একটা বাংলা বানান বোধহয় ভুল হয়ে গেল। সে মীমাংসা পরে করছি।
আজ KYC পর্ব। দু’ কিস্তি ইতিহাসের পর এবার Know Your Cha!
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। দার্জিলিং ম্যালে ঘোরাঘুরি করছি। আর পাঁচ জনের দেখাদেখি হঠাৎ গোল্ডেন টিপসে ঢুকে পড়লাম। মেডেন এন্ট্রি! ওয়েটার জিগ্যেস করলেন “ফার্ষ্ট ফ্লাশ?” একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, আমি তো ওটা করতে আসিনি। তাছাড়া ওটা ফার্স্টে কেন করব? ওটা তো লাস্টে করার কথা। তারপর তিনি আমাকে মেন্যু কার্ডটা ধরিয়ে দিলেন। খানিকটা বুঝলাম। একটু বেশি দামের পরোয়া না করে ফার্স্ট ফ্লাশই অর্ডার করলাম। সেই প্রথম জানলাম চায়ের সাথে ফ্লাশের সম্পর্ক।
গরম চা এল। সাথে ছাঁকনি ভর্তি সোঁটা সোঁটা ভেজা সবুজ পাতা। এবার একটু রাগ হল। ছাঁকা চা-পাতা আমার মা গোলাপ গাছের গোঁড়ায় দিত আর এই হতচ্ছাড়া আমার খাবার টেবিলে তুলে দিয়ে গেল! বুঝলাম চা আস্বাদন শুধু জিভ দিয়ে নয়, পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে করতে হয়। দেখবেন বিশেষজ্ঞরা একেবারে প্রথমে দেখেন। এক চিমটে শুকনো পাতা স্পর্শ করেন। ঘ্রাণ নেন। কাপ-প্লেটের টুং টুং আওয়াজে আকর্ষিত হন। তারপর পছন্দের পানীয়ে চুমুক দেন।
একেবারে গোদা বাংলায় ভালো চা বলতে আমরা প্রথমেই বুঝি পাতা-চা, গুঁড়ো নয়। একটা সময় ভাবতাম কলকাতা ট্রাম কোম্পানি যে চা তৈরী তাকে বলে CTC চা। তারপর জানলাম গুঁড়ো চায়ের পোশাকী নাম CTC. আর পরে জেনেছিলাম ছোট্ট শব্দটির মানে crushed, torn, curled! তাহলে চূর্ণ, ছিন্ন, কুঞ্চিত অবশিষ্ট দিয়ে যদি CTC হয়, ভালো পাতাগুলো কোথায় যায়! আগে বেশির ভাগটাই বিদেশে চলে যেত। এখন সাধারণ মধ্যবিত্তের নাগালেও এসেছে খানিকটা।
এবার ফ্লাশবৃত্তান্ত। গাছ থেকে পাতা তোলার মরশুম অনুযায়ী চায়ের ফ্লাশিকরণ হয়। দীর্ঘ শীতঝিমুনির পর ফেব্রুয়ারি মার্চ মাসে বেঁটেখাটো চিরহরিৎ গাছগুলো বসন্তে আবার জেগে ওঠে। এই মরশুমে যে পাতা তোলা হয় তাদের বলা হয় ফার্স্ট ফ্লাশ। নব পল্লবদল অকারণে চঞ্চল হওয়ার কারণেই বোধহয় এই চায়ের আভিজাত্য এত বেশি। হাল্কা হলুদ লিকার। গন্ধে ম ম। একটু কষাটে (astringent) স্বাদটাই হয়তো আরও আকর্ষণীয় করে তোলে একে। এরপর মে-জুন মাসে বর্ষার বৃষ্টি যখন সদ্য পাহাড়ে পৌঁছয় সেই সময়ে তোলা পাতা থেকে তৈরি হয় সেকেন্ড ফ্লাশ। নামে সেকেন্ড হলেও একে নিম্নমানের ভাবার কোনো কারণ নেই। গন্ধটা একটু চড়া। চমৎকার হলদেটে-বাদামি রংয়ের লিকার। মনে রাখবেন দার্জিলিং এর বিখ্যাত মাসকাটেল (Muscatel) চা কিন্তু সেকেন্ড ফ্লাশ! পাতা তোলার তৃতীয় সিজন আসে অক্টোবর নাগাদ। একে বলে অটাম (autumn) ফ্লাশ। এই চায়ের লিকারে থাকে একটা তামাটে রঙ। গন্ধে অত সুমিষ্ট না হলেও স্বাদে থাকে মাখনের (creamy) ছোঁয়া।
ঘুরে ফিরে সব পাতাই Camellia Sinensis, তবু কিছু বর্ণবৈষম্য তো থাকবেই! মূলত জারণ (Oxidation) মাত্রার ওপর নির্ভর করে সাদা, সবুজ, কালো ইত্যাদি নামকরণ হয়। গাছ থেকে কচি পাতা তোলার পর অতি সামান্য প্রক্রিয়াকরণে তৈরি হয় সাদা (white) চা। এই পাতা নাকি এত কচি থাকে যে এর গায়ে সাদা সাদা রোঁয়া লেগে থাকে। একটু বেশি পরিণত পাতা আর একটু জারিত হলে আমরা পাই গ্রীন টী। সবচেয়ে বেশি জারিত হলে হয় ব্ল্যাক টী। লাল, হলুদ, বেগুনি চা পাতাও আছে কিন্তু বাজারে অতটা চালু নয়। চা পাতা নিজে যত জারিত হয় তার Anti-oxidation properties তত কমে আসে। এজন্যই White tea এবং Green Tea এর Anti Oxidation ক্ষমতা Black tea এর চেয়ে ঢের বেশি এবং স্বাস্থ্য সচেতনদের কাছে অধিক প্রিয়। আবার অন্যদিক থেকে দেখতে গেলে বেশি জারণের ফলে কালো চায়ের স্বাদ সবচেয়ে বেশি।
সময় এসেছে শিরোনামের একটি বাংলা বানান ঠিক করে নেবার। চিনে ভাষায় Wu মানে কালো, আর Long শব্দের অর্থ ড্রাগন। হয়ত দেখে ওদের সেরকমই মনে হয়েছিল। ‘Oolong’ চায়ের জারণ মাত্রা সবুজ আর কালো চায়ের মাঝখানে। এছাড়াও আরও অনেক প্রক্রিয়াকরণ থাকে। আর তার জন্য প্রত্যেক বাগানেই থাকেন এক বা একাধিক Tea masters. চিনা চাষিরা যে কিভাবে একই গাছ থেকে এত বিভিন্ন রকম চা তৈরি আয়ত্ত করেছিলেন কে জানে!
