সাহেবরা আমাদের চা চেনালেন। বোঝালেন বিকেল বেলায় উঁচু ডিনার টেবিলে রেখে বিভিন্ন খাদ্য সহযোগে খেলে তা হয় High tea. আর নিচু টেবিলে রেখে খেলে তা হয় Low tea! খেটে খাওয়া মানুষজন লাঞ্চ আর ডিনারের মাঝে বিকেলে আর একবার খেতে চাইবেন সেটাই স্বাভাবিক। সেই হিসেবে তাদের জন্য High tea আর বাবু-বিবিদের জন্য Low tea. ফার্নিচারের দোকানে দেখবেন টী টেবিল চাইলেই নিচু টেবিল দেখিয়ে দেবে। আর সেই টেবিল কারা কেনেন তা তো আপনাদের জানাই আছে । সে যাই হোক, আমরা আমাদের মতো করে চা খেতে থাকলাম। এমনকি টী ব্যাগস থেকে গুঁড়ো চা (CTC বা আমাদের ভাষায় Mamri চা) বের করে সসপ্যানে ঢেলে চিনি, দুধ, এলাচ দিয়ে ফুটিয়ে বানিয়ে নিলাম বিশুদ্ধ, সুমিষ্ট অনুপান। আহার পথ্য একীভূত। আর হবে নাই বা কেন? সেই মান্ধাতার আমল থেকে আয়ুর্বেদ মেনে থেঁতো করা আদা, গোলমরিচ, তুলসী পাতা, লবঙ্গ ইত্যাদি গরম জলে ফুটিয়ে, সামান্য মধু দিয়ে আমরা ‘কাড়া’ খেয়ে আসছি। তাতে একটু চা পাতা দিলে আর ক্ষতি কি!
কোন একটা হোয়াটসআপ ফরোয়ার্ডে পড়েছিলাম, এই মুহূর্তে ভারতীয়দের জাতীয় রোগ “ভাল্লাগছে না” বা Lassitude, আধুনিক বাংলায় ল্যাদ। আর এই রোগের সর্বাধিক প্রচলিত এবং জনপ্রিয় ওষধিও বোধহয় চা। আমার এই পোস্টের সাথে সংযুক্ত ছবিটি (চিত্র ১) স্বাধীনতা পরবর্তী কোন খবরের কাগজে বেরিয়েছিল। দেখান হচ্ছে পাঠরত একটি ছাত্রও তার বাবা মায়ের সাথে চা খাচ্ছে। অর্থাৎ বাচ্চা বুড়ো সবার জন্য কাজে লাগে এই পানীয়। অন্তত:পক্ষে বিজ্ঞাপনগুলো তো তাই বলে।
“ভাল্লাগছে না” রোগটা যে খুব নতুন বা শুধু আমাদের হয় তা নয়। বলছি অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকের কথা। ইংল্যান্ডের “ডাচেস অফ বেডফোর্ড” প্রিন্সেস অ্যানা-র (Anna) একদিন এই রকম ভাল্লাগছিল না। বিকেলের দিকে কিছু বন্ধুবান্ধব ডাকলেন। চায়ের সাথে থাকল ছোট ছোট কেক আর স্যান্ডউইচ। হল একটা ছোট্ট টী পার্টি। রাজ পরিবারে চালু হল afternoon tea খাবার অভ্যাস।
ভারতীয়দের চা পানের অভ্যাস তো অত পুরানো নয়। উচ্চকোটির খাস সাহেবদের Low tea, আম সাহেবদের High tea বা টেস্ট ক্রিকেটের টী-ব্রেক ছাপিয়ে আমরা যে সকাল থেকে রাত সব সময়কেই ‘চা-সময়’ বানিয়ে ফেললাম, তার পিছনে কারণ কি? মাত্র শ’খানেক বছরের পুরানো একটা অভ্যাস এত তাড়াতাড়ি আমাদের জীবনে এভাবে জড়িয়ে গেল বা অলিখিত জাতীয় পানীয়ের মর্যাদা পেল কি ভাবে? এর এক কথায় উত্তর, সুপরিকল্পিত প্রোপাগান্ডা। লাগাতার প্রচার যে একটা জাতির খাদ্যাভ্যাস বদলে দিতে পারে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হল চা। লাদাখ থেকে আন্দামান দেশের যেখানেই আপনি যাবেন চায়ের দোকান আপনি অবশ্যই পাবেন। আঁতেল আলোচনা থেকে হাল্কা গসিপ সব কিছুতেই আমাদের সঙ্গী চা। কোথাও কড়ক (strong) চা, কোথাও আদ্রক (Ginger) চা, কেরালায় সুলাইমনি চা, কাশ্মীরে গোলাপি রঙের নুন-চা, আর মুম্বাইয়ে পাবেন কাটিং চা। এক কাপ চা ভাগ করে ‘কাটিং’ চা খাওয়ার যে অনাবিল আনন্দ তা কি আর বাঙালিকে শেখাতে হবে? সেই কবে থেকে তারা কফি হাউসে বসে “তিনটে ডবল হাফ” খেয়ে আসছে! আবার ঠাণ্ডা চা ক’বার ফোটান হয়েছে তার ওপর নির্ভর করে তাকে ফুটে মাপা হবে না গজে মাপা হবে। তবে “মিটার চা” খাওয়ার চেয়ে দেখার অভিজ্ঞতা কিছু কম আনন্দের নয়। ভাবুন একটা মানুষ এক হাতের মগ থেকে হিমবাহের মত করে আর এক হাতের মগে ঢালছেন। একটি ফোঁটাও বাইরে পড়ছে না। তারপর সেই সফেন, গরম চা আপনি পান করছেন। আহা!
