খুবই রেগে যায়। আর রেগে গেলে কুকরীও চালিয়ে দিতে পারে। অবশ্য সেটা সামনে থেকে। সাধারণতঃ পেছন থেকে ছুরি মারে না এরা।
প্রচুর খাওয়া দাওয়া হল। নেপালী প্রথায়। অনেক রাত করে হাসপাতালের কোয়ার্টারে ফিরলাম সবাই।
মিরিক থেকে অভিরূপ একদিন এল আমাদের শিলিগুড়ির বাড়িতে। আশুতোষও এল। অভিরূপ-ই কাগজের বিজ্ঞাপনটা দেখাল। বহুবছর বাদে স্বাস্থ্যদপ্তর আর এম ও পোষ্টের জন্য ইন্টারভিউ নেবে। কাগজপত্র জোগাড় করে আবেদনপত্র পাঠালাম কলকাতায়। এটাই শেষ সুযোগ। এ সুযোগ হারালে আমাকে সামতাহারে যেতেই হবে এবং পড়ে থাকতে হবে অনন্তকাল।
(ক্রমশঃ)