রবি ঠাকুর গেছেন জাপানে। স্থানীয় ভক্ত, বন্ধুবান্ধবদের সাথে খোশমেজাজে চা খাচ্ছেন। সবাই নিজ নিজ কাপ থেকে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। ব্যতিক্রম শুধু কবিগুরু। কাপের চা প্লেটে ঢেলে খাচ্ছেন। একটু পরেই তাঁর দেখাদেখি সবাই তাই করতে শুরু করলেন। অপ্রস্তুত রবীন্দ্রনাথ বলতে বাধ্য হলেন, আমরা প্রাচীন ভারতীয়রা এভাবেই চা খাই। তোমরা আমাদের অনুকরণ করছ কেন। ব্যাপারটা একদমই তাই। আপনার যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই চা বানাবেন এবং খাবেন। তবু সপ্তাহান্তের অবসর। একেবারে কিছু না করলেই নয়। তাই এইসব অপ্রয়োজনীয় চা-চর্চা।
আগের দিন প্রশ্ন রেখেছিলাম শুকনো পাতায় গরম জল ঢালবেন না কি গরম জলে চা পাতা দেবেন? অবান্তর প্রশ্ন, তাই না! কিন্তু শখ করে একটু দামি পাতা কিনে বাড়ি ফেরার পর এটা ভাবেন কি না বলুন? “ডিম আগে না মুরগি আগে”-এর মতো এতখানি জটিল দার্শনিক ধাঁধা না হলেও “জল আগে না পাতা আগে” এটাও কিছু কম ধন্দের নয়।
“Agony of the Tea Leaves” বলে একটা কথা আছে। চা গাছের মতনই এই প্রবাদটিও নাকি একটি চিনা আমদানি। প্রথমে ভেবেছিলাম ফুটন্ত তেলের কড়াইয়ে পকোড়া ছাড়ার মতো দেখতে লাগে বলে বোধহয় চিনারা একে Agony বলেছে। পরে বুঝলাম ব্যাপারটা তা নয়। এবার একটু কল্পনার আশ্রয় নিতে হবে। গরম জল পেয়ে দোমড়ানো মোচড়ানো শুকনো পাতাগুলো যখন নিজেদের মেলে ধরে সেটাকেই বলে Agony of the Tea Leaves. ভালো চা-পাতার সম্পূর্ণ রূপ রস গন্ধ উপভোগ করার নাকি এটাই উপায়। কেউ কেউ আবার এটাকে Dance of The Tea Leaves বলেন। যন্ত্রণা বলবেন না কি নৃত্য বলবেন সেটা আপনার ব্যাপার। তবে আমি আজকের এপিসোডের নাম রাখলাম পল্লব-লাস্য। আর এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে হলে লাগবে পাতা ভেজানোর জন্য আলাদা একটি কাচের পাত্র। এবার পছন্দমতো তিন থেকে পাঁচ মিনিট ভিজিয়ে রাখা এবং সুদৃশ্য কাপে ঢেলে তার সদ্ব্যবহার করা।
টী-ব্যাগস এর ব্যবহার এখন সর্বত্রব্যাপী। আমার মতে এটি একটি সুবিধাজনক শর্টকাট। 1908 সালে Thomas Sullivan নামের এক আমেরিকান চা ব্যবসায়ী বিজ্ঞাপনের খরচ কমাতে টিনের বাক্সের বদলে সিল্কের পাউচের মুখে সুতো বেঁধে কিছু চা বাড়িতে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। লোকজন ভেবে নিলো এটা বুঝি একটি ডিসপোজেবল ইনফিউজার। ব্যাস, আবিষ্কার হয়ে গেল টী-ব্যাগসের! তারপর থেকে এসেছে অনেক পরিবর্তন। গুঁড়ো চা থেকে ভাল পাতা-চা সব কিছুই হয়তো পাওয়া যায় এতে। তবে ব্যাগগুলি কতখানি পরিবেশবান্ধব, কাগজ ভেজা জল স্বাস্থ্যের জন্য কতখানি নিরাপদ ইত্যাদি অনেক প্রশ্ন থেকে যায়। যত যাই হোক ব্যাগ ব্যবহার করলে ভেজানোর পর কালো পাতা সবুজ হয়ে খুলে যাওয়ার দৃশ্য এবং তার সতেজ আঘ্রাণ ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত হতে হয়।
আসি জলের প্রসঙ্গে। Lu Wu তাঁর Cha Jing বা চা-সূত্র বইয়ে বলছেনঃ
“…tea made from mountain streams is best. River water is all right but well-water is quite inferior. Water from the slow-flowing streams, stone-lined pools or milk-pure springs springs is the best mountain water. Never take tea made from water that falls in cascades, gushes from spring, rushes in a torrent or that eddies and surges as if nature were rinsing its mouth.”