এর আগে তৃতীয় পর্বে বলেছিলাম ব্রিটিশরা কিভাবে চায়ের বিজ্ঞাপন দিচ্ছিলেন। স্বাধীনতার পর চা বাগানের মালিকানাগুলো যখন ধনী ভারতীয়দের হাতে এল তাঁরাও ব্যাপক প্রচারে মনোযোগ দিলেন। স্বদেশী আন্দোলনের সময় যাঁরা চা-কে ত্যাজ্য বলেছিলেন তাঁদের মন গলানোর জন্য এল নতুন কৌশল। দেখানো হল এক ভারতীয় মহিলা চা খেতে খেতে চরকা ঘোরাচ্ছেন (চিত্র ২)। শুরু হল চায়ের স্বদেশীকরণ। নেপথ্যে টী বোর্ড অফ ইন্ডিয়া। এই ফাঁকে বলে রাখি ১৯০৩-এ তৈরি হয়েছিল “Tea Cess Committee”. ১৯৩৭-এ তা বদলে হল “Indian Tea Market Expansion Board”. ১৯৫৩-য় আবার নতুন নামকরণ হল Tea Board of India, যার সদর দফতর এখনও কলকাতায়। আস্তে আস্তে দেশে বিভিন্ন স্বীকৃত চা-অঞ্চলের জন্য তৈরি হল আলাদা আলাদা লোগো। ভালো চায়ের প্যাকেট কিনলে দেখবেন দার্জিলিং, আসাম, ডুয়ার্স, কাংরা, নীলগিরি, ইত্যাদি সবার নিজ নিজ আগমার্কা ছাপ রয়েছে।
বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চা পাতার গুণমান অনেক উন্নত হয়েছে, দাম বেড়েছে এবং বাড়তেই থাকবে। তাই বলে চা শ্রমিকদের জীবন-মানের প্রভূত উন্নতি হয়েছে কি না জানি না। শুনেছি এঁদের জীবনে ম্যানেজার গোত্রের (Planters) মানুষজনের প্রবল প্রভাব। ম্যানেজাররাই এঁদের ‘মাঈবাপ’। বিচার থেকে বিবাহ সবই কিছুই নাকি এনারা স্থির করতে পারেন। প্ল্যানটারদের কর্মজীবনও ভীষণ ব্যস্ত হবারই কথা। তবে উদয়াস্ত পরিশ্রমের পাশাপাশি তাঁদের বিনোদনের আয়োজনও হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে এসেছে Planters’ Club. লেখাটা যেহেতু পানীয় নিয়ে তাই সে সব ক্লাবের কুটকাচালিতে না ঢুকে বরং “Planters Punch” নামক একটা ককটেলের কথা বলি। এই Punch শব্দটা এসেছে হিন্দি Panch থেকে। কারণ, এটি Rum, Sugar, Lemon, Water & Tea পাঁচটি জিনিসের মিশ্রণ!
আমার মত যাঁরা চা নিয়ে একটু বাচালতা করেন বন্ধুরা অনেক সময় তাঁদের ভুল করে Tea Taster বলে ফেলেন। Tea Taster-রা পুরোদমে পেশাদার। বাগানে চা তোলা থেকে আপনার কাপে পৌঁছন পর্যন্ত তাঁদের বিশাল ভূমিকা। কমপক্ষে পাঁচ বছরের ট্রেনিং লাগে একজন যোগ্য Tea Taster তৈরি করতে। আমি নিজে খুব বেশি হলে একজন Tea Connoisseur বা চা প্রেমী মাত্র। একটু আধটু যা পড়েছি, শুনেছি সেসব খানিকটা লিখে রাখলাম। না হলে আবার নিজেই ভুলে যাব।
যাকগে, গত বেশ কয়েকদিন ধরে আপনাদের পিছনে পড়ে আছি চা নিয়ে। চার পর্বের পর এবার ছাড়ার সময় এসেছে। যাঁরা লেখাগুলি দেখেছেন, পড়েছেন বা আমাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন তাঁদের সকলকে ধন্যবাদ। সুযোগ হলে আপনাদের প্রত্যেকের সাথে আমি চা খেতে রাজি। আজ দুর্গাপুজোর মহাষ্টমীর দিনে পাঠাচ্ছি পঞ্চম তথা শেষ পর্ব। আত্মীয় স্বজন নিয়ে জমিয়ে আড্ডা মারুন। চা খান। কফি খান। যা খুশি খান। যা খুশি করুন। আনন্দে থাকুন। ধন্যবাদ।
সূত্রঃ
1. Chai The Experience of Indian Tea: Rekha Sarin & Ranjan Kapoor
2. The British Ad Propaganda & The Journey From Tea to Chai: Snigdha Banerjee
3. The Triumph Of Tea: Philip Lutgendorf