“জীবন গিয়েছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার।”
…..ফোনে অ্যাক্সিডেন্ট বলা হয়েছিল আমাকে। কিন্তু বাড়ি ফিরে জানতে পারলাম আত্মহত্যা। মা-বাবাকে কাকার বাড়িতে রেখে চাকরিতে ফিরতে হল। বাবা ভিআরএস নিয়ে নিলেন। তাঁরা তখন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত।
পাপিয়া-দি এবং অশোকবাবুর পরিবার আগলে রেখেছিলেন আমাদের। পাহাড়ে ফিরে গেলাম একা। শুচিশ্মিতা শিলিগুড়িতে। রাম্ভী ঝোরার পাশে বসে কেটে যেত সারা বিকেল। শরৎ আসছে। আকাশে পেঁজা তুলোর মত মেঘ। সারারাত জেগে থাকি, আর একা একা কথা বলি। ভোরের দিকে ঝিমুনি আসে। নিজের নাক ডাকার শব্দে আবার ঘুম ভেঙে যায়। মনে হয়, ঘুলঘুলির অন্তরালে কে যেন বসে আছে।
বিএমওএইচের ফ্যামিলি কলকাতায়। আমাকে রাতে ওর কোয়ার্টারে থাকতে বলল। ভীষণ ভয় পেত। ডাঃ মাধুরী ফিরে এসেছেন। অবিশ্বাস্য সাহসী মহিলা। তিস্তার ধারে পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা জিএনএল এফ অধ্যুষিত এক বিপিএইচসি-তে একা চাকরি করতে এসেছিলেন। ওনার স্বামী ইঞ্জিনিয়ার। থাকতেন শিবসাগরে।
শুচিশ্মিতা শিলিগুড়িতে প্র্যাকটিস শুরু করেছে ততদিনে। ভালোই হচ্ছে। নিবেদিতা নার্সিংহোমে সীজার অ্যাটেন্ড করছে। কিন্তু নিওন্যাটোলজির ভাল ব্যবস্থা নেই। হিলকার্ট রোডের উপর বেশ ভাল একটা চেম্বারও জুটে গেল। বাবা-মাকে শিলিগুড়িতে নিয়ে এলাম। ওরা আর বারাসাতে পড়ে থেকে কি করবে! ওদের আনতে যাওয়ার পথে ট্রেনে বেঁটেখাটো এক ভদ্রলোক এসে জড়িয়ে ধরল।
‘সব শুনেছি। কেমন আছিস?’
‘চলে যাচ্ছে।’
‘মেডিক্যাল কলেজে চলে আয় একদিন।’
‘যাব।’
শুচিশ্মিতা এসে কানে কানে জিজ্ঞাসা করল, ‘গুন্ডা গোছের দেখতে, কে উনি?’
‘ডাক্তার মাইকেল হীরা। মেডিক্যাল কলেজে আমাদের আর এম ও ছিলেন। এখন নর্থ বেঙ্গলে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর।’
মাইকেলদার সাথে গল্প করতে করতে কলকাতা ফিরলাম। খুব ভালো লাগল। ইন্টার্নশিপ থেকে মাইকেলদার তত্ত্বাবধানে কাজ শিখেছি বিভিন্ন সময়ে। এমন অমায়িক, বন্ধুবৎসল ও পরোপকারী মানুষ কম দেখেছি।
একদিন প্রধান নগরের মোড় থেকে বাস ধরে গিয়ে নামলাম শিবমন্দির মেডিক্যাল মোড়ে। সেখান থেকে হেঁটে নর্থ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ। অনেক পুরনো বন্ধুবান্ধবের সাথে দেখা হল। অর্থোপেডিক্স অপারেশন থিয়েটারে ঢুকতে পেরে মনে হল যেন ঘরে ফিরলাম। মাইকেল-দা বলল, ‘মাঝে মাঝে চলে আসিস।’
বর্ষা চলে গেছে। রাস্তা একটু ভালো। রাম্ভীতে ডিউটি না থাকলে বিকেলে ফিরে আসি শিলিগুড়ি। ডাক্তার অমল বসাক-এর সাথে আলাপ হয়েছে। নর্থবেঙ্গল ক্লিনিক আর প্যারামাউন্ট হাসপাতালে অমলদাকে সাহায্য করি। নিজের দুয়েকটা অপারেশনও করছি তখন। আমার ডায়েরিয়ার ওষুধ লেখার পর্ব থেকে বেরোনো দরকার। নাহলে সার্জারী ভুলে যাব। অমলদার দরকার এক্সপার্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট। অপারেশন শেষ করে ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত দুটো-তিনটে বেজে যায়। নামিয়ে দিয়ে যায় হাসপাতালের গাড়ী। বাড়িওয়ালা এবং প্রতিবেশীদের অসুবিধা হয় নিশ্চয়ই। কিন্তু কেউ কিছু অভিযোগ করে না।