Cultivated Variety বা সংক্ষেপে ‘Cultivar’ হল চা চেনার আর একটি মাপকাঠি। ওয়াইন রসিকরা যেমন দেখে নেন কি ধরণের আঙুর কোন ডিস্টিলারি ইত্যাদি, চা রসিকরাও কাল্টিংভার জানার চেষ্টা করেন। দীর্ঘ দিনের পরীক্ষা নিরীক্ষার পর কোনো ভ্যারাইটি যখন নির্দিষ্ট যোগ্যতামান অর্জন করে সেই গাছেরই কলম (Graft) তখন বেশি বেশি করে লাগানো হয়। বাগান বা অঞ্চল বিশেষে এই নিজস্বতা বজায় থাকে। যেমন দার্জিলিং এর একটি জনপ্রিয় কাল্টিভার AV2, জাপানের Yabikuta ইত্যাদি। এত সব না জানলেও চলবে। তবে অনেকে তো আলফানসো আম কিনে জানতে চান কোথাকার? মালদা না মুর্শিদাবাদের? তাই বলে রাখলাম।
এবার যে চায়ের গল্প বলব সেটি খেতে গেলে আপনার কুড়ুল-কাটারি লাগতে পারে। বাড়িয়ে বলছি না। Pu-erh বা Pu’er Tea একটি গেঁজানো (Fermentation) চা। শুধু চা বললে ভুল হবে। চা কেক বলা ভাল। নানা ভাবে একে গেঁজানো হয়। একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি হল বাঁশে ঠুসে। বিক্রিও হয় চায়ের বংশদণ্ড রূপেই! হুইস্কির মত এরও যত বয়স বাড়ে তত বাড়ে কদর এবং মূল্য। আমার এক চা-গুরু তো পরামর্শ দিলেন ব্লু চিপ শেয়ার ছেড়ে কিছু Bamboo Pu-Erh Tea কিনে রাখতে। আমাজনে খোঁজ করে দেখতে পারেন। চা-কেক শুনে অবাক হবেন না। চিনে খোলা চা পাতা এসেছে মিং রাজবংশের আমলে (1368-1644)। তার আগে পর্যন্ত এ ধরণের কেক ভেঙেই তৈরি করতে হত পছন্দের পানীয়।
কুলীন চায়ের গল্প অনেক হল। এবার সাধারণ চায়ে আসা যাক। বাঙালি তথা ভারতীয়দের কাছে চা শুধু একটি পানীয় নয়। “এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই” টাইপের একটি আবেগ। সকাল থেকে রাত যে কোন সময় আমাদের কাছে টী-টাইম। অলিতে গলিতে সর্বত্র মেলে এই গলানো সোনা। কিন্তু এ অভ্যাস তো খুব বেশি পুরনো নয়। সাহেবরা একটা সময় তাদের ব্যবসা বাড়ানোর জন্য রাস্তা ঘাটে আপিসে কাছারিতে আমাদের বিনা পয়সায় চা খাইয়েছে। অবশ্যই সস্তার সিটিসি চা। শোনা যায় ঘোড়ায় টানা গাড়িতে করে আসতো সে সব চা। সবচেয়ে বেশি ফ্রী স্যাম্পলিং হয়েছিল রেল স্টেশন চত্বরে। ফলশ্রুতিতে এখন ভারতীয় রেলের একটি স্টেশনও পাবেন না যেখানে বেশ কয়েকটি চায়ের দোকান নেই। তবে এই দোকানগুলোকে একদম হাল্কা ভাবে নেবেন না। গুজরাতে এরকমই একটি দোকানে বাবাকে সাহায্য করতেন এক কিশোর। তিনি এখন কি করেন আপনারা সবাই জানেন।
আজকের মত এখানেই থাক। পরের দিন একটি মহাচুরির গল্প শোনাব। রোমাঞ্চকর।
সূত্রঃ
চিত্রঋণঃ
Amazon
Ranjan Kapoor