ইভনিং রাউন্ড দেওয়ার পরে সরকারী হাসপাতাল বা মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তারদের একচোট আড্ডা না দিলে রাতে ঘুম হয় না। আমার নিজেরও তাই। আর আড্ডা মানে তো মূলতঃ পিএনপিসি। তবে ডাক্তারদের পিএনপিসি একটা ছোটো বৃত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কার কোথায় পোষ্টিং হল, বিচিত্র সব রোগ আর বিচিত্র সব রোগী- এই সব গল্প।
সেদিন বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় দার্জিলিং জেলা হাসপাতালের সেই আড্ডায় উপস্থিত এই অর্বাচীন। অচেনা মুখ দেখে সবাই কৌতূহলী হয়ে উঠল। তাদের মধ্যে অনেকেই খুব সিনিয়র। ‘কোন কলেজ’ ‘কবে পাশ করেছ’ ‘কি সাবজেক্ট’ তারপর ‘কোন পিএইচসি-তে পোষ্টিং হয়েছে’ ইত্যাদি। শেষ প্রশ্নটার উত্তর শুনে সবাই খুব সহানুভুতি এবং কি করে পৌঁছব সে বিষয়ে অসীম উদ্বেগ প্রকাশ করলেন। কেউ কেউ বললেন ‘অসম্ভব’। শুধু একজন বাদে।
লম্বা মুখের দীর্ঘকায় সেই ভদ্রলোক চুপচাপ এবং গম্ভীর ছিলেন পুরোটা সময়। তারপর একসময় ধীরে ধীরে উঠে চলে গেলেন।
উনি চলে যেতে আমি জিজ্ঞাসা করলাম- ‘উনি কে?’
‘এখানকার অর্থোপেডিক সার্জেন।’
‘ও আচ্ছা।’
ঘরে ফেরার পথে গৌতমদা বলল- ‘তোকে নিয়ে হাড্ডিবাবু একটু টেনশনে আছে।’
‘কেন? আমি তো সেই কোন রিমোট সামতাহারে!’
‘তোর তো এমএস করা আছে। তাই আর কি!’
পরদিন সকালে টিকিট কাটতে গেলাম এস এন টি বাসষ্ট্যান্ডে। অনেক সাধ্যসাধনার পরে এক মক্কেলের দেখা পাওয়া গেল, যে এই বাসের হাল-হকিকত জানে। তার কথা শুনে তো আমার চাকরিস্থলে যাওয়ার সব আশা নিভে গেল। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এই বাস সপ্তাহে তিনদিন কালিম্পং যায়। তবে এখন এই বর্ষায় কবে ছাড়বে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। আর ছাড়লেও আদৌ পৌঁছবে কিনা তাও অনিশ্চিত। পরদিন সকালে একটা হেস্তনেস্ত করার জন্য সিএমওএইচ এর সাথে দেখা করতে গেলাম।
‘কি ব্যপার?’
‘আমি তো স্যর আপনার অফিসে জয়েন করার পরে পোষ্টিং-এর জায়গায় যেতেও পারছি না আর সেখানে থাকবো কোথায় তাও বুঝতে পারছি না।’
‘কেন কোয়ার্টারে থাকবে?’
‘সামতাহারে কোয়ার্টারের অস্তিত্ব নেই সেটা আপনি জানেন না?’