রাম্ভীতে রুগী বাড়ছে। তিন-চারজন ভর্তি থাকছে সবসময়। একদিন এক চা-বাগানের ম্যানেজার এল কোমরের সমস্যা নিয়ে আমাকে দেখাতে। উপহার দিয়ে গেল এক প্যাকেট উৎকৃষ্ট চা। রাম্ভী সংলগ্ন এলাকায় মাশরুম চাষ শুরু হয়েছে তখন। বাটন মাশরুম দিয়ে যেত কোনো কোনো রুগী। রান্না করে খাওয়া হত অরুণের দাদার হোটেলে।
পাহাড়ি মানুষদের মধ্যে দেখতাম উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা খুব বেশী। বাত, যক্ষ্মা, কিডনির অসুখ আর মাদকাসক্তি-ও। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, অনেকেরই রক্তে হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিকের তুলনায় খুব বেশী। প্রায় পলিসাইথিমিয়ার মত। সাধারণ প্রয়োজনীয় ওষুধ প্রায় সবই হাসপাতালে সাপ্লাই ছিল। রুগীদের কিনতে হত না। অধিকাংশ মানুষের কেনার সামর্থ্যও ছিল না।
কয়েকদিন ধরে শুনছিলাম ডিজিএইচসি-র হেল্থ কাউন্সিল ভিজিটে আসবে রাম্ভী-তে। একদিন সিএমওএইচ এলেন। আমাকে বললেন, ‘এখানে আপাততঃ ভালো করে কাজ কর। তারপর দেখছি অর্থোপেডিক্সের পোষ্টিং দেওয়া যায় কিনা।’
ততদিনে বুঝে গেছি দার্জিলিং-এ সিএমওএইচের কোনো ক্ষমতা নেই। আর ওনার ঠুনকো প্রতিশ্রুতির খুব একটা দাম-ও নেই। পালস পোলিওর দিন এল। পাহাড়ের হেল্থ সেন্টার গুলোতে তদারকি করে এলাম।
একদিন সন্ধ্যায় হাসপাতালের চত্বরে পরপর কয়েকটা লালবাতি লাগানো গাড়ি এল। অরুণ দৌড়ে এসে বলল সি কে প্রধান এসেছে। সি কে নিজেকে কালিম্পংয়ের রাজা মনে করত। ওর নামে পাহাড়ে তখনও বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খায়। জিএনএলএফ আন্দোলনের সময় তো সামতাহার ছিল ওর গুহা, স্লটার হাউস। তখন মাথার দাম ছিল কয়েক হাজার টাকা। যার নামে দার্জিলিং জেলার পাহাড়-সমতলের মানুষ এককালে ভয়ে কাঁপত, তাকে দেখার কৌতূহল ছিল আমারও।
ছোটখাটো চেহারা। মুখে ভুরভুর করছে অ্যালকোহলের গন্ধ। কোটের পকেট থেকে একটা ধাতব নল উঁকি দিচ্ছে। আমরা তিনজন ডাক্তার সামনে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। টেবিলের উপর যন্তরটা নামিয়ে রাখল ঠক্ করে। অনেকটা গব্বর সিং-এর ঢঙে। ভাবলাম বলে উঠবে, ‘অব্, তেরা কেয়া হোগা কালিয়া?’
নাঃ, তার বদলে বলল, ‘আপলোগ আচ্ছা কাম কর রহে হ্যায়। অউর ভি আচ্ছা করনা পড়েগা।’
ডাক্তার মাধুরীকে বলল, ‘ম্যাডাম, ইউ আর দ্য বস।’
আমাকে বলল,’ ম্যায় আপকে লিয়ে সামথার মে আচ্ছা হসপিটাল বানায়েঙ্গে। লেকিন আপকো উঁহা জানা পড়েগা।’
‘জরুর।’
আধঘন্টা পর কনভয় বেরিয়ে গেল হাসপাতাল ছেড়ে। আমরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
মনে মনে বললাম, ‘তিনো বাঁচ্ গ্যয়ে!’
(ক্রমশঃ)