“বনের ছায়ার নিচে ভাসে কার ভিজে চোখ
কাঁদে কার বাঁরোয়ার বাঁশি
সেদিন শুনিনি তাহা…..”– জীবনানন্দ দাশ
সেই যুগে শিলিগুড়ি গেছে অথচ হংকং মার্কেটে গিয়ে ঠকেনি এরকম বাঙালী ছিল বিরল। সুতরাং আমরাও বাঙালীর মান রাখতে হংকং মার্কেট অভিযানে গেলাম এবং যথারীতি ঠকলাম। তবে যেহেতু হাতে পয়সাকড়ি খুব কম ছিল, ঠকার পরিমাণটাও হল কম।
বাবা-মায়ের ইচ্ছে সেভক কালীবাড়িতে পুজো দেয়। তাদের নিয়ে যাওয়া হল সেভক। বেশ শান্ত পরিবেশ। ভক্তরা সুশৃংখল। অনেকটা ওপরে মন্দির। ধীরে ধীরে সূর্য ডুবে গেল। সন্ধ্যা নামছে তিস্তার চরে। গোধূলির মায়াবী আলোয় দিগন্ত ব্যথাতুর। আমাদের চারজনের চোখ অনাগত অশ্রুতে চিকচিক করছে। ওরা ফিরে গেল শিলিগুড়ি। আমি চললাম রাম্ভী।
সেবার ওয়েষ্ট বেঙ্গল অর্থোপেডিক অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক কনফারেন্স হল শিলিগুড়িতে। শিলিগুড়ি টি-অকশন হলে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। অতিথি হিসেবে সিএমওএইচ সাহেব বসে আছেন হল আলো করে। আমাকে ষ্টেজে উঠতে দেখে উনি খুব অবাক হলেন। ডাঃ ইন্দ্রজিৎ সর্দার একটি বিশেষ ইস্যুতে এক অসাধারণ বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। অনেকদিন বাদে আমার কোনো পেপার ছিল না সেবার। শুধু একটা মেডেল।
শিলিগুড়িতে ফাঁকা সময়ে ঠিক করলাম কম্পিউটার শিখব। তখন সবে কম্পিউটার সাধারণ মানুষের জীবনে প্রবেশাধিকার পেয়েছে। ১৯৯৭ সালে আমার কলেজের বন্ধু ওরফে ভাই ভেঙ্কট একটা ইমেল অ্যাকাউন্ট তৈরী করে দিয়েছিল আমাকে। কম্পিউটারের অভাবে সে আর ব্যবহার হত না। নানান ঘটনার চাপে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম সেসব। সেই যুগের কেউই স্কুল থেকে কম্পিউটার শেখে নি। আলাদা করে শিখতে হত। কম্পিউটার জানতাম না বলে থীসিস লেখার সময় পদে পদে হোঁচট খেতে হয়েছিল। শিলিগুড়িতে একটি পরিচিত সেন্টারে কম্পিউটার শিখতে শুরু করলাম। তবে অধিকাংশ দিন রাম্ভীতেই থাকতাম আর ক্লাস করা হত না।
কম্পিউটার সেন্টারের মালিক সুমন্ত। সে প্রায় আমারই বয়সী। তার বাবা ছিলেন সুকনা চা বাগানের অ্যাকাউন্ট্যান্ট। ওর সাথে গিয়ে একদিন চা বাগান, চায়ের ফ্যাক্টরী এসব দেখে এলাম। সে যেন এক অন্য জগত। অনেক বিস্তৃত ক্ষেত্র জুড়ে বাগান। মাঝে মাঝে হাতি আসে। কখনো বুনো শুয়োর, চিতাবাঘও। আমাকে ওরা নিয়ে গেল একটা এয়ার ষ্ট্রীপের মত জায়গা দেখাতে। যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ছোট ছোট প্লেন নামাওঠা করত। হাল্কা সোনালী রঙের ফার্স্ট ফ্লাশ লিকারের সাথে পেষ্ট্রি খেতে খেতে গল্প হল সুমন্ত-র বাবা মায়ের সঙ্গে। চা-বাগানের হাত বদলের গল্প। ব্রিটিশ যুগ থেকে মাড়োয়ারী যুগ।
শীত শেষ হয়ে আসছে। শীর্ণ পাহাড়ি ঝোরার কুলকুল শব্দ, শুকনো সেগুন পাতার মর্মর, খর্খর শব্দগুলো রাম্ভীর নৈঃশব্দ্যের সঙ্গে যেন সঙ্গত করছে। আসেপাশে কেউ কোত্থাও নেই। পুরনো, ভাঙা লোহার ব্রীজটার পাশ দিয়ে রাম্ভীঝোরার কাছে নেমে যাই। কাকচক্ষু ঠান্ডা জলের পাশে সারা বিকেল নিঃশব্দে ডুবে যেতে থাকি। হঠাৎ পাশের শিমুল গাছটা থেকে কুটর্ কুটর্ শব্দে উড়ে গিয়ে সেই নৈঃশব্দ্য ভেঙে খানখান করে দেয় হলদে-সবুজ রঙা বসন্তবৌরি। গাছের শুকনো ঝরা পাতা আর ঘরে ফেরা পাখীদের ডানায় ভর করে জঙ্গলে সন্ধ্যা নেমে আসে।
