‘ডাক্তারবাবু রোগীকে একটু বাইরে এসে দেখতে হবে।’
ঘর থেকে বেরিয়ে চেম্বারের চপ্পলটা ছেড়ে বাইরের জুতোটা পায়ে গলিয়ে নিলাম। উল্টোদিকে একটা মারুতি ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। তথাকথিত অ্যাম্বুল্যান্স–যাতে রোগীর জন্য একটি সরু স্ট্রেচার এং অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়া আর বিশেষ কিছুই নেই। ভাবলাম অ্যাক্সিডেন্টের রোগী। নিশ্চয়ই কোমর বা পা ভেঙেছে! কাছে যেতেই ভুল ভাঙলো। রোগিণী পা ভাঁজ করে স্ট্রেচারে বসে মোবাইল ফোনে কথা বলছে।
‘কি হয়েছে, মানে কি কষ্ট?’
‘কোমরে আর পায়ে কনকনে ব্যথা’।
‘চোট লেগেছে?’
‘না। চোট লাগবে কেন? এমনিই ব্যথা।’
‘কবে থেকে।’
‘এক মাস।’
‘তাহলে চেম্বারে আসুন।’
‘পারবো না। আপনি এখানেই দেখুন।’
‘অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে অত ছোট জায়গায় ভালো করে রোগী দেখা যায় না। আমি হুইল চেয়ার পাঠাচ্ছি।’
চিৎকার করলাম। ‘সমীরদা। হুইল চেয়ারটা নিয়ে এসো।’
‘হুইল চেয়ারে আমি বসব না।’
বছর সত্তরের লম্বা, ফর্সা, জাঁদরেল মহিলা। তাঁর দাপটে স্বামী তো বটেই, ছেলে-বৌমা সবাই তটস্থ।
ওয়াকিং ফ্রেম দিলাম। তাও নিলেন না। আমিও কড়া। চলাফেরা করতে পারে। ক্রনিক রোগী। ভালো করে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। অ্যাম্বুল্যান্সে উঠে দেখব না।
শেষ পর্যন্ত বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রফাসূত্র বের করে স্বামী ও পুত্র তাঁকে ধরে ধরে চেম্বারের ভেতরে নিয়ে এলেন। হুইল চেয়ার, ক্রাচ, ওয়াকিং ফ্রেম- সব পড়ে রইল।
**************
অপারেশনের পরে ছয় মাস বাদে রুটিন চেক আপে আসা এক রোগীর এক্স-রে দেখছিলাম। মৌমিতা এসে বলল, পাশের ঘরে ড্রেসিংটা দেখে আসুন। সমীর জেঠু ডাকছে।
‘ড্রেসিং করতে বল। যাচ্ছি।’
‘না আপনি এখুনি চলুন।’
গেলাম। চারদিন আগে অপারেশন করা রোগী। বাঁ কব্জি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছিল। পুজোর মধ্যেই অপারেশন করতে হয়েছে। ড্রেসিং, প্লাস্টার সব খোলা হয়েছে। রোগীর হাতের দিকে তাকিয়ে আমার চক্ষু চড়কগাছ। অনেকক্ষণ জলে ডুবে থাকলে চামড়া যমন সাদাটে হয়ে কুঁচকে যায়- এর কব্জির চামড়া, সেলাই-এর আশপাশের চামড়া সেইরকম সাদা ও কোঁচকানো।
‘এ কি?’ পরিস্থিতি দেখে চমকে উঠলাম।
‘ড্রেসিং, প্লাষ্টার – সব ভিজে সপসপ্ করছে। হাত দিয়ে দেখুন।’ সমীরদা বলল।
‘সর্বনাশ! কি করে হল? জলে পড়ে গেছিলেন না কি?’
‘না, মানে বাঁ-হাত তো! পটিতে গিয়ে তো বাঁ-হাত দিয়েই ধুতে হবে।’
বাঙালী আজকাল পায়খানাকে পটি বলে। যাই হোক, বললাম-‘আপনাকে তো বলে দেওয়া হয়েছিল ড্রেসিং- প্লাষ্টার নষ্ট না করতে, জল না লাগাতে।’
‘পটিতে গিয়ে কি করে ধোবো তা তো বলে দেন নি।’
‘ধোবেন কেন। টিস্যু ব্যবহার করবেন।’
‘ঈশশ্, তা কি করে হবে? না ধুলে হয়?’
‘নিজে হাতের তো বারোটা বাজিয়ে নিয়ে এসেছেন!’
‘দুয়েকবার মাত্র করেছি। আর করব না।’
‘যা করার তা তো করেই ফেলেছেন। আর কি বাকি রেখেছেন? এবার ইনফেকশন হলে তো বলবেন, ডাক্তারের গাফিলতি।’
রোগীর স্ত্রী বললেন, ‘চার বেলা আমি খাবার খাইয়ে দিচ্ছি! আর পটিতে গিয়ে তুমি এইসব করছ?
‘ডাক্তার বাবু তো বলে দেন নি!’
‘কি বলে দেব? কি করে পায়খানা, থুড়ি, পটি করতে হবে?’
সবাই চুপ।
ড্রেসিং পাল্টানো হল, নতুন করে প্লাষ্টার লাগানো হল। আবার অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করতে হল।
‘ডাক্তারবাবু, সব ঠিক আছে তো?
‘কি করে বলব? ইনফেকশন না হলে আপনার কপাল। হলে আমাকে মাথার চুল ছিঁড়তে হবে।’