‘তাহলে অন্য কোথাও থাকবে।’
এই অন্য কোথাও মানে হল রাস্তায় থাকা। কারণ সমতলের স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা পাহাড়ের শহরগুলোর মত সামতাহারের আদিবাসী গ্রামে বাড়িভাড়া পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
‘সার্ভিস রুল অনুযায়ী সেটা আপনার-ই ব্যবস্থা করার কথা, স্যর।’
সিএমওএইচ মশাই এমন অর্বাচীনের মুখে সার্ভিস রুলের কথা শুনে ভীষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
‘থাকার কোয়ার্টার, অফিস, টেলিফোন, গাড়ি- সার্ভিস রুল অনুযায়ী একজন গ্রুপ-এ গেজেটেড অফিসারের পাওয়ার কথা। বাকিগুলো আমি বলছি না।’
‘জয়েন করেছ। রাস্তা ঠিক হলে হেল্থ সেন্টারে গিয়ে কাজ কর। আর কিছু আমার হাতে নেই।’
‘ঠিক আছে। এই চাকরী থাকল। কালকে আমি কলকাতা ফিরে চললাম।’
মোমিনপুরের একটা বেসরকারী হাসপাতালের রেজিষ্ট্রারের চাকরী হয়েই ছিল। দার্জিলিং আসার আগের দিনও কবে জয়েন করব জানতে চেয়ে ওরা ফোন করেছিল। সেটাই ভরসা।
কি মনে করে সিএমওএইচ আর কথা না বাড়িয়ে রাম্ভীবাজারের বিএমওএইচ-কে ফোনে ধরল।
‘ঠিক আছে। অর্ডার করে দিচ্ছি। সামতাহারের কোয়ার্টার তৈরী না হওয়া পর্যন্ত রাম্ভীতে কাজ কর। কিন্তু রাম্ভীতেও খালি কোয়ার্টার নেই, এটুকু জানি।’
‘ঠিক আছে। চলি স্যর। ওখানে ঠিক একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
কিন্তু রাম্ভী যাব কিভাবে? ছ’দিন প্রবল বর্ষণের পরে আকাশ পরিস্কার হল। কলকাতায় এরকম টানা ছ’দিন বৃষ্টি হলে গোটা শহর জলের তলায় চলে যেত।
পরিত্রাতা হয়ে দেখা দিল আমারই কলেজের আর এক সিনিয়ার দেবাশীষ-দা। ইএনটি-র রমরমা চেম্বার ছেড়ে পরদিন আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল রাম্ভীর উদ্দেশ্যে। মুখে বলল বিশেষ কাজে শিলিগুড়ি যেতে হবে। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য, আমাকে রাম্ভীবাজারে পৌঁছে দেওয়া।
মান্ধাতার আমলের লেফট হ্যান্ড ড্রাইভ ল্যান্ডরোভার গাড়ি। হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ষ্টার্ট দিতে হয়। ততধিক মান্ধাতার আমলের ড্রাইভার। কিন্তু তার মাথায় কাউবয় হ্যাট, মুখে চুরুট। কেতার কমতি নেই।
দার্জিলিং রেসকোর্সের পাশ দিয়ে তিস্তাবাজার যাওয়ার রাস্তা গেছে জোড়বাংলো, লামাহাট্টা, পেশক হয়ে। রাস্তা সরু আর চড়াই-উৎরাইয়ে ভরা। তাছাড়া সামনে কোথাও ধ্বস নেমে পথ বন্ধ হয়ে আছে কিনা জানা নেই। কুয়াশা ঘেরা পাহাড়ি গ্রামের মধ্যে দিয়ে টলমল করতে করতে চলেছে আমাদের ল্যান্ডরোভার। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা রঙীন ইউনিফর্ম পরে কলকল করতে করতে ছুটে চলেছে স্কুলের দিকে।
চলেছি সিঞ্চল ফরেষ্টের মধ্যে দিয়ে। নীচের দিকে নামার সময় ড্রাইভার সাহেব গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে গীয়ার নিউট্রালে রেখে চালাচ্ছে।
‘এতে তেল বাঁচে, কিন্তু প্রচন্ড বিপজ্জনক।’
দেবাশীষ-দা বলল। কতটা বিপজ্জনক পরে বুঝেছিলাম পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালানো শিখে। বারণ করাতে ড্রাইভার সাহেব মুখের চুরুট নামিয়ে গাড়ি থামিয়ে কটমট করে চেয়ে রইল আমাদের দিকে।
‘পড়েছি যবনের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে।’
ভয় লাগলেও কিছু করার নেই। সারথি যেভাবে রথ চালাবে সেভাবেই তো চলতে হবে! শুধু চিন্তা, মাঝপথে রথের চাকা বসে না যায় (পাহাড়ি পথে পিছলে না যায়)। তাহলে একেবারে ঢাকীসুদ্ধ বিসর্জন!