হাল্কা শীতের আমেজ তখনো রয়ে গেছে। আউটডোরে রোগী খুব কম। কাজ না থাকলে খই ভাজে লোকে। একদিন ষ্টোর খুলে বহুদিনের পুরনো লালচে হয়ে যাওয়া কাগজপত্র, ধুলোবালি, জঞ্জাল, ওষুধের প্যাকিং বাক্স- সব পরিষ্কার করা হল। পালস পোলিও-র দিন গাড়ী নিয়ে কালিম্পং-এর পাহাড়ে-পাহাড়ে ঘুরলাম। সারাদিনের শেষে প্রাপ্তি- লালচে গালে প্রাকৃতিক রুজ লাগানো নেপালী শিশুদের হাসি-কান্না। সঙ্গে ইয়াকের দুধের টাটকা মাখন আর ইয়াকের দুধ থেকে তৈরি চুইংগামের মত খেতে পাহাড়ী চীজ “ছুরপি”। ঠান্ডায় শরীর গরম রাখতে পাহাড়ের মানুষ ছুরপি চিবোয় সারাদিন।
ইন্টারভিউ দিতে কলকাতা যাব। রাম্ভী থেকে ফিরছি এসএনটি বাসে। সঙ্গে ডাক্তার সুদীপ ঘোষ। আমি একটা সীট পেয়েছি। ড্রাইভারের ঠিক পেছনে। ছিপছিপে, মাঝারি উচ্চতার সুদীপদা দাঁড়িয়ে আছে পাশে। বাসটা পাহাড় থেকে নেমে মহানন্দা ফরেষ্টের বুক চিরে কালো মসৃণ রাস্তায় প্রচন্ড গতিতে ছুটছে। সুদীপদা একবার বাসের হাতল, একবার ড্রাইভারের সীট ধরে ব্যালান্স করে দাঁড়িয়ে আছে। বসতে বললাম, বসল না।
নামেই দুই লেনের হাইওয়ে। কোনো ডিভাইডার নেই। কালো অজগরের মত শুয়ে থাকা রাস্তার মাঝ বরাবর লম্বালম্বি মেরুদন্ডের মত টানা সাদা দাগ। দুপাশে ঘন সবুজ বন। খবরের কাগজ পড়ছিলাম। হঠাৎ ঝনঝন করে ভয়ঙ্কর আওয়াজ। বাসটা দুলে উঠল। সারা শরীর এবং খবরের কাগজ ভরে গেল কাঁচের টুকরোতে। সুদীপদা আর ড্রাইভারের গাল কেটে রক্ত পড়ছে।
‘কি হল?’
‘জোর বাঁচিয়া গেলে।’
‘বুঝতে পারলাম না।’
‘সারাক্ষণ খবরের কাগজ পড়লে বুঝবে কি করে। উল্টো দিক থেকে আসা দুটো আর্মির ট্রাকের মধ্যে দিয়ে বাসটা গেল। বাসের দুদিকে ধাক্কা লাগল ট্রাকের। একচুল এদিক-ওদিক হলে আজ দুজনেই শহীদ হয়ে যেতাম।’
এম ই এস-এর ইন্টারভিউ হল এনআরএসে। ইন্টারভিউয়ের লাইনে দাঁড়িয়ে অনেকের সাথে দেখা হল- যেন কতযুগ বাদে! কে কোথায় আছে তার খবর দেওয়া-নেওয়া চলল। ইন্টারভিউ এমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয়। পাব্লিকেশনের উপর অনেক পয়েন্ট আছে। সুতরাং আমার কিছুটা অ্যাডভান্টেজ। বুঝলাম শেষ মুহুর্তে বিরাট কিছু ওলটপালট না হলে এম ই এসের চাকরিটা পাচ্ছি। পছন্দের হাসপাতাল জানতে চাইলে বললাম উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ। কিন্তু কলকাতা চাইলে বাঁকুড়া বা উত্তরবঙ্গ, আর উত্তরবঙ্গ চাইলে কলকাতা দেওয়াটাই যে প্রথা! যাতে শেকড়টা পুরোপুরি উপড়ে ফেলা যায়।
পোষ্টিং এর লিষ্ট অনেক পরে বেরিয়েছিল। উত্তরবঙ্গে ফিরে গেলাম। আবার রাম্ভী। আমাকে নিয়ে খুব টানাপোড়েন শুরু হল তখন। বি এম ও এইচ বলল, এ বছরের মধ্যে আমাকে সামতাহারে পাঠিয়ে দেবে। ওদিকে এমই এস-এর পোষ্টিং লিষ্ট-টা আইনি ঝামেলায় আটকে গেছে। বিভ্রান্তি আর হতাশা বাড়ছে ক্রমশঃ। কিষানগঞ্জে প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ তৈরী হয়েছে তখন। ওরা যোগাযোগ করেছিল ওদের ওখানে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে। সরকারী চাকরী করি। সুতরাং না বলে দিলাম।
প্রাইভেট হাসপাতাল তৈরী হচ্ছে শিলিগুড়ি ও তার চারপাশে। ওদের স্পেশালিষ্ট ডাক্তার দরকার। আনন্দলোক হাসপাতালের সংস্কার হয়েছে। ডাঃ অজিত মাইতি ছিলেন শিলিগুড়ির নামকরা কার্ডিওলজিস্ট। ওঁর ভাই সঞ্জিত রাম্ভীবাজারে অ্যাডহক মেডিক্যাল অফিসার ছিল। আনন্দলোক সেন্টারে গেলাম একদিন। গোটা হাসপাতাল ঘুরে দেখালেন ডাঃ মাইতি। আমরা দুজনেই আনন্দলোক হাসপাতালে যুক্ত হব সেরকম কথাও হয়ে গেল। যদিও নানান কারণে সেটা আর বাস্তবায়িত হয় নি। কিন্তু ডাঃ অজিত মাইতির সঙ্গে যে আর কোনোদিন দেখা হবে না সেটা সেদিন ভাবিনি। এর বছর দেড়েক পরে শিলিগুড়ির অজানা জ্বর কেড়ে নিয়েছিল ডাক্তার মাইতিকে।