কিন্তু Lu Wu তো এসব কথা বলেছিলেন অষ্টম শতাব্দীতে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমাদের কি করা উচিত? প্লেন ট্যাপের জল, না কি অ্যাকুয়াগার্ড না কি ড্রিমগার্ল হেমা মালিনী প্রদর্শিত “সবসে শুধ্ পানি”? আমি ব্যক্তিগতভাবে যে জল পানযোগ্য মনে করি তা দিয়েই চা বানাই। একাধিকবার ফোটান জল ব্যবহার করলে স্বাদ খারাপ হয়ে যায়। আর ফুটন্ত উবুজ্বলন্ত জলের বদলে জলের টগবগানি বন্ধ হবার পর পাতায় ঢাললে ভাল। প্যাকেটের গায়ে প্রস্তুতপ্রণালী লেখা থাকলে অতি উত্তম। নচেৎ তিন থেকে চার মিনিট ভিজিয়ে রাখলেই জব ডান।
নাহ, লেখাটা “সুদীপার রান্নাঘর” টাইপস হয়ে যাচ্ছে। তাঁর চেয়ে বরং গল্পে ফেরা যাক।
চা-ভক্ত পর্তুগিজ রাজকন্যা ক্যাথরিন (Catherine of Braganza) 1662 সালে রাজা দ্বিতীয় চার্লসকে বিয়ে করলেন। ক্যাথরিন নাকি সেই অর্থে ভীষণ সুন্দরী ছিলেন না। উচ্চতায় খাটো। বহি:সৃত দন্তরাজি। সাধারণ দর্শনা এই কন্যাকে পাত্রস্থ করতে পিতা রাজা চতুর্থ জন অঢেল যৌতুক দিতে বাধ্য হলেন। এই যৌতুকের তালিকায় পড়ল ভারতের বোম্বাই (Bom Bahia), মরক্কোর ট্যাঙ্গার (Tangier) শহরের সম্পূর্ণ আধিপত্য এবং বিভিন্ন পর্তুগীজ কলোনিতে ব্রিটিশদের মুক্ত বাণিজ্যের অধিকার। সাথে নগদ পাঁচ হাজার পাউণ্ড পণ। দেনায় ডুবে থাকা রাজপরিবার লুফে নিল সে সুযোগ। আমি নিজেও এই অফারে দেখতে পাচ্ছি পাত্রপক্ষের শুধু লাভই লাভ কিন্তু নিন্দুকেরা এই বিবাহকে কেন “loveless marriage” আখ্যা দিলেন জানা নেই। রাজা দ্বিতীয় চার্লসের চরিত্র নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকলেও স্ত্রীর প্রতি কর্তব্যে অবহেলা করলেন না। যৌথভাবে লন্ডনে প্লেগ মহামারি এবং তৎপরবর্তী ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের মোকাবিলা করলেন। রাজপরিবারকে উত্তরাধিকার এনে দিতে ব্যর্থ হলেও ব্রিটিশ রাজপরিবারে ক্যাথরিন রেখে গেলেন তাঁর চা পানের অভ্যাস। আর রাজামহারাজাদের অভ্যাস চারিদিকে ছড়িয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। শোনা যায় যৌতুক হিসেবে তাঁর বাপের বাড়ি থেকে বাক্স বাক্স চা-পাতাও পাঠানো হয়েছিল। তবে শুধু শুকনো চা পাতায় যে রাজ পরিবারের মন ভেজেনি তা তো বোঝাই যাচ্ছে। যাকগে পরনিন্দা পরচর্চা ছেড়ে আবার চা-চর্চায় ফেরা যাক।
চায়ের সাথে চিনির সম্পর্কটা অনেক দিনের। শুনেছি চিনে লোকজন চিনি ছাড়া চা খায়। আবার তিব্বতে নাকি নুন বা মাখন দিয়ে চা খাওয়াটাই দস্তুর। তাহলে চায়ে চিনি এল কোথা থেকে? 1600 সালের আশেপাশে ব্রিটিশরা যখন চা খেতে শিখল সেই সময় চা ছিল একটা আভিজাত্যের লক্ষণ। কেবল মাত্র ধনীরাই তা কিনতে পারতো। চিনিও তখন এতটা সহজলভ্য ছিল না। উচ্চবর্গের মানুষজন কেক ইত্যাদির উপরে একটু চিনি ছিটিয়ে (icings) খেতেন। কিন্তু ভারতে পরিস্থিতিটা ছিল আলাদা। গুজরাত চিনি উৎপাদনে এগিয়ে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চিন থেকে চা আমদানি করতো সুরাট বন্দর মারফত। তারপর আবার জাহাজে করে নিজদেশে। স্থানীয় মানুষজনের এবং জাহাজের নাবিকদের চায়ে চিনি খাওয়ার অভ্যাস চালান হয়ে গেল বিদেশে।
এবার দুগ্ধ-সংযোগের ইতিহাস। ঢুকতে হবে 1680 সালের আশেপাশে, ফ্রেঞ্চ সোসাইটিতে। Madame de la Sabliere তাঁর সংগ্রহের দুর্মূল্য পোর্সেলিন কাপগুলো নিয়ে খুব গর্বিত ছিলেন। গরম চা সরাসরি তাতে ঢাললে পাছে ফেটে যায় তাই তিনি আগে সেই কাপগুলোর তলায় একটু করে দুধ ঢেলে রাখলেন। অবশ্য তার আরও কারণ থাকতে পারে। তখনকার দিনে চা এতো সুগন্ধি ছিল না। একটু তেঁতোও হত। দুধ ঢাললে হয়তো আর একটু গ্রহণযোগ্য হত।
তাহলে বুঝতেই পারছেন চায়ে দুধ-চিনি ঢাললে আপনাকে যদি কেউ আনস্মার্ট বলে তাকে বিশেষ পাত্তা দেবার কারণ নেই। তবে কি, দামী চায়ের ফ্লেভার পুরোপুরি পেতে গেলে এগুলো এড়িয়ে চলাই ভাল। আর চিনি বেশি না খাওয়ার তো আরও হাজারটা কারণ আছে।
আমরা সবাই বাজার থেকে যে চা কিনি সেগুলো মূলত ব্ল্যাক টী। গ্রীন টী-ও অনেকে খান। কিন্তু হোয়াইট টী বস্তুটা কি? তার দামই বা এতো বেশি কেন? এছাড়া আর কত রকমের চা আছে সেসব নিয়ে আগামী পর্ব।
সঙ্গে থাকবেন।
সূত্রঃ
1. A Brief History of Tea: Roy Moxham
2. Tea Culture: Beverly Dubrin
3. The Tea History Podcast: Laszlo Montgomery