ধীরে ধীরে নীচে নামছি। অনেক নীচে দেখা যায় তিস্তা আর রঙ্গিত নদীর সঙ্গম। এখানে কখনো জঙ্গল, কখনো চাষের ক্ষেত। পাহাড়ের ঢালে ধাপ কাটা। আদার ঝাঁঝালো সুন্দর গন্ধ আসছে। ক্ষেতে আদা ও গাজর ফলেছে। চা বাগান, কমলালেবু গাছ। এখন বর্ষায় গাছগুলো আছে, লেবু নেই।
পেশকে থামলাম চায়ের দোকানে। ধোঁয়াটে গন্ধ ভরা লোকাল চা। অন্যরকম লাগে। সদ্য তোলা দু-আঁটি গাজর কিনে ফেলল দেবাশীষ-দা। আমার চালচুলো নেই, ওসব কিনে আমি কি করব! সামনে ছোট ধস নেমেছে। মূল রাস্তা ছেড়ে অন্য রুটে যেতে হল।
দার্জিলিং-এর ল্যান্ডরোভার আমাদের নামিয়ে দিল তিস্তাবাজারে। তিস্তাবাজার হল তিস্তা উপত্যকায় একটা গঞ্জ। এখান থেকে রাস্তা গেছে দার্জিলিং, কালিম্পং, গ্যাংটক এবং শিলিগুড়ি। নেপালীরা গঞ্জকে বলে বাজার এবং গ্রামকে বলে বস্তি।
তিস্তাবাজারে পৌঁছে আর এক বিপত্তি। জানা গেল, রাম্ভী ছাড়িয়ে কালীঝোরার আগে রাস্তা ধ্বসে গেছে তিস্তার গর্ভে। রাম্ভী পর্যন্ত যাওয়া যাবে। কিন্তু রাস্তায় কোনো গাড়ি নেই। ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করার পরে মেল্লি-র দিক থেকে আসা একটা খালি ট্রাক পাওয়া গেল। কিন্তু কিছুতেই সে নেবে না আমাদের। অনেক অনুরোধ-উপরোধের পরে সামনের ড্রাইভার কেবিনে জায়গা মিলল। তবে হাসপাতালে যাব শুনে আর আপত্তি করল না।
তুলনামূলক চওড়া রাস্তা। কিন্তু ধ্বসপ্রবণ। পাশ দিয়ে ভয়ঙ্কর গর্জনে বয়ে চলেছে বর্ষার তিস্তা। অন্যপারে পাহাড় ও জঙ্গলের মধ্যে থেকে নেমে আসছে ঝর্ণা-একটা, দুটো, তিনটে। অপরূপ দৃশ্য। ক্যামেরা ছিল না। মনের ক্যামেরায় ধরা রইল দৃশ্যপট।
উনত্রিশ মাইল এলাকায় একটা ঝোরা রাস্তার উপর দিয়ে বয়ে চলেছে। খুব বিপজ্জনকভাবে সেটা পার হতে হল। পাহাড়ের গা বেয়ে মাঝে মাঝেই ছোটবড় মাটির ঢেলা, নুড়িপাথর নেমে আসছে। আমাদের সচকিত করে কয়েকটা এসে পড়ল ড্রাইভার কেবিনের ছাদে।
‘এসে পড়েছি। ওই দেখ নীচে রিয়াং বনবাংলো।’
তারপর একটা বাঁক ঘুরেই বিপিএইচসি-র গেট। নেমে পড়লাম দুজনে। রাম্ভী পুলিশ ফাঁড়ির পাশ দিয়ে রাস্তা নেমে গেছে ঝোরার দিকে। রাম্ভী ঝোরার কোলেই হাসপাতাল। তীব্র গতিতে ঝোরা বয়ে চলেছে অনতিদূরে তিস্তানদীর দিকে। ব্যাগ কাঁধে ঢুকে গেলাম আউটডোরের পাশে বিএমওএইচের ঘরে।